
আমরা অনেক সময় মানুষকে বিচার করি আমাদের নিজেদের “অবসারভেশন” থেকে। আপনি যেভাবে দেখছেন একটি লোককে, সে লোকটিকে আপনি ঠিক সেভাবেই জাজ করছেন। ইসলামের একটি মূলনীতি হলো কাফির ব্যাক্তি যত ভালোই হোক সে শিরক এর মত ভয়াবহ গুনাহে লিপ্ত হবার কারণে আল্লাহ্র কাছে শাস্তির যোগ্য। আর একজন ঈমানদার লোক যতই অন্যায় করুক না কেন, শিরক এ লিপ্ত না হলে আল্লাহ্ চাইলে তাঁকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। অর্থাৎ তার কোন ভালো কাজের দরুন সে ক্ষমার যোগ্য হতেও পারে। আর একথা আমরা সকলেই জানি শিরক করাটা যেমন ভয়াবহ অন্যায়, তেমনি শিরক না করাটা একটা বড় ধরণের ভালো কাজ। যা তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য যথেষ্ট হতে পারে। সুতরাং এ কথা স্পষ্ট যে, একজন গুনাহগার মুমিন ব্যাক্তিও আপনার মুসলিম ভাই। তাঁকে মুসলিম হিসেবে আপনি যতটুকু সম্মান পাওয়া উচিৎ তা দিতে হবে। তার মান সম্মান রক্ষা করে চলতে হবে এবং দেশ ও জাতির ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলে তাঁর দোষও গোপন রাখতে হবে। আর অবশ্যই তার সাথে সালাম ও মুসাফাহা জারি রাখতে হবে। তাঁকে সংশোধনের জন্য দাওয়া দিতে হবে। ইসলামি বিশেষজ্ঞদের মজলিসে বসাতে হবে এবং তাঁর জন্য ইসলাম কে জানার ব্যাবস্থা করে দিতে হবে। হয়ত আল্লাহ্ তাঁকে ফিরিয়ে আনবেন। এতটুকু মুসলিম হিসেবে আমাদের করণীয় আমাদের ভাইদের জন্য। তাঁকে জাজ করে কিংবা তা গীবত করে কিংবা তাঁর দোষ চর্চা করে তাঁকে সমাজে আরো নিচু অবস্থানে পৌঁছে দেয়া একটা বাড়তি গুনাহ যা আমরা শখ করে আমাদের ঘাড়ে নিচ্ছি। আসলে আমরা একজন মানুষকে যা ভাবি তিনি সেরকম নাও হতে পারে আর সে কাজ করার দায়িত্বও ইসলাম আমাদের দেয়না। আল্লাহ্ সুরা হিজরের ৮৮ নং আয়াতে বলেন, “বিশ্বাসীদের জন্য তুমি তোমার বাহু অবনমিত রাখ”। আমরা জানি যে, রাসুল (সা) কোন অঞ্চলে যুদ্ধের জন্য সাহাবীদের পাঠালে বলে দিতেন যেন তাঁরা আগে কান পেতে শুনে আযানের শব্দ পায় কিনা, যদি তা পায় তবে যেন আক্রমন না করে। মুসলিমদের জান মাল এতটাই গুরুত্ববহ।
একটি হাদীসে আছে, ইবনে উমার (রা) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা) বলেছেন, “মুসলিম মুসলিমের ভাই, সে তার উপর অত্যাচার করবেনা এবং তাকে অত্যাচারীর হাতে ছেড়ে দিবেনা। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ্ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে ব্যক্তি কোন এক মুসলিমের বিপদ দূর করে দিবে , আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন তার বহু বিপদের একটি দূর করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষত্রুটি গোপন রাখবে, আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন” - বুখারী,মুসলিম,তিরমিজী,নাসাঈ,আহমাদ
অপর এক হাদীসে, আবু হুরায়রা (রা) থকে বর্ণিত, রাসুল (সা) বলেছেন, “মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার বিশ্বাসঘাতকতা করবেনা, তাকে মিথ্যা বলবেনা (বা মিথ্যাবাদী ভাববে না)। তার সাহায্য না করে তাকে অসহায় ছেড়ে দিবেনা। এক মুসলিমের মর্যাদা, মাল ও রক্ত অপর মুসলিমের জন্য হারাম। আল্লাহ্ভীতি এখানে (অন্তরে) রয়েছে। কোন মুসলমান ভাইকে তুচ্ছ মনে করাটাই একটি মানুষের মন্দ হবার জন্য যথেষ্ট” - মুসলিম, তিরমিজি
তাই কাউকে ভালো মন্দ বিচার করার আগে আমাদের রাসুল (সা) এর কথাগুলো মাথায় রাখা উচিৎ। গুনাহগার মুসলিমদেরও হাদীসে “মুসলিম ভাই” হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। আল্লাহু আকবর!! কি সুন্দর ইসলামের বক্তব্য। আল্লাহ্ এমন এক দ্বীনের উত্তরাধিকারী আমাদের বানিয়েছেন এ আমাদের সৌভাগ্য। আলহামদুলিল্লাহ!! হাদীসটি হলো, রাসুল (সা) বলেছেন, “তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে অত্যাচারি হোক বা অত্যাচারীত” – বুখারী, তিরমিজি, আহমাদ
অত্যাচারী মুসলিমকেও হাদীসে “মুসলিম ভাই” সম্বোধন করা হয়েছে। তাহলে আমাদের যেসব ভাই ইসলামের দাওয়াত পায়নি, ইসলাম সম্পর্কে জানেনা কিংবা জানার সুযোগ পায়নি, তাদের আমরা এত সহজেই বিচার করে ফেলছি? অথচ আমরা তাদের কাছে দাওয়া পৌঁছাইনি!!
