পরিবার ও আমি (বিয়ে ,দাম্পত্য,শিশু লালন পালন )

কৃতজ্ঞতা!

কৃতজ্ঞতা!

ছেলের পরীক্ষা চলছে সপ্তাহ ধরে। এর আগের সপ্তাহটা জ্বরে ভুগে উঠলো। প্রতিদিন ই স্কুল থেকে আসার পর ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করি,পরীক্ষা কেমন হলো টিচার কেমন ছিলো কি কি সমস্যা হচ্ছিলো ইত্যাদি নিয়ে। প্রতিদিন ই ওর দায়সারা ভাবে উত্তর- ভালোই! হুম! মনে নেই ইত্যাদি।

৪র্থ পরীক্ষার পর বাসায় এসে আমি জিজ্ঞেস করার আগেই বলছে,আজকে এক্সাম ভালো হয়েছে আম্মু! আমি আলহামদুলিল্লাহ বললাম। সে আবার নিজে থেকেই বলছে,
- আজকে এক স্যার হলে ছিলেন,উনি আমার কপিটা নিজে স্কেল দিয়ে রোল টেনে দিয়েছেন,আই লাইকড ইট আম্মু!
আমি মুখে হাসি টেনেই একটা ধাক্কা খেলাম!


ওদের এবার ই প্রথম আলাদা কপিতে এক্সাম দিতে হচ্ছে,স্বাভাবিকভাবেই স্কেল দিয়ে দাগ টানা,প্রশ্ন দেখে উত্তর আলাদা করে লেখা এসব নিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে কিন্তু এসবের কারণেই কি ও মনমরা হয়েছিলো? আমি তো এভাবে ভেবে দেখিনি!


আস্তে আস্তে মোটামুটি সারাদিন ধরে জিজ্ঞেস করে যা জানলাম, প্রথম তিনটি পরীক্ষায় ওর পরিচিত মিস মানে রেগুলার ক্লাস নেন এমন টিচাররা ছিলেন। প্রথম টিচার বেশ রাগী বাচ্চারা সবাই ভয় পায়। ক্লাসে এসে রুলস বুঝিয়ে দিয়েছেন,এরপর কেউ ভয়ে আর বারবার জিজ্ঞেস করেনি কি করতে হবে,বিশেষত আমার ছেলে তাকে অনেক ভয় পায় সুতরাং সে যা যেভাবে বুঝেছে লিখেছে,মিস কপি চেক করে দেখেননি কিছু ঠিক করতেও বলেননি। দ্বিতীয় দিন যিনি ছিলেন উনি রাগী নন তবে খুব হিসেব করে কথা বলেন বাচ্চাদের সাথে। যা ই জিজ্ঞেস করেছে,বলেছেন- নিজে যা ভালো বুঝ সেভাবে করো,তোমার ইচ্ছে, যা বুঝেছ লিখ ইত্যাদি। পরের দিনের টিচার ও সেইম। ছেলেকে বাসা থেকে প্রতিদিন বুঝিয়ে দিয়েছি কিভাবে কি কি লিখবে কপি কিভাবে স্কেল করবে আর কিছু না বুঝলে অবশ্যই যেনো মিস কে জিজ্ঞেস করে।


চতুর্থ দিন হলে ছিলেন একজন স্যার। ছেলের ভাষায় সেও খুব বেশি কথা বলেনি কিন্তু ওকে হেল্প করেছে,ওর কপিটা বড় স্কেল দিয়ে দাগ টেনে দিয়েছেন,আরেকজন কপির পিন খুলে ফেলেছিলো বকা না দিয়ে পিন করে দিয়েছেন,একটা মেয়ে পানি খেতে যেয়ে ড্রেস ভিজিয়ে ফেলেছিলো তাকে টিস্যু দিয়েছেন। সুতরাং ছেলের ভাষ্যমতে, হি ইজ গুড। জিজ্ঞেস করলাম,তোমার কপি রেডি করতে হেল্প করেছেন এজন্য তাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?
সে বললো- হ্যাঁ আমি প্রতিদিন বকা খেয়েছি মিসের কাছে,স্কেল করতে ভুল করেছি তাই কিন্তু স্যার আমাকে বকা না দিয়ে নিজেই করে দিয়েছেন,ও বুঝেছিলো যে আমি পারছিনা।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
- এ জন্য তোমার কেমন লেগেছে?
ও হেসে বললো-
- আমি সাহস পেয়েছি,নার্ভাস লাগছিলো না আর৷
এবার আমি আবার ধাক্কা খেলাম।

কিছু সময় কাজ এগিয়ে দিলে,সাহায্য করলে মানুষ প্রচন্ডভাবে কৃতজ্ঞ হয় সেই সময়টা বুঝতে পারাটাও একটা নিয়ামত। সাহায্য তো আমরা কাউকে করতেই পারি কিন্তু একদম ওরকম কঠিন সময়ে এগিয়ে আসার সুযোগ? ওটা সব সময় আসে না।
মনে পড়ে গেলো,ইসলামী ব্যাংকে অনেক আগে যখন ব্রাঞ্চে যেয়ে টাকা জমা দিতাম,এখন যা অনলাইনেই করা যায়। তো প্রায় ই দেখতাম সে সময় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু ডাক আসে না বিরক্ত অবস্থা, তখন চেক লেখায় ভুল হয়েছে সামনের জনের,তাকে বলছে আবার লিখে আনেন,সে বেচারা লাইন ছাড়তে রাজি না ওখানে দাঁড়িয়েই ঠিক করছে! আবার ভুল করলে তাকে পাশে সরে যেতে হচ্ছে এরপর ঠিক করলো কিন্তু আরেকজন তো তার আগে লাইনে আসতে দিবে না,পেছনে যান! শুরু হতো তর্ক,রিকোয়েস্ট, রাগারাগি, নানান কথা।  এরমধ্যে কেউ কেউ বলতো,অন্য ব্যাংক হলে এরকম হতো ওরা সব কাজ কাস্টমারের হয়ে নিজেরাই করে দেয় এখানে তো সে অবস্থা নেই!!! আফসোস লাগতো।
তবে কিছু ব্রাঞ্চে দেখতাম অবস্থা ভিন্ন থাকতো,অফিসাররাই সুন্দর করে ঠিক করে দিত তথ্য জেনে নিয়ে। তখন আমি দাঁড়িয়ে থাকা কাস্টমারের চোখে কৃতজ্ঞতা দেখতে চেষ্টা করতাম।

তার ভুল হয়েছে এটা সবার সামনে শোনার মতো বিব্রতকর পরিস্থিতি হয়নি উলটো কেউ সেটা নিজেই সংশোধন করে দিচ্ছে। এটা খুব প্রয়োজনীয় সাহায্য এবং এমন একটা পরিস্থিতি যখন সাহায্য করার মতো অবস্থা সবার থাকে না।
ছেলেকে বুঝালাম,পরীক্ষার হল অনেক গুলো বাচ্চা, একজন টিচারের পক্ষে আসলে সম্ভব না সবাইকে হেল্প করা,ভালো হয় নিজেই যতোটা সম্ভব নিজেরটা করে নেয়া,আজকে স্যার দেখিয়ে দিয়েছেন সামনে থেকে নিজেই করবে ইনশাআল্লাহ। 


পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা গুলো মনে পড়ে গেলো,সেই সাথে নিজের পুরো জীবনটা শর্ট ফিল্মের মতো করে সামনে ঘুরেও গেলো। জীবনে পাওয়া অনেক মানুষের অনেক রকম সহযোগিতার মধ্যে কোন গুলো আমাদের খুব বেশি মনে থাকে আসলে?
পরিনত বয়সে এসে একটা বিষয় সহজে স্বীকার করি,যে কৃতজ্ঞ হওয়াটা আসলে কঠিন কাজ৷ এর চেয়ে অকৃতজ্ঞ হওয়া খুব সহজ। আমি ব্যাংকের লাইনে দাঁড়ানো সেই মানুষ গুলোর চোখে কৃতজ্ঞতা খুঁজতাম এবং খুব কমই পেয়েছি,বেশিরভাগ ধরেই নেয় এটুকু সার্ভিস তো আমার প্রাপ্য এরজন্য কৃতজ্ঞতার কি আছে? কিন্তু যিনি বা যারা কৃতজ্ঞ হতেন তাদের জন্য এই সাহায্যটুকুর স্বীকৃতি ছিলো এবং এটা খুবই মূল্যবান।


বাচ্চাদের জন্য আবার অবস্থা ভিন্ন,ওরা অল্পেই খুব খুশি।  আমার ছেলে সব প্রশ্নের উত্তর লিখে আসতে না পারলেও স্যার কপিতে স্কেল টেনে দিয়েছেন এতেই সে খুশী। একই অবস্থা অন্যদের বেলাতেও।ওদের কে একটু আদর করে দিলেই ওরা কৃতজ্ঞ হয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু আমরা বড় হতে হতে সাহায্য করা আর কৃতজ্ঞ থাকার মাঝে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হই তাই ভুলে যাই অথবা চাইলেও পারি না।


সাহায্য আসলে সব সময় সবার লাগেও না। যিনি করেন তার ও এটা বুঝতে হয় আর যিনি চাইবেন তাকেও বুঝতে হয়,সাহায্য সব সময় পাওয়া যায় না। এজন্যই এই দুই অবস্থার মাঝে সেতুবন্ধন করে,কৃতজ্ঞতা। 


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ
আমার ডিভাইস ভাবনা

আমার ডিভাইস ভাবনা

২২ জানুয়ারী ২০২৪

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

২৮ ডিসেম্বার ২০২৩

আমার বাচ্চা খায় না!!????

আমার বাচ্চা খায় না!!????

২৪ ডিসেম্বার ২০২৩