সাহিত্য

রন্ধ্রে রন্ধ্রে উত্তেজনা

রন্ধ্রে রন্ধ্রে উত্তেজনা

হাবিব ঢাকায় আসবে শুনে শরীরের সমস্ত রন্ধ্রে রন্ধ্রে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে নীলিমার। আনন্দের ধর্মই যে  ছড়িয়ে পড়া! সেই ছোট্টবেলা থেকেই হাবিবের সাথে পরিচয় নীলিমার। একই গ্রামে থাকা, স্কুলের চলতি পথে দেখা হওয়া থেকেই শুরু। হাবিব কিছুটা মেরুদণ্ডহীন ছেলে, নীলিমাই বরং আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছে বহুবার। সেই থেকেই প্রেম ভালোবাসা। হাবিবের ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হওয়া, নীলিমার  ঢাবিতে চান্স পাওয়া, হাবিবের খুলনা শহরে বড় সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরী হওয়া। জীবনটা যেন একজনের সাথে আরেকজনের  বিনি সুতায় গাঁথা।

দুজন দুজনকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসলেও একটা যায়গায় ভীষণ অমিল। সেই অমিলটা রক্তের সম্পর্ক আর পরিবার কেন্দ্রিক। নীলিমার দাদা জাত হিন্দু ছিলেন। সে অনেক আগের কথা। তিনি মূলত বিক্রমপুরের মানুষ। খুলনায় ব্যবসার জন্য যাওয়া হতো। একবার ব্যবসার উদ্দেশ্যে যাওয়ার পর তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জরে কাতর হয়ে পথে শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন। এক মসজিদের ইমাম সেই রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। অসুস্থ জ্ঞানহারা নিরঞ্জন রায়কে পথে পড়ে থাকতে দেখে মানবিকতা বিচার করে তিনি তাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। রোগী সে হিন্দু কী মুসলিম তা জানার আগে সেবাটাই জরুরী।

নিরঞ্জন রায় ইমাম বাড়ির অন্ন জল গ্রহণ করে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি লক্ষ্য করে দেখেন তিনি ইতিমধ্যেই তার জাত খুইয়েছেন।

আপাতত যদি স্বজাতির কাছে এটা গোপন ও করেন, কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে তো তিনি পরাজিত। এরপর ভাবলেন- খুলনাতেই থেকে যাবেন এবং ইসলাম গ্রহণ করবেন।

নিরঞ্জন রায় ইসলাম গ্রহণ করলেন, উত্তরোত্তর ব্যবসায় সাফল্য লাভ করলেন, ইমাম সাহেবের হাফেজা কন্যাকে বিয়েও করলেন। কিন্তু, হিন্দু ধর্মের অনেক আচারই ভুলতে পারলেন না। তার স্ত্রী খুব পুণ্যবতী নারী বলেই হয়তো সহ্য করে গেছেন। হাজার হোক, চাপিয়ে দেওয়ার তো আসলে কিছু নেই।

নীলিমার দাদার আর্থিক প্রতিপত্তি যদিও বা আছে, তারপরেও একই ঘরে দুই ধরণের বিশ্বাস লালনের খবর সমাজের কারোই অজানা নেই। এ নিয়ে মানুষের গল্প গুজবেরও কোন শেষ নেই।

হাবিবের সাথে নীলিমার বিয়ের কাঁটা এটাই। হাবিবদের খানদানী পরিবার, এবং গোঁড়া ধার্মিক। যে মেয়ের গাঁয়ে হিন্দু দাদার রক্ত বইছে এমন মেয়েকে কোনদিনও হুজুর বাড়ির বউ করা হবেনা বলে কসম খেয়েছেন হাবিবের মা।  হাবিবকেও কোরআন শপথ করানো হয়েছে মরা মুখ দেখার ভয় দেখিয়ে- যে নীলিমাকে সে কোনদিন বিয়ে করবে না।

যথারীতি মেরুদণ্ডহীন হাবিব! সেই প্রতিজ্ঞাই পালন করে যাচ্ছে। শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও।

কিন্তু নীলিমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত ও যে ভাবতে পারেনা। যতবার সম্পর্ক ভাঙ্গে ততবারই যেন আরও দিগুণ আকর্ষণে জোড়া ও লেগে যায়। ভেঙ্গেও ভাঙ্গেনা, আবার গড়েও না চিরদিনের জন্য।

হাবিবের ঢাকায় একটা ভাড়া করা ফ্ল্যাট আছে। ছুটির দিনে ঢাকায় চলে আসে। এখানেই নীলিমার সাথে তার রঙিন সময়গুলো কাটে। সুখের সময়ে বিলীন হয় দুজন।

এইটুকুই তো সুখ জীবনে। কিন্তু স্বামীর মতো ভালোবাসা সত্ত্বেও হাবিব নীলিমার স্বামী হতে পারেনি। ওদিকে নীলিমার দাদাও কম নন। নও মুসলিম পরিবার বলে হুজুর বাড়ির তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের খবর তার অজানা নয়। এবং তিনিও নাতনিকে আরও উঁচু ঘরে বিয়ে দিয়ে একহাত  দেখে নেওয়ার স্বপ্নে বিভোর।

বিনা মেঘে বাড়িতে যাওয়ার ডাক আসলে নীলিমা ভাবে – এই বুঝি পাত্র হাজির করে বলা হল- ওঠ মেয়ে ! তোর বিয়ে!

আবার চোখ বুঝলেই হাবিবের হাসি, পাগল করা চাহনি, আদর ভালোবাসা! নাহ ! এসব ছাড়া বাঁচার কথাই বা কীভাবে ভাবে নীলিমা!

কিন্তু এভাবে আর কতোই। সেদিন হাবিবকে বলল

-      দেখো! তোমার মতো মেরুদণ্ডহীন পুরুষ আমি আর দেখিনি! জানো! আমার কতো চাপ বাসা থেকে!

-      তোমার চাপ হলে আমি কী করবো বল?

-      বিয়ে করো না কেন এতোই যদি ভালোবাসো?

-      তুমি চাও তোমার জন্য আমার মায়ের মরা মুখ দেখি আমি?

-      আমি তাই বললাম বুঝি!

-      তুমি কী বোঝো না তোমাকে বিয়ে করা মানেই আমার মাকে মেরে ফেলা?

-      তাই যদি হয় ছেড়ে দিচ্ছ না কেন! অনেক তো চুষে চুষে খেলে!এবার আমাকে একটা সংসার করতে দাও!

-      যেতে চাইলে যাবে। এখন তো আমার থেকে বড়লোক ছেলে পাবে, তাই ছাড়তে চাইছ! সবই বুঝি

 

এভাবেই কথার নৈপুণ্যে হাবিব নীলিমাকে ব্ল্যাক্মেইল করে আবেগ আপ্লুত বোকায় পরিণত করে। এভাবে ঝগড়া হয়, কয়দিন কথা বার্তা বন্ধ। সপ্তাহ ঘুরে ঘুরে হাবিবের ছুটির দিন আসে। সে ঢাকায় আসে, নীলিমাকে ফ্ল্যাটে আসতে বলে। নীলিমার ও অনেকদিনের অভ্যাস। হাবিব এসেছে শুনে সে নিজেকে দমাতে পারেনা। ফ্ল্যাটে ছুটে যায় এক প্রবল আকর্ষণে। আবার আদর ভালবাসায় সব অধিকার বঞ্চনা, সব অপমান ভুলে যায় নীলিমা। আবার ঝগড়া হয়, আবার ঝগড়া পানি হয়। আনন্দরা আসে , রন্ধ্রে রন্ধ্রে উত্তেজনা ছড়ায়। যদিও দুজনেই মোটামুটি নিশ্চিত তাদের এই আনন্দ চিরদিনের নয়। নীলিমার পড়া শেষ হলেই দাদা বিয়ে দিবেন, পাত্র ঠিক করা আছে। আর হাবিব মায়ের খুশীর জন্য এমন দশটা নীলিমাকেও ছাড়তে পারে। সুতরাং, নীলিমার ও অন্নত্র বিয়ে ছাড়া কোন উপায় নেই। তাই অবৈধ সম্পর্কের গন্তব্য মোটামুটি নিশ্চিত। হাবিব ও হয়তো কোনদিন সব ভুলে বিয়ে করবে। সঙ্গিনীর পাশে শুয়েও কল্পনা করবে সে নীলিমার চুলে বিলি কাটছে। নীলিমারও হয়তো স্বামীর পাশে বসেই মন উড়ে উড়ে যাবে হাবিবের কাছে।আকর্ষণ যদি একেবারেই এড়ানো না যায়, হয়তো এরকমই আরেকটা ফ্ল্যাটে চুপিচুপি চলবে হাবিব নীলিমার গন্তব্যহীন সম্পর্ক। অবৈধ ভালোবাসা হয় অভ্যাসবশত ; চাইলেও ছাড়া যায় না। আর বৈধ ভালোবাসা হয় দায়িত্ব ; যা চাইলেও এড়িয়ে যাওয়া যায়, শয়তানের কুমন্ত্রনায়। যে ভালোবাসায় দায়বদ্ধতা থাকেনা, ত্যাগের মানসিকতা থাকেনা  তা ভালোবাসার চেয়ে উত্তেজনা বলাই শ্রেয় বলে মনে হয় নীলিমার কাছে। আর সেই রক্ত মাংসের অভ্যাস থেকেও ফেরা খুব কঠিন ঠেকে। ছাড়তে চেয়েও ছাড়তে পারেনা, আবার হিসাবের খাতারও হিসাব মিলেনা।

 

হ্যা। হয়তো তাই। কিছু কিছু সম্পর্কের কোন গন্তব্য থাকেনা। শুধু অসীম কষ্ট আর ঠিকানাবিহীন অপেক্ষাই হয়তো এসব সম্পর্কের নিয়তি। যা কখনোই শেষ হয়েও হয়না শেষ। ধিকি ধিকি আগুনের মতো জ্বলে যা ব্যক্তিকে তো নিঃশেষ করেই তার সাথে নিঃশেষ করে তাদের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া নতুন মানুষটিকে ও। হয়ত.........কে জানে সে খবর! 


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)