সকালে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। সাইজে ছোটখাটো একটা মেয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো। রিকশা ঠিক করছে। ওড়না গলায় প্যাঁচানো। এই বয়সেই হাই হিল, পায়ে লেগিংস। একেবারে পুরদস্তুর আধুনিক মেয়ে। রিকশাওয়ালাকে বলছিল- সারা জীবন তো এই ভাড়া দিয়েই গেলাম ওখানে।
দেখে বুঝছিলাম, ক্লাস এইট নাইনে পড়ে মেয়েটা বড়জোর। অকালপক্ক ভেবে অন্যদিকে তাকালাম।
একটু পর দেখলাম মেয়েটা তার সাথে একটা বোরখা পরিহিতা মহিলা ও একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে রিকশায় উঠলো। বুঝলাম এরা দুজন মেয়েটার মা এবং ভাই।
অথচ, মায়ের ভূমিকা এতক্ষণ ছিল নীরব দর্শক। মেয়েটার মা বোরখা পড়েছে, যেটা বিশেষত একটা আদর্শ কিংবা চেতনাকে ধারণ করার কথা। আর এই মূল্যবোধ যখন কোন নারীর মধ্যে থাকবে সেটা স্বভাবতই তার সন্তানের মধ্যেও সংক্রমিত হওয়ার কথা। যে পোশাক আমি বিশ্বাস দিয়ে লালন করি, ধারণ করি, সেই পোশাক, সেই বিশ্বাস সন্তানকে দিতে না পারলে মা হিসেবে আমার বিশ্বাস প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
হয় মহিলাটি এই পোশাক নিজের সুবিধার জন্য পড়ে, আর নাহয় না বুঝেই পড়ে। কোন আদর্শকে বা এর তাৎপর্যকে মনে ধারণ করে পড়ে না এটা তার সন্তানের পোশাক বা আচরণ দেখেই বোঝা যায়।
নারী পুরুষকে গাছের সাথে তুলনা করা যায়। পুরুষকে যদি ওষুধি বা কাষ্ঠল গাছ ধরা হয়, ধরা যায় পুরুষের শ্রম ও ত্যাগকে। যেমন কাঠ বিক্রি করলেই তার গাছের মূল্য পাওয়া যায়। ফল বেঁচে তার উপযোগ তুলে আনার কথা ভাবাও যায় না।
কিন্তু নারীকে তুলনা করি ফলবতী গাছের সাথে। বলা হয়- বৃক্ষ তোমার নাম কী ? ফলেই পরিচয়
নারীর সেই পরিচয় হয় সন্তানের কাজ কর্মে। সে কোন ধরণের চিন্তা ভাবনা লালন করেছে, কী শিক্ষা পেয়েছে , কেমন জ্ঞানের অধিকারী ছিল তা যাচাই করতে খুব বেশী দূর যেতে হয়না। তার সন্তানের আচার আচরণ একটু যাচাই করলেই বোঝা যায়। সুতরাং একজন মহীয়সী নারীর প্রকৃত মূল্যায়নের অন্যতম মাপকাঠি তার সন্তান। এই উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় - আমাদের ঘরগুলোই আসলে ঠিক নেই । নাহলে আজ সমাজের এই করুন অবস্থা হতো না।
পল্টনে একটা লিফটের বিল বোর্ড টানানো আছে। অমুক লিফট কিনে সাথে বুঝে নিন আপনার গিফট।
লিফটের ছবির পাশেই একটা মহিলার ছবি। খুব অযৌক্তিক লাগছিল। সাবান পাউডারের সাথে নাহয় নারীর একটা সম্পর্ক আছে, কিন্তু লিফটের বিজ্ঞাপনে কেন নারীর ছবি, জিজ্ঞেস করলাম বান্ধুবিকে।
ও বলল- নাইলে তো পাবলিক তাকাবে না দোস্ত।
এটাই আসলে প্রকৃত সত্য কথা। পাশে প্রেসিডেন্ট ব্যাগের বিল বোর্ড। একটা মেয়ে ব্যাগের হ্যান্ডেল হাতে, আরেকজন ব্যাগ সামনে রেখে লাফ দিচ্ছে। ব্যাগ কী শুধু মেয়েরাই ব্যবহার করে?
ব্লুপ আইসক্রিমে বিল বোর্ডে আইসক্রিম নারীর চুলে লাগানো। মানে আইসক্রিম আর নারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। দুটাই একই রকম বস্তু।
আর এই বিজ্ঞাপনগুলো কারা করছে? এরা কী কোনদিন মা হবেনা? আর এই ধরণের মায়েদের থেকে সমাজ বা সন্তান কী পাবে? সমাজের অবস্থা দেখে জনতাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। পরিবার মানুষের প্রাথমিক শিক্ষাস্থল । শিক্ষাটার শুরু পরিবারে হচ্ছেনা। মা বাচ্চা ফেলে কর্পোরেট অফিসে বসের প্রিয় হবার জন্য নখে নেইল পালসিহ লাগাচ্ছে। লোভে পড়ে সবজি কাটার ছলে এক সিরিয়াল ৩ বার দেখছে, মা বোরখা পড়ে মেয়েকে ফ্যাশন শিখাচ্ছে , মা ছেলেকে মেয়েদের প্রতি সম্মান শিখাচ্ছে না বলেই আজ সমাজের এই অবস্থা। আর আমরা যারা বুঝি, আমরা যারা সব কিছু সামলে নিতে জানি তাদের ঘাড়েই এই দায়িত্বটা পড়ে যে এদের সঠিক পথ দেখানো। অন্তত মা হয়েছে যারা কিংবা ভবিষ্যতে যারা মা হবে তাদের জন্য কাজ করা। চাকরি না হোক, একটু সামাজিক সচেতনতা, একটু আন্তরিকতা, একটু জ্ঞানের আলো সমাজকে বাঁচাতে পারে। এই দায়িত্ব পুরুষের নয়। সুতরাং, মেয়েদের শুধুই গৃহিণী হওয়া অনুচিত। গৃহিণী হওয়ার আগেও একজন নারী। তাকে তার চারপাশ ভালো রাখতে হবে। স্বার্থপরের মতো নিজের সন্তানটা মানুষ হলেই হবে এটা ভাবা যাবে না। কারণ, তার সন্তানটা ও স্কুলে যাবে, নৈতিক শিক্ষাহীন একটি পরিবারের ছেলের সাথে মিশবে। খুব বেশী জনকে না। আমরা যদি শুধু আমাদের চারপাশের মানুষগুলোকে নিয়েও ভাবি, আরাম আয়েশ সিরিয়ালের ফাঁক থেকে একটু সময় বের করে একটু তাদের মাঝে মূল্যবোধগুলো ছড়িয়ে দেই তাহলেই কাজগুলো খুব সহজ হয়ে যেতো। মূল্যায়ন পাবার জন্য কর্পোরেট অফিসে নখ ঘষতে হতো না। কারন এই মূল্যায়ন স্বয়ং স্রস্টা করবে, এবং বৃহত্তর অর্থে সমাজ ও উপকৃত হতোই।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)