সাহিত্য

রসিক বাঙ্গালি

রসিক বাঙ্গালি
বাঙ্গালির একটা গুণ নিয়ে আমি একেবারে সন্দেহমুক্ত। সেটা হল 'সেন্স অব হিউমার'। ইউরোপের লোকেদের থেকে আমাদের এভারেজ 'সেন্স অব হিউমার' ভাল এটা আমি প্রায় নিশ্চিত। আমেরিকান' রা হয়ত একটু এগিয়ে থাকতে পারে। সৈয়দ মুজতবা আলি লিখেছিলেন তিনি ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান,জার্মান (এবং সম্ভবত ইংরেজি) সাহিত্য পড়ে তার কাছে মনে হয়েছে সুকুমার রায়ের মত ভাল সেন্স অব হিউমার অল্প লেখকেরই আছে। ভদ্রলোকের নিজের সেন্স অব হিউমারও খুব ভাল ছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার লেখা 'চিনি গো চিনি তোমারে' এই গানটা মিষ্টি এই মন্তব্যের উত্তরে বলেছিলেন- চিনি নিয়ে লেখা গান ত মিষ্টিই হবে। বাঙ্গালির সেন্স অব হিউমার এর মোটামুটি একটা ভাল চিত্রায়ন করেছেন হুমায়ুন আহমেদ। হুমায়ুন আহমেদ তার বইতে যেগুলো লিখেছেন সেগুলো একটু আজব ধরনের চরিত্র এবং বইয়ে মশলা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবে বাস্তবে এরকম লোক আসলেই আছে। আমার এক্স কলিগ মিজান ভাই একবার এক লিচু বিক্রেতা বললেন, " ২৫ টা লিচুর দাম কত ?"। লিচু বিক্রেতা গম্ভীর মুখে বললেন- "২৫ টা লিচু বেচি না"। মিজান ভাই তার পিঠে হাত দিয়ে বললেন - " ভাই আমি মাদ্রাসার ছাত্র । ২৫ টা লিচু বেচলে গুনাহ হবে না। আল্লাহ ভরসা। দেন।" বিক্রেতা পুরাই হতবাক। এরপর সে লোক যতই বলুক মিজান ভাইয়ের এক কথা " ভাই দেন আল্লাহ ভরসা, গুনাহ হবে না "। অগত্যা ভদ্রলোক লিচু বেচতে রাজি হলেন। মিজান ভাইয়ের কাছে প্রতিদিন নিত্য নতুন আজগুবি কথা শুনতাম। ভাল লাগত। আমি সিরিয়াস কনভারসেশনে বলতে শুনেছি- একজন বলছে " তোকে জুতা দিয়ে পিটানো দরকার"। উত্তরে আরেকজন বলছে- " জুতার ব্র্যন্ড কি ? দাম কত ? জুতাটা পরিষ্কার ত ?"। কয়েকদিন আগে আমার আম্মু আমাকে সিরিয়াস ভাবে বললেন-" তবে রে ! দুই দিন ধরে ফোন দেস না কেন ? ধোয়া জুতা দিয়ে তোকে পিটানো দরকার" । রসিক বাঙ্গালীদের মধ্যে একজন হুজুর একবার স্বপ্নে দেখলেন আজকের দিনে বাঁশের পানি খেলে রোগ ভাল হবে। এর মানে হল বাঁশে দা দিয়ে কোপ দিলে কিছুটা পানি বেরিয়ে আসে, সে পানি খেতে হবে। আমাদের বাড়িতে ইমন কাকাদের বাঁশ ঝাড়ে লোকজন মোটামুটি কয়েকশ কোপ দিল। ভাবটা এমন অন্যের বাঁশ ঝাড় থেকে কোপ দিয়ে বাঁশের পানি নিলে কোন সমস্যা নাই কারণ স্বয়ং হুজুর স্বপ্ন দেখেছেন। জনৈক মুরব্বি আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন বাঁশের পানি আমারও খাওয়া উচিত এবং এই হুজুর হলেন গরম হুজুর। উনার স্বপ্ন অবশ্যই ফলবে। আমি বললাম- " হুজুর যদি আগামী কাল স্বপ্ন দেখে আমাকে জানান যে আপনার ঘর পুড়িয়ে সে ছাই দিয়ে দাঁত মাজলে আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হব তাহলে কি আপনার অনুমতি ছাড়া আমার উচিত আপনার ঘরে আগুন দেয়া ? আপনি যে মালিকের অনুমতি