মুসলিম মুসলিমের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করবেনা। যদিও তার মধ্যে মন্দ কিছু থাকে। মন্দ ধারণা খুব ই খারাপ একটা ব্যাপার কারো ব্যপারে মন্দ ধারণা পোষণ করে কোনদিন কল্যাণ আসতে পারেনা। আপনি কারো মন্দ দেখলেও তাকে নিয়ে মন্দ ধারণা করতে পারবেন না। কারণ শয়তান মানুষকে সব সময় ধোকা দেবার চেষ্টা করে। আপনার কোন ভাইয়ের মন্দ আপনার চোখে ধরা পড়লে আপনি তা গোপন রাখবেন এবং ভাববেন যে ভুল ক্রমে হয়ে গেছে। তবুও তার প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা যাবেনা। এ ব্যাপারে হাদীসের ভাষ্য কি তা জানা যাক।
ইয়াহ্ইয়া ইবনু বুকায়ব (রহঃ) হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত-“তোমরা কারো প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করো না। কেননা, খারাপ ধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। একে অপরের ছিদ্রান্বেষণ করো না, একে অন্যের ব্যাপারে মন্দ কথায় কান দিও না এবং একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুতা রোখো না’ বরং পরস্পর ভাই হয়ে যাও। এক মুসলিম ভাইয়ের প্রস্তাবিত মহিলার কাছে শাদীর প্রস্তাব করো না; বরং ঐ পর্যন্ত অপেক্ষা কর, যতক্ষণ না সে তাকে শাদী করে অথবা বাদ দেয়” – সহীহ বুখারী ৪৭৬৭
আসুন আরেকটি হাদীস দেখি এ ব্যাপারে
ইবন আবী উমার (রহঃ) আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহ থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা কু'ধারণা (মন্দ / খারাপ ধারনা) পোষণ করা থেকে বেঁচে থাকবে, কেননা, কু'ধারণা করা হল সবচে মিথ্যা কথা” - হাদীসটি হাসান-সহীহ – তিরমিজি ১৯৯৪
সহীহ মুসলিমের একটি হাদীসে এসেছে, আবূ রাবী- আয যাহরানী এবং খালফ ইবনু হিশাম (রহঃ) আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ননা করেন যে, তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেনঃ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। আমি আবার প্রশ্ন করলামঃ কোন ধরনের গোলাম আযাদ করা উত্তম? তিনি বললেনঃ সে গোলাম আযাদ করা উত্তম, যে মুনীবের কাছে অধিক প্রিয় এবং অধিক মূল্যবান’ -আমি আরয-করলাম আমি যদি তা করতে না পারি? তিনি বললেনঃ তা হলে অন্যের কর্মে সাহায্য করবে অথবা কর্মহীনের কাজ করে দেবে। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! যদি আমি এমন কোন কাজ করতে অক্ষম হই? তিনি বললেন?, তোমার মন্দ আচরণ থেকে লোকদের মুক্ত রাখবে, এ হল তোমার পক্ষ থেকে তোমার প্রতি সা’দকা”
সুতরাং ‘মন্দ ধারণা পোষণ করা থেকে বিরত থাকা’, ‘অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ থেকে দূরে থাকা’, ‘অন্যের প্রতি হিংসা থেকে দূরে থাকা’ – এগুলো সবই ইসলামি শিষ্টাচারের একটি অনন্য বৈশিষ্ট।
আল্লাহ্ আমাদের এমন অন্যায় গুলো থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দিন এবং ইসলামি শিষ্টাচার বুঝার এবং মানার তাওফিক দিন!! আমীন!!
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)