ইন্টারন্যাশনাল উইমেন

স্যেকুলার তুরস্কে নারী ও নারী ভাবনা ( পর্ব- ১)

স্যেকুলার তুরস্কে নারী ও নারী ভাবনা  ( পর্ব- ১)

তুরস্ক, দেশটার নাম মনে পড়লেই আমাদের দেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের মনসে ভেসে ওঠে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী মুসলিম দেশের কথা। আমার কল্পনায় ভেসে উঠতো স্টাইলিশ বোরখায় আচ্ছাদিত নারীদের একটি দেশ। কিন্তু তুরস্ক আমাকে কখনো বিস্মিত করেছে, কখনো করেছে বিমোহিত, কখনো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মানুষের উপরটাই সব নয়।

মিনিস্কার্ট পড়া নারীকে দেখেছি মসজিদে ঢুকে নামায পড়তে আবার হিজাব পড়া মেয়েকে দেখেছি সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পরপুরুষের গায়ে ঢলে পড়তে।

অটোম্যানদের দেশে আপনি পোশাক দেখে তার বিশ্বাস খুব বেশি বিচার করতে গেলে নিজেকে একসময় জাজমেন্টাল হিসেবে দেখতে পাবেন। কখনো একটি নন হিজাবি মেয়েকে দেখেছি হাসি দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে, আবার কখনো হিজাবিদের কাছ থেকে পেয়েছি রুঢ় আর শীতল আচরণ। মোটকথা, কোন কিছুতেই খুব বেশি অবাক হওয়া যাবেনা এই দেশে।

তুরস্কে নারীভাবনা নিয়ে হয়তো গোটা একটা বই লেখে ফেলা যাবে। তবে আমি কাছিমের গতিতেই বিশ্বাসী। প্রায় এক বছর দেখে আসা তুরস্কে নারী স্বাধীনতার যে রুপ আমি দেখেছি তার তাত্ত্বিক আর দার্শনিক বিবরণে না যেয়ে সত্যিকারের বাস্তব অভিজ্ঞতা সেক্টর ওয়াইজ বলার চেষ্টা করবো।

তুরস্কে সবচেয়ে ভালোলাগার যায়গা তুরস্কের মসজিদগুলো। বাংলাদেশের বড় বড় আলেমদের তুরস্ক থেকে শেখার আছে প্রচুর। ইউনিভার্সিটির শিহইয়িয়ে ক্যাম্পাসে মসজিদটা বেশ ছোট, কারন অনেক পুরাতন। কিন্তু তারমধ্যে ও আল্লাহর বান্দা যে নারীরাও তা কর্তৃপক্ষ ভুলে যেতে পারেনি। মূল মসজিদের পাশে ছোট একটি কামরা হলেও নারীদের জন্য বরাদ্দ আছে। গিয়েছিলাম সুলতান সুলাইমানের প্রাসাদে। মারমারা ঘেঁষে হেরেমের ঠিক পাশেই প্রাচীন মসজিদটি, একটি জাদুঘরের মসজিদেও নারীদের জন্য যায়গা রাখা হয়েছে। শুধু ইস্তাম্বুল আর আঙ্কারা নয়, যতো যায়গায় গিয়েছি কোন মসজিদ খুঁজে পাইনি যেখানে নারীর প্রবেশ হারাম! কিংবা নারীদের দেখলে বাঁকা চোখে তাকানো হয়, অথবা ফতওয়া দেওয়া হয়। এসব দেখে আমি বুঝে নিয়েছিলাম, ব্যাপারটা তাদের সংস্কৃতিতে মিশে গেছে। এমন কী! বাংলাদেশে মেয়েরা সব মসজিদে ঢুকতে পারেনা এটা শুনলে  টার্কিশরা আকাশ থেকে পড়ে।  

তুরস্কের মসজিদগুলোর গঠন আমাদের দেশের মসজিদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং নারীবান্ধব। সাধারণত দোতালার উপর গ্যালারি সিস্টেমে মসজিদগুলো তৈরি হয়ে থাকে। অনেক মসজিদের দোতালা কাঠের তৈরি, অনেকগুলোর ইট পাথরের। গ্যালারি সিস্টেম হওয়াতে দোতালা থেকে সরাসরি ইমামকে দেখা যায়।