ছাড়া বাঁশ ঝাড়ে কোপ দিয়ে অন্যের বাঁশ নষ্ট করছেন ?" । তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন এরকম আজগুবি কথা জীবনে শুনেন নি। আমার চাচা সিলেট থেকে ফোন দিয়ে জানালেন তিনিও বাঁশের পানি খেয়েছেন। আমি যে খেতে পারলাম না এর জন্য কিছুটা আফসোস করলেন। ভাতিজার রোগমুক্তি ত আসলেই চাচার কাম্য। অতএব, তিনি এই গুরুদায়িত্ব পালন করেলেন। কয়েকদিন আগে আমি ফেসবুকে গাজার একটি শিশু একটু ধ্বংসস্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে খেলছে এরকম একটি ছবি আমি পোস্ট করেছিলাম। কয়েকজন রসিক মানুষ এই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে বেলুনের উৎস কি, এর ভেতরে কি গ্যাস না বাতাস এরকম কিছু ক্রিয়েটিভ প্রশ্ন করলেন। ভাগ্য ভাল যে এর ভেতরে হিলিয়াম গ্যস আছে কিনা, হিলিয়াম এর প্রস্তুত প্রণালী এবং ব্যবহার, প্রাচীনকাল থেকে প্যরাসুটের বদলে বেলুনের ব্যবহার নিয়ে কেউ আলোচনা করেন নি। অনন্ত জলিলকে নিয়ে যেসব রসিকতা আছে যেমন ১। সিনেমার পোস্টার নিয়ে " বউ বড় না মা বড় ?- অবশ্যই মা বড় কারণ মায়ের বয়স বেশী"। ২। ডাচ প্লেয়ার ফন পার্সিকে নিয়ে- " বালক তোমার নাম কি ?- পার্সি। পারছ যে সেটা আমিও দেখছি এখন নাম বল। ৩। লিওনেল মেসিকে নিয়ে- " তোমার নাম কি ?- মেসি। দেখলে ত ভাল মনে হয়"। এগুলো রসিক বাঙ্গালির হালের পারফরম্যন্স । জলিল কে নিয়ে "পম গানা" হতে শুরু করে সব বিষয়ে লোকেরা যেভাবে ট্রল বের করছে এক সময়ে অনন্ত জলিল " শেষ্ঠকালের শরন দুলাই" কিংবদন্তী হতেই পারেন । এছাড়া শাইখ সিরাজ এবং এক কৃষককে নিয়ে ছাগলের যে কাল্পনিক গল্প ফেসবুকে এসেছে সেটাও আন্তর্জাতিক মানের। ফেসবুকে লেখার নিচে ফটো কমেন্ট একটা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। রসিক বাঙ্গালির সর্বশেষ সমস্যা হল স্বাস্থ্য সচেতনতা। ন্যন্সি ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরতে চেয়েছেন। এতগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েও তিনি যেহেতু মরতে পারেন নি তাই এই ওষুধের মধ্যে যে ভেজাল আছে সেটা নিয়ে অনেকেই সবিশেষ চিন্তিত। অর্থাৎ কথাটা দাঁড়াচ্ছে এমন- ন্যান্সি যদি মরত আমরা ত অন্তত ওষুধের মান নিয়ে নিশ্চিত থাকতাম। ওষুধ নিয়ে এই আলোচনাটা ঠিক আছে তবে এখনই কেন করতে হবে সেটা বিস্ময়ের। তবে রসিক বাঙ্গালির কাছে ছাড় নাই। শেষ গল্প বলি। আমাদের বন্ধু সা'দ থেকে শোনা, গল্পটার ডিটেলস ভুলে গেছি। মূল কথাটা এরকম যে সে দিন সে ঢাকার এক বাসে উঠেছিল। সেখানে এক লোক (কন্ডাকটার হতে পারে) কোন এক ভদ্র মহিলার সাথে কিছু একটা করেছিলেন আমার মনে নেই । উত্তরে ভদ্র মহিলা বলেছিলেন- " কি মহিলা মানুষ দেখলে কুরকুর করে ?" পুরা বাসের লোক হেসে নাকি গড়াগড়ি খেয়েছিল। বাঙালি রসিক জাতি। রসিকতা করতে না পারলে তার মনটা কুরকুর করে।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)