পরিবার ও আমি (বিয়ে ,দাম্পত্য,শিশু লালন পালন )
মাতৃত্ব একটি পেশার নাম( পর্ব -১)

ক্লাসে শিক্ষক পড়াচ্ছিলেন পুরুষ এবং নারীর পেশা সম্পর্কে। পুরুষ এবং নারীর পেশার জন্য আলাদা আলাদা যায়গা করলেন বোর্ডে। শুধুই নারীর পেশা শুধুই পুরুষের পেশা কোনগুলো। একে একে সব লেখা হল। আমি বললাম, মাতৃত্ব শুধুই নারীদের পেশা। ক্লাসে কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করলো, মাতৃত্ব কেমন করে পেশা হতে পারে! পেশা মানে তো টাকার বিনিময়ে খাতা খাটুনি করা, একটা বিশেষ কাজে দক্ষ হয়ে ওঠা। তাই না?
মাতৃত্ব তাহলে কীভাবে পেশা হল! এটা অনেকের কাছেই বিরাট একটা প্রশ্ন। পেশা বা কাজের ডেফিনেশন কোন সমাজ বিজ্ঞানী কোনভাবে দেয় তা আমি জানিনা। ক্যামব্রিজ ডিকশনারি মোতাবেক any type of work that needs special training or aparticular skill, often one that is respected because it involves a high level of education
অন্যদিকে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ও প্রায় একই রকম সংজ্ঞা দিয়েছে। সাথে জুড়ে দিয়েছে পেইড শব্দটি।
অন্যদিকে সারা পৃথিবীতে নানা সেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী, মানবাধিকার কর্মী যারা বিনে পয়সায় সেবা দেয়, তাদের ও একটা পেশা আছে। সেচ্ছাসেবক! যদিও তা সবসময় টাকার বিনিময়ে নয়।
আমার কাছে পেশা মানে, কোন একটা কাজের জন্য নিজের সমস্ত শ্রম, মনোযোগ উৎসর্গ করা। সে হিসেবে মাতৃত্বের চেয়ে বড় কোন পেশা আর পৃথিবীতে নেই।
যেমন ধরা যাক, একটি শিশুর জন্মের পরে একজন মা যেসব দায়িত্ব পালন করে তার কিছুই টাকার বিনিময়ে নয়। কিন্তু একজন মহিলা যখন টাকার বিনিময়ে শিশুকে দুগ্ধ পান করায় তখন তার নাম হয় ধাত্রী, যখন বাচ্চার কাঁথা কেউ টাকার বিনিময়ে পরিষ্কার করে দেয়, তখন তার পেশার নাম হয় বুয়া, বাচ্চাকে কেউ দেখাশোনা করলে তার নাম হয় আয়া বিদেশে এটার পেশাও আছে, নেনে।
চাকুরীজীবী মায়েদের বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য ও আছে ভিন্নরকম পেশা, বেবি সিটার। মোটা অংকের টাকা আয় করা সম্ভব এই পেশার মাধ্যমে।
কিন্তু এই কাজগুলোই যখন একজন মহিলা মা হিসেবে করেন তখন তিনি যত শিক্ষিত আর যত শৈল্পিকই হন না কেন, তাকে বলা হয় তিনি কিছু করেন না । সারাদিন বাসায়ই থাকেন।
মাতৃত্ব আমার কাছে একধরণের পেশার মতোই। প্রফেশনালিজমকে আমাদের কালচারে একটি নেতিবাচক শব্দ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রফেশনাল মানেই আমাদের কাছে আর্টিফিশিয়াল, আন্তরিকতাহীন রোবটের মতো মানুষ, প্রফেশনাল মানেই টাকার জন্য কাজ করা মানুষ। অথচ, প্রকৃতপক্ষে প্রফেশনালিজম মানে যে কোন একটা নির্দিষ্ট কাজের প্রকৃত সৌন্দর্য বজায় রেখে,যতোটা সুন্দরভাবে একটা কাজ করা যায় ঠিক ততোটা সুন্দর এবং সঠিকভাবেই সেই কাজটা করা।
প্রফেশনালিজমের এই সংজ্ঞা অনুযায়ী মাতৃত্বের চেয়ে বড় প্রফেশন, এবং একজন মায়ের চেয়ে বড় প্রফেশনাল মানুষ আর কেউ হতে পারেনা।
আমার কাজিন শুধুমাত্র সন্তানকে দেখাশোনা করার জন্য স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি ছেড়ে দিলো। এরপর সারাদিন তার গবেষণা, কী খাওয়ালে বাচ্চা ভালোভাবে বেড়ে উঠবে, কোন কোন কাজগুলো বাচ্চার মানসিক বিকাশের জন্য উপযোগী! সে তার বাচ্চাকে চমৎকার একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছে।
আরেকজন চাকুরীজীবী মা’কে জানি। অস্বাভাবিক ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি বাচ্চাদের খাবারের সপ্তাহিক রুটিন করেন, খাবারে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট কী কেমন কতো পরিমাণ থাকবে তা নিয়ে ভাবছেন। বাচ্চাদের সময় করে গোসল করানো, খাওয়ানো , গান কবিতা শেখানো, সহ নৈতিক শিক্ষা দেওয়া কিছুই বাকি নেই। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার বদলে সন্তানদের নিয়ে কখনো ঘুরতে কখনো বই কিনতে যাচ্ছেন। এই চাকুরীজীবী মা একজন শিক্ষিকা, তিনি চাকুরীজীবী হলেও মাতৃত্বে প্রফেশনালিজম বজায় রেখেছেন। ব্যস্ত সময়ের মধ্যে একটু আধটু অবসরে হিন্দি সিরিয়াল না দেখে সন্তানদের জন্য সময় বরাদ্দ করছেন। মাতৃত্বে আকণ্ঠ ডুবে আছেন।
নিজের কথাই বলি। পি এইচ ডি করতে দেশের বাহিরে এসেছি, মাতৃহীন সংসারে ভাই বোনদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে। রুমমেট বাংলাদেশি, ২ সন্তানের মা। আমি বাসায় প্রতিদিন ফোন করতে পারিনা। বেশিরভাগ সময়ই সময় পাইনা। দারুন ব্যস্ত সময় প্রতিদিন।
আমার রুমমেটকে দেখি উঠতে বসতে, শুতে খেতে সারাক্ষণই বাচ্চাদের সাথে কথা বলেন। প্রতিদিন তার ৪ বয়সী বাচ্চাকে ভিডিও কলে থাকার যায়গা দেখাচ্ছেন, বাচ্চাদের জন্য কিছু খেলনা কিনেছেন। প্রতি নিয়ত তারা সেসব দেখতে চাচ্ছে। অপরিসীম ধৈর্যের সাথে যতবার দেখতে চায় , ততবারই দেখান। হাজার মাইল দূরে থেকে বাচ্চারা কী করছে, কী খাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে সব খোঁজ খবর রাখছেন। মানুষ একজন হলেও ২৪ ঘণ্টা ৩ জন মানুষের সমান চিন্তা করা মাতৃত্ব ছাড়া আর কোন কাজে সম্ভব?
(চলবে)
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)