এ বছর এপ্রিলের দিকে ইস্তাম্বুলের নারীরা পুরুষের সাথে একই ফ্লোরে নামাজ পড়ার অধিকার চেয়ে বসেছে। ব্লু মস্কে যেয়ে আমি নিজেও নারীদের জন্য সংরক্ষিত যায়গার বাহিরে নামাজ পড়তে বাধ্য হয়েছি। কখনো কখনো এতো বেশি সংখ্যক নারী নামাজীদের আগমন ঘটে মসজিদে যে সংরক্ষিত এলাকায় আর ঠাই হয়না। সুতরাং দাবী যৌক্তিক। হিলাল কাপ্লান নামের এক নারী অধিকার কর্মী এই বিষয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে জাতীয় দৈনিকে বড়সড় লেখা ও লেখেছেন।

এসব দেখে মনে পড়তো জন্মভূমির কথা। পথে ঘাটে ফরজ ইবাদতের জন্য কতোটা সাফার করতে হয়েছে কতো দিন, না জানি কতো বছর।

নামাজ পড়ার দৃশ্য তো দূরে থাক, মসজিদের মিম্বার কেমন , কেমন ভেতরের আলোকসজ্জা তা দেখার সৌভাগ্য ও হয়নি। মসজিদ এক পুত পবিত্র যায়গা, যেখানে নারীর অপবিত্র শরীর অবাঞ্ছিত। এক ঢাবির কেন্দ্রীয় মসজিদে তো মাগরিবের পরে চোর আর ছিনতাইকারীর ভয়। কারন মেয়েদের জন্য একটি কক্ষ একদম মসজিদের শেষ মাথার সুনসান নীরব যায়গায় বরাদ্দ। বারকয়েক সেখানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ও ঘটেছে সন্ধ্যার পরে। খাদেম তাই মাগরিবের নামায শেষ হতেই তালা চাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোনদিন মেয়েদের অজুখানার টয়লেটের বাতিটি জ্বলতে দেখিনি।

ধানমন্ডির তাকওয়া মসজিদে গিয়েছিলাম একদিন মাগরিবের পরে, সবে জামাত শেষ হয়েছে। খাদেম মহিলাটি আমাকে অজু করার অনুমতি দিলেও টয়লেটে যেতে দিবেন না। তাও অজুর জন্য দয়া করে ৫ মিনিট বরাদ্দ করেছেন আর নামাজে জন্য ৫ মিনিট। মহিলার সেদিনের ব্যবহার মনে আসলে এখনো রাগে শরীর রি রি করে। তার ভাবটা এমন ছিল যে মেয়ে মানুষ সন্ধ্যার পরে মসজিদে নামায পড়তে দিচ্ছি তাই না বেশি, আবার পবিত্র হতে চাও!  অথচ, রমজান মাস ছাড়াও সাধারণ সময়েও তুরস্কে মেয়েদের ফজর আর এশার নামায জামাতে পড়তে দেখেছি। রাত ১২ টা পর্যন্ত যে কোন মসজিদে মেয়েরা ঢুকতে পারবে, পছন্দমতো ইবাদত , ধর্মীয় আলোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন। পুরুষের ঈমান রক্ষার্থে নারীর মসজিদ দর্শন বা প্রবেশ এখানে হারাম হয়ে যায়নি। আমাদের দেশের পুরুষদের ঈমানের নাটবল্টু এতোটাই ঢিলে যে তা ঠিক রাখতে নারীদের ঈমানি অধিকার মসজিদে প্রবেশাধিকারকে সীমিত করতে হয় পুরুষশাসিত সমাজকে। একটা সমাজে নারীর অবস্থান জানতে চাইলে তাই সে সমাজের ইবাদতখানাগুলো দেখতে যেতে হবে।  (চলবে)


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)