অনির্ধারিত

গল্প হলেও সত্যি (শেষ পর্ব)

গল্প হলেও সত্যি (শেষ পর্ব)

স্মৃতি গুলো যে কেন এতো বেয়াড়া আর স্বার্থপর হয়? সবার জীবনে ছড়ি ঘুরিয়ে চলাটাই তার কাজ। এই স্বাধীনচেতা স্মৃতি গুলো, তাদের ইচ্ছা স্বাধীন ছন্দে হাসাচ্ছে, কাঁদাচ্ছে, কালো মেঘ অভিমানে ছেয়ে দিচ্ছে মন, আবার তীব্র রাগে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে জীবন। এই যে আমি, কখনো কখনো গুমরে মরি, স্মৃতির তাড়নায়, সেই অভিভাবকটির হাত মাথার উপর নেই বলে। মানুষটা নেই, কতদিন হয়ে গেলো, কই ভুলতে-তো পারছিনা। সংসারের হাঁড়িপাতিলের ঠুংঠাং শব্দ ছাড়াও, আরও কিছু শব্দও তো ছিলো আমাদের মাঝে। কখনো ফিস ফিস শব্দ, ফিক ফিক হাসির শব্দ, চাপা কান্নার নিস্তব্ধ শব্দ, রিক্সায় চড়ে বিকেলে ঘোরার ক্রিং ক্রিং শব্দ……… এতো এতো শব্দ কি স্মৃতি থেকে মুছা যায়?

মা চলে যাবার দিনটা মনে আছে, স্পষ্ট মনে আছে। কুৎসিত ফিস ফিস গুলোও মনে আছে।
‘মরার আগ পর্যন্ত শাশুড়ির এতো সেবা করলা। বমি, পায়খানা, প্রস্রাব পরিষ্কার করলা, আর এখন কিনা সব গয়না নিবে তোমার ননদ? সময় থাকতে শাশুড়ির গয়নার ভাগটা বুইঝা নেও’, কথাটা শুনে ঘেন্নায় চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। ওরা কি কখনো বুঝবে, এই সম্পর্ক গয়নার দামে মাপা যায় না। পৃথিবীর সব গয়না কি আমাকে সেই তৃপ্তি দিতে পারবে, যেই তৃপ্তি আমি পেতাম স্নেহ ভরা হাতটার নিচে?

এই সমাজে কিছু মানুষ, স্থান, কাল, পাত্র, নির্বিশেষে স্বার্থের চাকা ঘুরায় তীক্ষ্ণ আত্মবিশ্বাসে। তখনও মায়ের খাটিয়া উঠেনি, আত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশীর ভিড়, কেউ মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে, কেউ সুবিধা মতো ঘরের কোণ খুঁজে নিয়েছে নিজ নিজ গল্পে মসগুল হতে।
সদ্য শাশুড়ি হওয়া এক প্রতিবেশী আন্টি, নতুন বউটিকে শুনিয়ে শুনিয়ে যখন বলে উঠল, ‘আপা-তো অনেক ভাল বউ পাইসে, যতদিন আপা বিছানায় পড়া ছিল এই বউই-তো সব কোরসে। আজ কালকার দিনে তো এমন বউ পাওয়াই যায় না, এমন বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।‘
খুব ইচ্ছে হলো এই একতরফা স্বার্থের চাকা ঘুরানো তীক্ষ্ণ আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেই। তাই ঘাড় ঘুড়িয়ে বলেই ফেললাম, ‘আমার শাশুড়ি মা আমার জন্য কি কি করেছেন সেটা তো খুব ভাল মতোই জানেন আন্টি। সেটাও বলেন। উনি আগে করেছেন বউকে আদর, তারপর পেয়েছেন শাশুড়ির কদর।‘ নতুন বউটির সামনে তার আমসি মুখটা দেখেই বুঝেছিলাম কথাটা উনার একেবারেই পছন্দ হয়নি। পছন্দ হবেই বা কেন, ‘ভাল বউ’ পদবীটাই সমাজে সর্বশুদ্ধ, ‘ভাল শাশুড়ি’ বলে যে একটা পদবী থাকতে পারে, সেটাতো আমি নিজেও কখনো ভেবে দেখিনি, কারণ সমাজ আমাকে ভাবতে শেখায়নি। ‘আমরা বউ আনিনাই, মেয়ে আনসি’ কথাটা যে শুধুই একটা সামাজিক প্রথা, যেই প্রথার সাথে যুগের পর যুগ হয়ে আসছে মিথ্যাচার, সেটা বুঝেছি শত শত সামিয়া আর হেমা-দের জীবন দেখে। আমার শাশুড়ি মা-র মুখে এই প্রথাগত উক্তিটি কখনো শুনিনি, হয়তো উনি একটু উল্টো হিসাব কষেছিলেন। উনি আমাকে স্বীকার করতে বাধ্য করেছিলেন, ‘বউ নয়, আমি এই বাড়ির মেয়ে’……
যে বয়সে বাবা মা, চেনা গণ্ডী ছেড়ে এই অচেনা পরিবারটিতে এসেছিলাম, সে বয়সে কি আমি জানতাম, কীভাবে ‘ভাল বউ’ হওয়া যায়? জানতাম, সমাজের আরও আট দশটা মেয়ের মতোই জানতাম, বিয়ের পরদিন সকালে একগলা ঘোমটা দিয়ে রান্নার খু...্তি ধরলেই ‘ভাল বউ’ হওয়া যায়। হাত থেকে খু...্তি কেঁড়ে নিয়ে, ‘রাইতে ঘুম হয় নাই বউমা? যাও ঘুমাইতে যাও’ বলেও যে সব ফেলে আসা মানুষটাকে আপন করা যায় সেটা কে জানত। এই উল্টো হিসাব আমার শাশুড়ি মা কেন আমার সাথে কষেছিলেন আমি জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি, আজকে আমার গায়ে যেই ‘ভাল বউ’ পদবীটা সেটে গিয়েছে, সেটা আমার যোগ্যতা নয়, বরং আমার শাশুড়ি মায়ের যোগ্যতা। চিরকালের বউ-শাশুড়ি যুদ্ধে আমি হেরে গিয়েছি, বারংবার হেরে গিয়েছি!!!!


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)