একটানা বৃষ্টি চলছে শহর জুড়ে। ঝুম বৃষ্টির দুপুরে এক কাপ চা খাবার সুযোগ এলেও,মন এ চলে হাজারো কথা৷ আর যখন কথা বলার জন্য কেউ থাকে না একেবারেই, তখন নিজেই নিজের কথা বলার সংগী হতে হয়৷
আজকাল খুব লিখতে ইচ্ছে করে,হুটহাট অনেক কথা কিন্তু বসার সুযোগ আসে না,যখন আসে তখন আর লিখতে ইচ্ছে করে না! এরপর থেকে যায় বিষন্নতা, লিখতে না পারার মনের ভাবনা মনেই পুষে রাখাবার।
টানা দশদিন তিন জেলার সফর শেষে ঘরে ফিরতেই বাচ্চা একজন অসূস্থ হলো। আমার ব্যস্ততারাও জেঁকে বসলো।এই সময় গুলো আসলে মনে হয় সেই বাচ্চাদের ইনফ্যান্ট থাকা সময়ে ফিরে গিয়েছি। ওরা ঘুমে থাকা অবস্থায় অনেক গুলো কাজ করে ফেলতে হবে,কিছু কাজ এদের বাবা আসলে করতে হবে,যদি না ঘুমায় তাহলে আর কিছুই করার নেই,কোলে নিয়ে বসে থাকতে হবে।
বাসা থেকে যাবার আগে মারিয়া আপুর সাথে হোম মেকিং এর কোর্স করার সুবাদে,বাসাকে অনেকটা গুছিয়ে রেখে গেলেও ফিরে এসে সেইইই বিশাল মাপের কাজ৷ তবুও কাজ করতে যেয়ে যখন কোথাও আগের পরিশ্রমের ছাপ খুঁজে পাই,অদ্ভুদ প্রশান্তি লাগে। আপু ক্লাসে বলেছিলেন-নিজের বাসার প্রতিটি কোণায় আপনার হাতের ছাপ যদি না থাকে,বাসা ছেড়ে ভ্যাকেশন আপনাকে প্রশান্তি দিবে না,বাসাকে নিজের জন্য প্রশান্তির করতে চাইলে এখানে নিজের সময় শ্রম দিতে হবে।
আপাতত সময় আর শ্রম দিয়েই প্রশান্তি খুঁজে যাচ্ছি।এবং এর মাঝে বাচ্চার অসূস্থতা,আরেক বাচ্চার পরীক্ষা সব মিলিয়ে এই ব্যস্ততারাও নতুন নতুন অনেক কৌশল শিখিয়ে দেয়,হাল না ছেড়ে এগিয়ে যাওয়া শিখিয়ে দেয়।
সেদিন মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার একটা এপিসোড দেখছিলাম,সামিরা নামের সেই প্রতিযোগিকে বিচারক জিজ্ঞেস করছিলো,নিজের জন্য এখানে এসে কি শিখলেন?
সে উত্তর দেয়- কোনভাবেই হাল ছাড়া যাবে না,এগিয়ে যেতেই হবে।
একটা ভীষণ নাড়া পেয়েছিলাম নিজের মাঝে। হাল ছাড়ার চাইতে ধরে রাখা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং বটে।
তিন বছরের ফুল টাইম ঘরনী হিসেবে আমি প্রায়ই প্রচন্ডভাবে হতাশ হয়ে যাই।বাসাটা সেভাবে গোছানো থাকে না কেন? সব কিছু পরিস্কার নেই কেন? ঝকঝকে লাগে না কেন? বাচ্চাদের অনেক কিছু শেখা হয়নি কেন? ওরা এতো অস্থির কেন?ওদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে না কেন? আমার ওজন বাড়ছে কেন? এতো ক্লান্ত লাগে কেন? নিজের জন্য কোন সময় বের করতে পারছিনা কেন? সারাদিন বাসায় কাজ ই করি কিন্তু তাকালে মনেই হয় না,এমন কেন হবে?
এরকম অজস্র প্রশ্নবানে নিজেই নিজেকে জর্জরিত করি প্রতিদিন আর বিষন্নতা হতাশার কাছে হার মানি। অনেক কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি তবুও কোথাও মনের প্রশান্তি পাচ্ছিনা।
যখন বাহির-ঘর একসাথে সামলাতাম, তখন অজস্রবার মনে হতো, বাসায় থাকলে আমার সংসার অন্য রকম হতে পারতো,বাসাটা আরোও সাজানো গোছানো থাকতো,বাচ্চাদের যত্নে আরোও গতিশীলতা থাকতো,আত্নউন্নয়ন বেশি হতো,সম্পর্কের যত্ন বেশি হতে পারতো এরকম অসংখ্য আফসোস কিন্তু তিন বছর আমাকে বারবার কবিতার সেই লাইন গুলোই মনে করিয়েছে,
নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নি:শ্বাস ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস
নদীর এপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে
কহে যা কিছু সকলি ওপারে!
এখন ধীরে ধীরে শিখছি,এগুলো হচ্ছে নিজের অভ্যস্ততা আর ইচ্ছের প্রতিফলন। পরিস্থিতি যেমন ই হোক, চেষ্টা আর অভ্যাস মানুষ কে সব কিছু ই করতে সাহায্য করে। ফুল টাইম বা পার্ট টাইমের অজুহাতের চাইতে,নিজের চেষ্টা আর মানুসিক শক্তি টা খুব জরুরি। প্রত্যাশায় লাগাম টেনে বাস্তবতা কে সাথে নিয়ে চেষ্টা করে যেতে হয়। সময় কখনোই সুসময় হয় না এমনি এমনি। যে কাজ গুলো আমি ফ্রি টাইম পেলে করবো ভাবছি,একটু একটু করে সেই কাজ গুলোই ব্যস্ততার মাঝেই করে ফেলা যায়। পরিকল্পনা খুব জরুরি এবং কাজ জমিয়ে না রাখার অভ্যেস।
যত্ন,সাজানো,গোছানো এগুলো একবারে, একদিনে, এক মাসে করে ফেলা যায় না,এগুলো কোন পাত্র না যে এক বসায় পরিপূর্ণ করে ফেললাম। এগুলো হতে পারে ছোট্ট বীজ থেকে অংকুরিত কোন বটবৃক্ষ বা ফলজ বৃক্ষের মতো,অথবা শস্যক্ষেত্র! একটা সময় পর্যন্ত প্রতিটি দিন একে সময় দিতে হয়,শ্রম দিতে হয় এরপর ফলাফল আসে এরপর আবার সেটা সাফ করতে হয় আবার বুনতে হয়...
সন্তান,সংসার,সম্পর্ক সবই এক সুতোয় বুনে নিজেকে গড়তে হয়। সেজন্য কোন আলাদা সময় লাগে না। দরকার নিজেকে দরকার নিজের ইচ্ছে,পরিকল্পনা আর পরিশ্রম।
অদ্ভুত অভিজ্ঞতা বটে! মানিয়ে নেয়াও কঠিন আবার না মেনেও উপায় নেই৷ যতদ্রুত মানিয়ে নিয়ে চলা যায় ততই ভালো।
আরোও কতো কিছু ঘটে যায় আর প্রতিবার শিখিয়ে যায় নতুন করে অনেক কিছু। সেদিন কিছু ঘটনা দেখে,কিছুদিন আগের দেখা একটা বিদেশি নাটক নিয়ে ভাবছিলাম! নাটকে বাবাটা খুবই মানিয়ে চলেন,অন্যের কাজ ভালোবাসা কে স্বীকৃতি দেন,বুঝতে চেষ্টা করেন সবাইকে,ছাড় দেন আর মা খুব জেদি এবং সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করেন, যথেষ্ট পরিশ্রমী,গুণবতী এবং সব বিষয় নিয়ে খুবই সচেতন ভাবে ম্যানেজ করতে পারদর্শী। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে খুব ভালোবাসেন কিন্তু সন্তানদের ব্যাপারে সমস্ত সিদ্ধান্ত মা ই নিয়েছেন, বাবা সহোযোগিতা করেছেন। দুই সন্তান পরিনত বয়সে এসে বাবা-মায়ের ই মতো হয়েছে তবে ভিন্নভাবে!বড় ছেলেটা মায়ের মতো আর ছোট ছেলে বাবার মতো। ফলাফল? বড় ছেলের সংসারে স্ত্রীর প্রচুর চাপা আর্তনাদ,তার ধৈর্য্য আর ত্যাগের লিস্ট বিশাল তবুও প্রাপ্য সম্মান বলতে লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই নেই, সন্তানদের ভেতর ভীষণ হাহাকার -হতাশা,তাদের নিজস্ব কোন জীবন নেই পুরোটাই বাবার নিয়ন্ত্রণে আর ভদ্রলোকের একরোখা মনোভাব, কর্মজীবনে সফল, প্রাচুর্য-সম্মানিত অবস্থান থাকা সত্ত্বেও ভেতর থেকে এরা কেউ ই সুখি না। অন্যদিকে ছোট ছেলের সংসারের চিত্র বিপরীত। দীর্ঘদিন পর বাবা-মা এর সাথে ছেলেরা পরিবার নিয়ে সময় কাটাতে আসলে,বৃদ্ধ বাবা-মা এই অবস্থা গুলো দেখতে পেয়ে হতবাক হয়ে যান। এমনতো হবার কথা ছিলো না?!!
মানুষ হিসেবে কতো রকম সীমাবদ্ধতা আমাদের। চাইলেও আমাদের শত পরিকল্পনা, প্রচেষ্টা সেই কাংখিত সফলতা এনে দিতে পারে না আবার কিছু ক্ষেত্রে কেবল মানুসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি এতো এতো সফলতা দেয় যেটা পরিমাপ করা যায় না।
এই যে সম্পর্ক, এসব কেবল টিকিয়ে রাখার জন্য আল্লাহ দেন না,এগুলোর ফল হয় ফুল হয়,এক পরিবার থেকে আরেক পরিবার তৈরি হয়। এর আরেকটা পিঠে সেই সম্পর্কের ছাপ দেখা যায়। সেটা কেমন হবে,এপিঠে তাই দাগ টানার সময় খেয়াল রাখাটা জরুরি। কেউ ই কারো খারাপ চায় না কিন্তু ফলাফল খারাপ আসে আবার ফলাফল না ভেবে শুধু চেষ্টা ই সফলতা কে হাতে ধরিয়ে দেয়! কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়া,নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কি এতোই সহজ?
সোশ্যাল মিডিয়ায় মাঝে কিছুদিন লিগ্যাসি শব্দটা বেশ চলেছে। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া কর্মের ছাপ তার উত্তরসূরীদের মাঝে কতোটা দেখা যায়,তাদের অবস্থানে উত্তরসূরীরা আসতে পারছে কি না এসব নিয়ে। সফল ব্যবসায়ীর ছেলে সফল ব্যবসায়ী হওয়াটা লিগ্যাসি? ভালো পিঠে বানাতে জানা মায়ের মেয়েটাও সুস্বাদু পিঠে বানাতে পারলেই কি লিগ্যাসি ধরে রেখেছে বুঝায়?
লিগ্যাসির ভালো-খারাপ দিক কি হতে পারে? এসব নিয়ে খুব একটা কথা বা আলোচনা আসে না। কারণ এখন আবার টক্সিক মানুষের ছায়া থেকে দূরে থাকা নিয়েও সবাই ব্যস্ত। এই ব্যস্ততা কবে যে নিজেকেও টক্সিক করে দিচ্ছে সে দিকে খবর থাকছে না,মতের অমিল মানেই সে আমার জন্য টক্সিক!
জ্ঞানের এই সহজলভ্যতার যুগে মানুষ জ্ঞান কে বাস্তবে প্রয়োগের চাইতে মনের সিন্দুক পুরে আরেকটু সহজ জীবন যাত্রা খুঁজে বেড়াচ্ছে! ফলাফল, মানুষ ই হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের ভীড়ে।
বেলা বাড়ছে। হয়তো পরেও আসছে। দিনের শুরুতে যে কাজ গুছিয়ে শুরুর করা হয়নি,শেষ বেলায় কি তার সুন্দর সমাপ্তি হবে?!
#শুকনোপাতার_রাজ্য
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)