অনির্ধারিত

চন্দ্রগ্রহণে চন্দ্রাহত জীবন

চন্দ্রগ্রহণে চন্দ্রাহত জীবন

 

সেগুনবাগিচা বাজারের পাশে বড় বিল্ডিংটার চারতলায় কাজ করে তারার মা। আজকে তারাকে সাথে নিয়েই কাজে এসেছে। তারা মিষ্টির বাটি আর গ্লাস আনতে যেয়ে আড়চোখে বিছানায় রাখা ছোট পরীর মতোন বাচ্চাটার দিকে তাকালো। কী সুন্দর আর ফুটফুটে একটা বাচ্চা। বেগুনী রঙ্গের একটা তোয়ালের ভিতর গুটলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। তোয়ালের ভিতর থেকে ছোট্ট একরত্তি হাতটুকুন গালে দিয়ে কী যেন ভাবছে। তারার খুব ইচ্ছা করছে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে জড়ায়ে ধরে জোরে চাপা দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখে।

"এই তারা... ট্রেটা রেখে এসে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে মুছে আয়। বারান্দা থেকে আনা বাবুর কাপড়্গুলা ভাঁজ করে তারপর কিচেনে যাবি।" সায়মা আপার কথায় তড়িঘড়ি করে তারা কাপড় গুছাতে শুরু করে। পরীর মতোন বাচ্চাটাকে দেখে তারার শুধু বকুলের কথা মনে হয়। বকুল যখন পেটে তখন আব্বা সারাদিন বাইরে থাকতো। দুইবেলাই রিকশা চালাতো। বলতো নয়নাতারার ভাই হইলে নাম রাখুম বকুল আর বইন হইলে রাখুম শিউলী। এরপর হঠাৎ একদিন আব্বার হাত ভেঙ্গে বাসায় থাকা শুরু। তখন মার শরীর খারাপ থাকতো অনেক, সারাদিন অনেক কষ্ট করতো। তখন থেকে তারা মার সাথে কাজে যায়। কত মানুষ দেখলো তারপর থেকে। বকুল হওয়ার পর তারার কাছে রেখেই মা কাজে যেতো। তারা একটু পর পর বকুলকে কোলে নিয়ে গায়ের সাথে মিশিয়ে জাপটে ধরে রাখতো। 

বকুলের জন্ম থেকে ঠোঁটকাটা। বকুল পেটে থাকতে মা চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণ মানেনি এইজন্য বকুল এমন হয়েছে। বকুল হওয়ার পর থেকে মা কত কান্না করেছে। চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হওয়ার সময় পেটে বাচ্চা থাকলে কিছু খাওয়া যায় না, বাথরুমেও যাওয়া যায় না, পুরা সময় সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে হয় আর গ্রহণ শুরুর আগে একটা সাবানের ভিতর একটা সুঁই ঢুকিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু তারার মা এগুলো করেনি। বলছিলো- "গরীবের এতকিছু মানন যাইবো না। দুই দিন শরীরডা খারাপ আছিলো আজকে কামে না গেলে ওই বেডি আমারে আর রাখবো না।" একথা মনে পড়লেই তারার চোখে পানি চলে আসে। কী হতো কাজে না গেলে! বকুলের ঠোঁটটাতো এমন হতো না। গ্রহণের সময় সারাক্ষন পেটের পাশে একটা ছুরি নাহলে দা রাখলে বকুলের ঠোঁটকাটা হয়ে জন্মাতে হতো না। বস্তির সবাই বলে- "গ্রহণের সময় বকুলের মায় কোনো কাগজ নাইলে অন্যকিছু মোচড়াইছিলো নাইলে কোনো তরকারী-মাছ-গোশতো ফল কাটছে এর লেইগাই বকুল এমুন ঠোঁটকাটা হইছে।" তারা এখন জেনেছে ওর মা যদি এ সময় কিছু সেলাই করতো তাহলে বকুলের শরীরেও এমন কোনো ছিদ্র থাকতো।

গ্রহণের দিন মা চারতলার ম্যাডামকে বারবার বলেছিলো গ্রহণের নিয়মগুলা মানতে। ম্যাডাম বলছিলো- আরে বোকা! তোমার ছেলের এজন্য এমন হয়নি। আল্লাহ একেকজনকে একেকরকমভাবে পরীক্ষা করেন। কাউকে বেশি দিয়ে পরীক্ষা করেন আবার কখনো কাউকে কম দিয়ে। তুমি যে নিয়মগুলো মানার কথা বলছো এগুলো সবই কুসংস্কার। আমরা যদি এগুলো বিশ্বাস করি তাহলে বরং আমাদের গুনাহ হবে। বকুলকে নিয়ে তোমাকে কেউ কিছু বললে তুমি তাদেরকে জানিয়ে দিবে যে, এ নিয়মগুলো কিচ্ছু মানতে হবেনা। গ্রহণের সময় পড়ার জন্য আল্লাহ আমাদের সবাইকে নামাজ শিখিয়ে দিয়েছেন। সবার মতো আমিও তাকবীর পড়ছি, সদাক্বাহ করছি। কিচ্ছু হবে না ইন শা আল্লাহ। আর যদি আমার বাবুটা কোনো অসস্থতা নিয়েও জন্মায় তাহলে সেটা সূর্যগ্রহণের জন্য বা চন্দ্রগ্রহণের জন্য না। আল্লাহ আমার জন্য তা নির্ধারণ করেছেন বলেই এমন হবে। দুয়া করবে যেন আমি সুস্থ এবং নেককার সন্তানের মা হতে পারি। 

মায়ের মুখ থেকে ম্যাডামের এই কথা শুনার সাথে সাথে তারার বুকটা ধক করে উঠেছিলো। চারতলার ম্যাডামকে তারার অনেক ভালো লাগে। তারা গেলেই তারাকে অনেক ভালো খাবার খেতে দেয়। নিচে না বসে চেয়ারে বসে খেতে বলে। তারার স্কুলটা ম্যাডামের ভাই আর তার বন্ধুদের। তারাদের স্কুলের কারোই বেতন দিতে হয় না। বই, খাতা, স্কুলড্রেস সব স্কুল থেকে ফ্রি দিয়েছে। প্রতিবার তারা বাসায় গেলে ম্যাডাম ওর সাথে গল্প করে আর জিজ্ঞাস করে স্কুল থেকে কী কী শিখলো। এত সুন্দর করে কথা বলে ম্যাডাম! ওইবারের গ্রহণের পর থেকে তারা সারাদিন ভাবতো ম্যাডামের বাচ্চাটা ঠোঁটকাটা কিংবা প্রতিবন্ধি হলে ম্যাডামের কত কষ্ট হবে। আজকে ফুটফুটে বাচ্চাটাকে দেখে তারার মন থেকে এতদিনের ভয়টা কেটে গেলো! গ্রহণ কখনোই কোনো বাচ্চার ক্ষতি করতে পারে না! কোনো নিয়ম না মানলেও ম্যাডামের বাবুর কিচ্ছু হয় নাই।


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন