পরিবার ও আমি (বিয়ে ,দাম্পত্য,শিশু লালন পালন )

তাড়াতাড়ি বিয়ের গুরুত্ব এবং আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি

তাড়াতাড়ি বিয়ের গুরুত্ব এবং আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
বিয়ে ইদানিং ফেইসবুকের কল্যাণে একটা বিপ্লব চলছে। তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হচ্ছে তরুণদের। নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো কাজ। অনেক বোনকেও দেখা যাচ্ছে এর পক্ষে প্রচারণা চালাতে। আমি আমার এই লেখায় চেষ্টা করবো আমাদের সমাজের কিছু দৃষ্টিভঙ্গীকে পরিষ্কার করতে আর প্রধান সমস্যাগুলো তুলে ধরতে। তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যাপারে এ পর্যন্ত বহু বই লেখা হয়েছে। অনেক ফতোয়া দিয়েছেন উলামারা। সেগুলোর সংকলিত বইও বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের সমাজের অভিভাবক রা সেসব বইগুলো হাতে তুলেও দেখেন না। যদিও তাদের চোখের সামনেই স্কুল-কলেজ-ইউনিভারসিটির ছেলেমেয়েরা হাত ধরাধরি করে চলাফেরা করছে। তাদের বোধ শক্তিকে যেন কেড়ে নেয়া হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই যেন নবী আর সাহাবীদের আদর্শকে বাদ দিয়ে নিজ নিজ আদর্শ কে আঁকড়ে ধরেছেন। আর আঁকড়ে ধরেছেন নষ্ট সমাজের রীতিনীতি। হাদীসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি চরিত্র রক্ষার উদ্দেশ্যে বিবাহ করে, আল্লাহ তাআলা তার সাহায্য করাকে নিজের প্রতি অবধারিত করে নিয়েছেন।” (তিরমিযী, হাদীস: ১৬৫৫; নাসায়ী, হাদীস: ৩২১৮) এখন প্রশ্ন হলো চরিত্র রক্ষার কথা হাদীসে কেন বলা হলো? কারণ আল্লাহ্‌ মানুষকে কিছু উপাদান দিয়ে বানিয়েছেন আর সে উপাদান গুলোর ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় ও বলে দিয়েছেন। আর বিয়ে সমাজের বেহায়াপনা আর অশ্লীলতা বন্ধের একটা সমাধান হিসেবেই ইসলাম এর দেয়া একটা উপহার। আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের বিয়েকে অভিভাবকরা আটকে দেন উপার্জনের দোহাই দিয়ে। অবশ্য আটকাবেন না ই বা কেন? কোন পাত্রির পিতা কি সুপ্রতিষ্ঠিত নয় এমন ছেলের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিবেন? সোজা উত্তর হলো কখনই না। দুনিয়া উলটে যাবে সেটা সম্ভব নয়। কারণ, আজ আমাদের সমাজে ইসলাম ই সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। (মেয়ে কিংবা তার পরিবারের ভুমিকা পরে আলোকপাত করছি) সুতরাং ছেলে প্রতিষ্ঠিত না হলে বিয়ে হবার কথা কি করে ভাবা যায়? অবশ্য কিছু কিছু ইমানদার পরিবার রয়েছে যারা সমাজের এই নিয়মকে মানেন না। আল্লাহ্‌ তাদের উত্তম প্রতিদান দিয়ে ধন্য করুন। আজকাল বিয়ে করতে গেলে ছেলেদের ১০-২০ ভরি স্বর্ণের শর্ত চাপিয়ে দেয়া হয়। আর মোহরানার অতিরিক্ত মাত্রা তো রয়েছে। যার ফলে পড়ালেখা শেষ করে একটা ছেলে চাকরি পেলেও স্বর্ণ গয়নার টাকা জোগাড় করতে করতেই তার বয়স ৩০ পার হয়ে যায়। আসলে কি এটা একটা সমাজ হতে পারে ?? সাধারন বিবেকের কাছে এটা প্রশ্ন। একটা ছেলের বিয়ের পথে উপার্জন বা রিযিক কোন বাধা নয়। যদিও আমাদের সমাজে এই কথাটা দিয়েই বুঝ দেয়া হয়। আসলে আল্লাহ্‌ মানুষের রিযিক নির্ধারিত করে রেখেছেন। আর আল্লাহ্‌ ই মানুষের রিযিক বা প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান দেন। রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহ্‌র হাতে ন্যাস্ত। আল্লাহ্‌ বলেন, “ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর বর্তায় না এবং যার সম্পর্কে তিনি জানেন না, কোথায় সে থাকে এবং কোথায় তাকে সোপর্দ করা হয়। সবকিছুই একটি পরিষ্কার কিতাবে লেখা আছে” -(হুদ:০৬) উক্ত আয়াতে আল্লাহ্‌ নিজে বলেছেন তিনি একটি নির্দিষ্ট কিতাবে সব কিছু লিপিবদ্ধ করেছেন। আর রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহ্‌র ই হাতে ন্যাস্ত। শুধু মানুষ নয়, বরং সব প্রাণীর রিযিকের দায়িত্ব ই আল্লাহ্‌র হাতে ন্যাস্ত। সুতরাং “বিয়া কইরা বউরে খাওয়াবি কি” টাইপের কথা কুরানের এই আয়াতের স্পষ্ট বিরোধী। পৃথিবীর কোন মানুষ ই আসলে কর্মহীন নয়। আল্লাহ্‌ হয়ত কাউকে অঢেল রিযিক দেন আর কাউকে বা মাপা মাপা রিযিক দেন। তাই বলে যার রিযিক পরিমিত, তিনি কি বিয়ে করবেন না? আল্লাহ্‌ তো নিজে বলেছেন, “হে নবী! তাদেরকে বলো, আমার রব তার বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে চান মুক্ত হস্তে রিযিক দান করেন এবং যাকে চান মাপাজোপা দেন। যা কিছু তোমরা ব্যয় করে দাও তার জায়গায় তিনি তোমাদের আরো দেন, তিনি সব রিযিকদাতার চেয়ে ভাল রিযিকদাতা”- (সা'বা:৩৯) আল্লাহ্‌ এখানেও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, “তিনি সব রিযিকদাতার চেয়ে ভালো রিযিকদাতা”। তাহলে প্রিয় ভাই ও বোনেরা কি বুঝলেন ? আল্লাহ্‌ সবার রিযিক ই ঠিক করে রেখেছেন। আসুন আরেকটি আয়াতের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক, যেখানে আল্লাহ্‌ বিয়েকে রিযিকের মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আশা করি এই আয়াতের মাধ্যমেই সবার সব দ্বিধা দূর হয়ে যাবে ইন-শা-আল্লাহ। আল্লাহ্‌ বলছেন, “আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিত নারী-পুরুষ এবং সৎ কর্মশীল দাস-দাসীদের বিয়ে দাও। তারা অভাবী হলে আল্লাহ্‌ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন। আল্লাহ্‌ প্রাচুর্যময় ও মহাজ্ঞানী”- সুরা নুর- আয়াত ৩২ উক্ত আয়াতে আল্লাহ্‌ বিয়ের মাধ্যমে অভাব দূর করে সচ্ছলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই আয়াতের আলোকে প্রখ্যাত সাহাবী, সমগ্র মুসলিম জাহানের খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেন, “ওই লোকের ব্যাপার খুবই বিস্ময়কর, যে বিয়ের মধ্যে প্রাচুর্য খোঁজেনা। কারণ আল্লাহ্‌ নিজে বলেছেন, ‘তারা অভাবী হলে আল্লাহ্‌ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাব মুক্ত করে দিবেন”; তাছাড়া উক্ত আয়াতের শেষে আল্লাহ্‌ বলেছেন, “আল্লাহ্‌ প্রাচুর্যময় ও মহাজ্ঞানী”;এর মাধ্যমে এও বুঝা যায়, মানুষের জ্ঞানে এ কথা নাও বিশ্বাস হতে পারে যে বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ রিযিক দিতে পারেন। তাই তিনি মানুষকে আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, “আল্লাহ্‌ প্রাচুর্যময় আর মহাজ্ঞানী” যে ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রের বিয়ে মা-বাবা রিযিকের দোহাই দিয়ে আটকে দেন, এমনও তো হতে পারে যে, বিয়ের পরই ছেলে একটা পার্ট-টাইম চাকরি পেয়ে গেলো। পরাশুনার পাশাপাশি চাকরিও করলো। এমন অনেকেই করছেন ইদানিং। কারণ আল্লাহ্‌ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, “তারা অভাবী হলে আল্লাহ্‌ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাব দূর করে দিবেন” তবে সব কিছু বুঝে শুনে কেন সমাজে বিয়ে নিয়ে এত টালবাহানা? এর কারণ বিয়ের মাত্রাতিরিক্ত খরচের চাপ। আসুন এবার এ নিয়ে একটু বলা যাক। বেশির ভাগ মেয়ের মা-বাবা ই ইদানিং ভালো পাত্র বলতে বুঝেন উচ্চ-শিক্ষিত আর টাকাওয়ালা। ইমান একটা নগণ্য বিষয় যা তাদের দৃষ্টিতে কোন যোগ্যতা নয়। নিজের মেয়েকে ওই ছেলের হাতেই তুলে দিবেন, যার কাড়ি কাড়ি টাকা আছে, ঢাকায় নিজের বাড়ি আছে বা ফ্ল্যাট আছে। ভাড়া বাসায় নিজের মেয়েকে তুলে দিবো তাই কি হয়? ইসলামের সাথে এসব বিষয়ের কোন বিরোধ নেই যদিনা এগুলা মুখ্য বিষয় হয়ে না উঠে। যে ছেলে আজ গ্রেজুয়েশন করছে, সে ছেলে পড়া শেষ করে নিশ্চয় একটা চাকরি ঠিকই ম্যানেজ করবে। কারণ মানুষ বেঁচে থাকলে তার রিযিক আসবেই। এতে কোন সন্দেহ নেই। মেয়ের অভিভাবক বা মেয়ে নিজে যদি আল্লাহ্‌ আর পরকালে বিশ্বাস রাখে, তবে অবশ্যই বিয়ের ব্যাপারে তাদের ঈমানকেই প্রাধান্য দিতে হবে। তা না হলে জীবনে অশান্তি অনিবার্য। এ ব্যাপারে একটা ঘটনা উল্লেখ করছি। মুবারাক আবু আব্দুল্লাহ তার মনিবের ফল বাগানে দাস হিসেবে কাজ করতেন। মনিবের এক সুন্দরী কন্যা ছিল। তিনি একদিন আব্দুল্লাহ কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আবদুল্লাহ, আমার কন্যাকে কেমন পাত্রের কাছে বিয়ে দেয়া উচিত?’ আবদুল্লাহ উত্তর দিলেন, ‘জাহিলিয়াতের যুগের লোকেরা বংশ আর মান দেখে বিয়ে দিত, ইহুদিরা বিয়ে দেয় ধন-সম্পদ দেখে, খ্রিষ্টানরা বিয়ে দেয় রুপ দেখে, আর মুহাম্মাদ (সা) এর উম্মতের বিয়ে হয় দ্বীন দেখে’ এমন জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য শুনে সেই মনিব তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচিত ইমানদার বান্দা আবদুল্লাহর সাথে নিজ কন্যার বিয়ে দিলেন। আর সেই ঘরে জন্ম নিলেন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, “আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক” কন্যার পিতাদের উচিত ঈমান দেখে বিয়ে দেয়া। পাত্রের ঈমান আর চরিত্র দেখে বিয়ে দেয়া উচিত। অবশেষে, অভিভাবকদের জন্য একখানা হাদীস দিয়ে লেখাটি শেষ করবো। আবু সঈদ খুদরি রা: ও ইবনু আব্বাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যার কোনো সন্তান জন্মলাভ করে সে যেন তার সুন্দর নাম রাখে এবং তাকে উত্তম আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়। যখন সে বালেগ হয় তখন যেন তার বিবাহ দেয়। যদি সে বালেগ হয় এবং তার বিবাহ না দেয় তাহলে সে কোনো পাপ করলে, সে পাপ তার পিতার ওপর বর্তাবে।’ [বায়হাকি, মিশকাত হা-৩১৩৮] সুতরাং, উক্ত হাদীস থেকে বুঝা গেল যে, সন্তানের বিয়ের ব্যাপারে মা-বাবা দায়িত্বশীল। তাদের উচিত শরিয়ত মেনে কম খরচের ভিতর ছেলের বিয়ের ব্যাবস্থা করা। কারণ, রাসুল (সা) বলেছেন, “যে বিবাহে খরচা কম হয়, তাই বেশি বরকতপূর্ণ হয়” (শুআবুল ঈমান, বায়হাকি, হাদীস: ৬৫৬৬) ইসলাম বিয়েকে সহজ করেছে, খরচকে কমিয়ে এনেছে। কিন্তু আমরাই নিজেদের উপর নিজেরা বোঝা চাপিয়ে নিয়েছি। বরকত কে বিতাড়িত করেছি জীবন থেকে। বিয়ের মত পবিত্র জীবনের সুচনা হয় শয়তানের পূজা “অপচয়” এর মাধ্যমে। আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে নষ্ট সমাজের উপরে ইসলাম কে প্রাধান্য দেবার তাওফিক দিন। আমীন!!!

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ
আমার ডিভাইস ভাবনা

আমার ডিভাইস ভাবনা

২২ জানুয়ারী ২০২৪

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

২৮ ডিসেম্বার ২০২৩

আমার বাচ্চা খায় না!!????

আমার বাচ্চা খায় না!!????

২৪ ডিসেম্বার ২০২৩

আক্রমনাত্মক দাওয়াহ!!!

আক্রমনাত্মক দাওয়াহ!!!

১৩ ডিসেম্বার ২০২৩