সাহিত্য

ফিলিস্তিনের জন্য ভালবাসা

ফিলিস্তিনের জন্য ভালবাসা
একজন ভাইয়ের সাথে কিছু দিন আগে আলাপ হচ্ছিল। তিনি বিদেশে থাকেন। তারা পাঠানো টাকা দিয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে বিল্ডিং তৈরি করা হচ্ছে। তিনি গতবার যখন বেশ কয়েক বছর পর দেশে গেলেন তার বাবা তাকে বললেন- "এই মাটির ঘর আমার বাবার ঘর। আমি এর প্রতি টান অনুভব করি।এটা আমার কাছে এই দালানের চেয়েও বেশী প্রিয় "। তিনি তার বাবাকে খুশি করতে নিজের সব ব্যাগ সহ আগের সেই পুরোনো ঘরে উঠলেন। তার বাবা খুশি হলেন।   আমাদের বাড়িতে আছে একটা মাটির ঘর। প্ল্যান হল এটা ভেঙ্গে একটা নতুন ঘর তৈরি করা। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় সম্ভব হলে এই ঘরটা রেখে দিতাম। এ ঘরে ছোট বেলা থেকে বড় হয়েছি আমি। এটাই আমার বাবা বা তার বাবার তৈরি ঘর। এতে কয়েক জেনারেশনের অস্তিত্ব আছে। এটা ভেঙ্গে ফেললে যেন কয়েক পুরুষের অস্তিত্ব মুছে যাবে এক নিমিষে।   এই যে আমাদের একটা মাটির ঘর বা সে ভাইয়ের বাবার তৈরি ঘর সে ঘরের একটা ইমোশনাল আবেদন আছে, যেটা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আমার কাছে অনেকবার মনে হয় আমি যত বছরই বিদেশে থাকি এটা আমার দেশ না, এ দেশের গাছ-পাখি, ফুল কোন কিছু আমার না। টিউলিপ গার্ডেন সুন্দর তবে নিজের না। এর চেয়ে বিলে ফোটা শাপলা ফুল নিজের। কোন সুন্দর নীল পানির হ্রদ দেখতে ভাল কিন্ত বড় দিঘীর একটা আবেদন আছে। নিজের হওয়ার আবেদন। অনেক সুউচ্চ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে হয়ত জ্যোৎস্না দেখা সম্ভব তবে পুকুর পাড়ে বসে চাঁদ দেখার মজা আলাদা। একটা নিজের আরেকটা অন্যের এটাই একটা বিরাট পার্থক্য। বিদেশে আসার পর অযতই সুন্দর জিনিস দেখি না কেন এরপর বাংলাদেশের একটা সুন্দর রাস্তা দেখলে নস্টালজিক হয়ে যাই, মায়া লাগে।     এই নিজের জিনিসের প্রতি মানুষের মায়া চিরন্তন। নবীজি নির্যাতিত হয়েও মক্কা ছেড়ে যাওয়ার সময় বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিলেন।    এই নিজের জিনিসের প্রতি মায়ার কারণে গাজার সামান্য এলাকা ছেড়ে যায় না ১.৮ মিলিয়ন লোক। ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের 'পরিচয়পত্র' কবিতা লিখতে গিয়ে তার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে সেটা বুঝতে হলে এই অনুভূতিটাকে মাথায় রেখে পড়তে হবে। "লিখে রাখো আমি একজন আরব আমার একটি নাম আছে পদবিবিহীন যেদেশে লোকেরা ক্ষুব্ধ সেই দেশে আমি এক সহিষ্ণু মানুষ আমার শেকড়গুলি হয়েছে প্রোথিত সময়েরও জন্মের আগে,আর যখন হয়নি কোনো যুগের সূচনা পাইন আর জলপাই তরুদের আগে আর ঘাসের জন্মেরও ঢের আগে আমার পিতা.. লাঙ্গলের উত্তরাধিকার বইছেন তিনি সুবিধাভোগীদের প্রতিভূ নন তিনি এবং পিতামহ আমার.. ছিলেন কৃষক এক ছিলেন না ধনবান অথবা কুলীন পড়তে শেখানোর আগে তিনি সূর্যের গৌরব দীক্ষা আমায় দিলেন আর, ডালপালা বেতে গড়া আমার বাড়িটি যেন পর্নকুটির কোনো এক পাহারাদারের এ-আমার পরিচয়ে তোমরা কি তৃপ্ত? আমার রয়েছে একটি নাম পদবিহীন! লিখে রাখো আমি একজন আরব তোমরা চুরি করেছো আমার পূর্বপুরুষের ফলকুঞ্জ আর সেই ভূমিকে যা আমি কর্ষণ করেছি আমার সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে আর তোমরা আমাদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখোনি শুধু এই পাথরগুলো ছাড়া"।   হাজার হাজার ফিলিস্তিনের মানুষ বিনা বিচারে ইসরাইলের জেলে সময় কাটাচ্ছে। হয়ত কোন এক তরুণ বন্দি তার মাকে শেষ বারের মত দেখতে পারার যে আকুতি সেটা দারবিশ লিখতে চেষ্টা করেছেন-   "আমার মায়ের হাতে বানানো রুটির জন্য মন কাঁদে আমার মায়ের হাতে বানানো কফির জন্য তার স্পর্শের জন্য মনে আমার জেগে ওঠে ছেলেবেলার স্মৃতি দিনের পর দিন যখন আমার মৃত্যু হবে সে মুহূর্তে নিজের জীবনের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে আমাকে আমার মায়ের চোখের জলের যোগ্য আর যদি আমি ফিরে আসি একদিন আমাকে গ্রহণ কোরো তোমার চোখের পাতার আচ্ছাদন হিসেবে "   আজকে সেহরি খাওয়ার পর আমাদের ফিলিস্তনের বন্ধু সাইফের সাথে ফেসবুকে চ্যাট হচ্ছিলে। সে আমাকে একটা ৫১ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপ পাঠাল যাতে আমি বুঝতে পারি অবস্থা কতটা ভয়াবহ। তীব্র গুলাগুলি আর বিস্ফোরণের সে শব্দ আমি শুনলাম, খুব খারাপ লাগল। ইচ্ছে করছিল তাকে সাথে সাথে বলি তুমি চলে আস। সাহস হল না শেষ পর্যন্ত। কেন সে তার নিজের পূর্ব পুরুষের ভিটে ছেড়ে আসতে চাইবে ?   ফিলিস্তিন ত কেবল একটা ভূখণ্ড না, গৃহহারা সে মানুষগুলোর জন্য পৃথিবীর বুকে এক টুকরা জান্নাত। এক সময়ের বাগান আর সবুজ গাছগাছালিতে ভরা সে জায়গায় ফিরতে চায় প্রতিটি গৃহহারা মানুষ। সে তার শেষ নিঃশ্বাস নিতে চায় নিজের সে মাটির ঘরে যেটি তৈরি করেছিল তার পূর্ব পুরুষদের একজন ।তার শারীরিক সত্ত্বা সেখানে যেতে পারে না ঠিকই কিন্ত হয়ত তার মন পড়ে থাকে সে এক একটা বাগানে আর গাছে। সে মনে মনে ফুলের সৌরভ নেয় ঠিক যতক্ষণ বেঁচে থাকে।   হয়ত কোন একজন বৃদ্ধ বাবা তার তরুণ ছেলেকে পড়ে শুনাতে চান- " My soul is racing ahead of me. It says, The body is too slow for me - I am going. The smell of apples a rises from the orchard of my soul. One whiff and I am gone - Toward a feast of apples I am going. A sudden wind won’t blow me over. Toward Him, like a mountain of iron, I am going. My shirt is ripped open with the pain of loss. Searching for a new life, with my head held high, I am going." ( The Body is Too Slow for Me, By Rumi)   কিংবা- "বুড়ো হ‘য়ে গেছি আমি ছেলেবেলার তারার মানচিত্রখানি আমাকে ফিরিয়ে দাও তুমি যেন আমি আবাবিল পাখিদের সঙ্গে আবারও রওয়ানা দিতে পারি তোমার অপেক্ষমান নীড়ের পথে" ।   আমার এই ক্ষুদ্র অনুভূতি হয়ত ফিলিস্তিনের মানুষের কাছে পৌঁছাবে না তবে মানুষ হিসেবে এ অনুভূতি লিখে রাখাটাও একটা দায়িত্ব মনে করছি।   উৎসর্গঃ আমাদের ফিলিস্তিনের বন্ধু সাইফ আর সব গৃহহারা উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনের মানুষকে। (এ লেখাটা ইংরে জিতে অনুবাদ করতে পারলে সাইফকে দেয়া যেত। সাইফ বেঁচে থাকলে আর আমি একটু সময় পেলে ভবিষ্যতে অনুবাদ করার ইচ্ছা আছে ইনশাআল্লাহ)।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন