ইন্টারন্যাশনাল উইমেন

স্যেকুলার তুরস্কে নারী ও নারী ভাবনা ( পর্ব- ২)

স্যেকুলার তুরস্কে নারী ও নারী ভাবনা  ( পর্ব- ২)

মসজিদের পরেই তুরস্কের নারীদের মধ্যে লক্ষণীয় বিষয় সমাজে তাদের সরব উপস্থিতি। এখানে পিছিয়ে নেই কোন শ্রেণীর নারীই। হোক সুশীল, হোক ধার্মিক। তবে, কর্পোরেট সেক্টরে এখনো স্যেকুলার নারীদের আধিপত্য বেশি মনে হয়েছে তুলনামূলকভাবে। ১৯২৪ সালে সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রের মূলভীত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠাকারী মোস্তফা কামাল আতার্তুক যদিও কখনো হিজাব ব্যান করেননি, তবে মনে প্রাণে চেয়েছেন বোরখা হিজাবকে তুরস্ক থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে। ১৯৮০ সালে সেনাবাহিনী আইন মোতাবেক হিজাব নিষিদ্ধ করা হলেও ১৯৯৭ সালে সে আইন বাস্তবায়ন করা হয়। স্কুল কলেজ এবং কর্পোরেট সেক্টরে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়। মাত্র কদিন আগে, ২০১৩ সালে বর্তমান সরকার এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।

এই ব্যাপারে কথা হয়েছিলো গাজায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়া জাহাজ ব্লু মারমারায় থাকা একজন এক্টিভিস্ট গুলদেন সনমেযের সাথে। গুলদেন হিজাব নিষিদ্ধকরণের এক বছর পরেই গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ল’ পড়ুয়া এই নারী আইনজীবী হিজাব ছাড়তে রাজি হননি। তাই বাধ্য হয়ে দেশের বাহিরে পাড়ি জমান পড়ালেখা শেষ করার তাগিদে। ইস্তাম্বুলে আন্তর্জাতিক ছাত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে কান্না জড়িত কণ্ঠে সেই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন তিনি। অনেক নারীই হিজাব নিষিদ্ধকরণের সে সময়টাতে উইগ পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতো। তারপরেও অনেকে ধরা পড়ে যেতো। গুলদেন সনমেয স্বীকার করেন যে এক দশকের বেশি সময় ধরে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞার ফলস্বরূপ অনেক নারীই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং বর্তমান তুরস্কের কর্পোরেট সেক্টরে তারই প্রভাব বিদ্যমান।

আরেকজন আইনজীবী আয়েশা দোয়ানগুজেলের সাথে আমার পরিচয় পারিবারিকভাবেই। পারিবারিক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তাদের আন্তরিকতায়। তিনিও একই ঘটনার শিকার। ১৯৯৭ এ হিজাব ব্যান করার পর তিনিও ল পড়া শেষ করতে পারেননি। এরদোয়ান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ৯৭ এর ভিক্টিম নারীদের আবার পড়ার সুযোগ দিলে তিনি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন এবং বর্তমানে সরকারী উকিল হিসেবে আঙ্কারায় কর্মরত আছেন।  

২ শব্দ ইংরেজি না জানা হোস্টেল সুপার হিলাল আবলা আপাদমস্তক হিজাবি। তার সাথে একদিন এই ব্যাপারে কথা বললে তিনি বলেছিলেন আমাদের কর্পোরেট সেক্টরে এখন অনেক বেশি শিক্ষিত ধার্মিক নারী প্রয়োজন। আমি নিজে একজন শিক্ষক হতে চাই। তার মতো পর্দানশিলের এমন কথায় আমি কিছুটা হতবাক হয়েছি বটে।

দাতব্য কাজে নারীদের বিপুল অংশগ্রহণ আপনাকে মনে করিয়ে দিতেই পারে ইসলামের সেই স্বর্ণযুগের কথা। তুরস্কের অন্যতম বিখ্যাত দাতব্য সংস্থা ইহাহার নারী বিভাগের কাজ প্রশংসা পাওয়ার দাবীদার। কখনো ইতিহাস বিষয়ক ক্ষুদ্র কোর্স, কখনো হাতের কাজের জিনিষ বানানোর প্রশিক্ষণ এবং সেসব বিক্রি করে ডোনেশন রেইজ করা কখনো বা ইয়াতিম শিশুদের জন্য খাদ্য তৈরি করে বিক্রি করা। কোন শনি রবিবার আপনি এই ধরণের দাতব্য সংগঠনের কর্মী মহিলাদের দেখবেন না বাসায় শুয়ে বসে বিশ্রাম নিতে। উইকেন্ড মানেই মানবতা রক্ষায় আত্মনিয়োগ করা। তুরস্কে কেরমেস খুব বিখ্যাত একটি টার্ম। ডোনেশন রেইজের জন্য রান্না করা খাদ্যদ্রব্য স্টলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বিক্রি করা। সাথে থাকতে পারে হাতের কাজের রকমারি সামগ্রী। কেরমেসের ৫ পয়সার হিসাব ও ইহাহার বান্ধুবি দুরসিনাকে যেভাবে রাখতে দেখেছি তার সাথে দুনিয়ার সততার অন্য কোন সংজ্ঞাকে তুলনা করা যাবেনা। ওদের হিসাব দেখলে আপনার মনে হবে, হয়তো ৫ মিনিট পরেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে আর আল্লাহকে ইয়াতিম আর ফিলিস্তিনি মজলুমের জন্য তোলা টাকার হিসাব দিতে হবে বুঝি! আমাদের দেশে ক্যান্সারের রোগীর জন্য টাকা তুলে বন্ধুদের টাকা মেরে দেওয়ার মতো ঘটনা এখানে মোটামুটি অসম্ভব এবং অবিশ্বাস্য!

তুরস্কের নারীরা কুড়িতেই বুড়ি হওয়ার নীতিতে বিশ্বাস করেনা। আসমা কপরু নামক একটি ছাত্র সংগঠনের পিকনিকে দেখেছি ৮০ বছরের বুড়ি ও আনন্দ করে, নাচে ,গান গায়, দোলনায় চড়ে। তুরস্কের নারীরা ধার্মিক অধার্মিক নির্বিশেষে কর্মচঞ্চল এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। পাহাড়ি পথ বেয়ে থুড়থুড়ে কোন বুড়িকে যখন নির্ভয়ে একা একা চলতে দেখলে এই ভাবনাটাই মনে আসে।

(চলবে)


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)