সাহিত্য

রক্তভেজা গাজা

রক্তভেজা গাজা
খালিদ যে আফিফা কে একেবারেই মনে করেনা, ব্যাপারটা তেমন নয়। আবার আফিফা ও যে খালিদকে কম ভালোবাসে তাও নয়। কিন্তু, খালিদ যখন চাকরীর জন্য মিশরে যেতে চাইলো, আফিফার অনড় সিদ্ধান্ত ছিল মাতৃভূমি গাজা ছেড়ে কোথাও যাবে না।  কেন জানি, মাতৃভূমির আলো বাতাস আফিফার খুবই প্রিয়।যদিও দানবদের ঘায়ে প্রায়ই ক্ষত বিক্ষত হয়, তাও প্রিয় এখানের সব কিছুই। খালিদ প্রায়ই আফিফা আর ছেলে জুহাইরকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে অবশ্য। কিন্তু তেমন কোন লাভ হয় না। খালিদ বলে- আফিফা দেখো! গাজার ৯০ ভাগ পানি দূষিত! এখানে থাকলে তোমার শরীর কয়দিন পরপরই অসুস্থ হয়ে যাবে। আফিফা স্নিগ্ধ হেসে বলে- দেখো! আল্লাহ কারো সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপান না। খালিদ আফিফার এই কথার কাছে পরাস্ত হয়। আফিফা নিজের যুক্তিতে অবশ্য ঠিক। আফিফা অন্যান্য মেয়েদের মতো খালিদের উপর স্ত্রীর অধিকার খাটিয়ে কাজের ব্যস্ততায় ব্যস্ত থাকার জন্য কখনোই অনুযোগ করেনা। মাতৃভূমির জন্য এতোটুকু অনুযোগের অভ্যাস সে ত্যাগ করেছে। তাই খালিদের ও উপায় নেই আফিফাকে মিশরে যাওয়ার জন্য জোর করার। আফিফা বলেই দিয়েছে- তুমি ছুটি পেলে আমাদের সাথে এসে থেকো কিছুদিন। এর উপর নিশ্চয়ই আর কোন কথা চলেনা। এবার রমজানে আফিফাকে চমক দিতে এক মাসের ছুটি নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার চিন্তা করলো খালিদ। রমজানের চাঁদ উঠেছে গাজার আকাশে। এমন সময় খালিদ বাড়িতে উপস্থিত। আফিফা খালিদের আচমকা বাড়িতে ফেরায় যারপরানই খুশী হোল। জুহাইর অনেকদিন পর বাবাকে পেয়ে এতদিনের না বলা কথা গড়গড় করে বলতে লাগলো। কোঁকড়া চুলের জুহাইরের অনর্গল কথা, টোল পড়া হাসি, সবই খালিদকে অভিভূত করে। - বাবা! জানো! স্কুলের মাঠে না সেদিন একটা ছোট বিড়াল দেখেছি! মিউ মিউ করছিলো কেন বাবা? - ও মনে হয় ওর মাকে খুঁজছিল - মা কে কেন খুঁজছিল ? - মনে হয় ক্ষুধা লেগেছিল! জুহাইর মাঝে মাঝে ভারি ধরনের কিছু দুষ্টুমি ও করে । খালিদকে টেনে খাট থেকে উঠিয়ে দাড় করিয়ে কাঠের তলওয়ার দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে। একসময় খালিদকে সন্তানের আনন্দের কথা ভেবে পরাস্ত হতে হয়। দিনগুলো ভালোই কাটছিল। হটাত গাজার আকাশে একদিন আতশবাজির দেখা পাওয়া যায়। এই আতশ আনন্দের নয়, আতংকের। ছোট্ট জুহাইর ও জানে, এগুলো হায়নাদের বোমারু বিমানের বোম। খালিদ আফিফাকে আসন্ন বিপদের কথা জানিয়ে বলে- তোমাকে কতো বললাম, চলো! মিশরে চলো! তুমি শুনলে না। দেখো, এই রমযান মাসেও এখানে ইহুদিরা হামলে পড়েছে। এবার তোমার কোন কথাই শুনবো না। তোমাকে নিয়েই যাবো আফিফা বলে- আল্লাহর উপর ভরসা করো খালিদ, আল্লাহ আমাদের উত্তম অভিভাবক। রাতে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে বোমার শব্দে তারা। খালিদ উদ্বিগ্ন মুখে কুনুতে নাজেলা পড়ে আকাশের দিকে দোয়ার হাত বাড়ায়। এখানে তাদের আকুতি শোনার মতো একজনই আছেন, একমাত্র আরশের অধিপতি। এভাবে বোমাবাজির মধ্যে কয়েকটি রমাজন অতিক্রান্ত হয় চরম আতংকে। একদিন বিকেলে আফিফা ইফতার সাজিয়ে অপেক্ষা করছে জুহাইরের জন্য। খালিদ ও বসে আছে। ছেলে বিকেলে খেলতে যেয়ে আর ফিরেনি। ইজরাইলি সেনারা যে কোন সময় এদিকে হামলা করতে পারে, খবর পেয়েছে। কিন্তু দুরন্ত জুহাইর বেশী দূরে যাবে না বলে বায়না করে বের হয়েছে। ১০ মিনিটের সময় আফিফা তাকে বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু ছেলেটা আধা ঘণ্টা হয়, কোন খবরই নেই। উৎকণ্ঠা বেড়ে গেলে আফিফা খালিদকে বলে- দেখো তো জুহাইর কই গেলো! ওকে নিয়ে আসো! বাড়ির আশেপাশেই পাবে। খালিদ বের হয় জুহাইরকে খুঁজতে। খালিদ বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর জুহাইর ঘরে ফিরে আসে। আফিফা বলল- তোমার বাবা তো তোমাকে খুঁজতে গিয়েছে, যাও বাবাকে ডেকে আনো। তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হবেন । বাড়ির পাশের রাস্তায় জুহাইরকে খুঁজছিল খালিদ। হটাত বোমার শব্দ হোল। হামলা শুরু হয়েছে ইহুদী সেনাদের। একটা বোম এসে পড়লো খালিদের গায়ে। সাথে সাথে গাজার মাটিতে লুটিয়ে পড়লো খালিদ। জুহাইর বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে বাবার ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে পেলো রাস্তায় পরে আছে। বাবা বলে চিৎকার করে সেই ক্ষত বিক্ষত লাশের গায়ে লুটিয়ে পড়ে জুহাইর। এই মুহূর্তে একটা ইজ্রাইলি ট্যাঙ্ক ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলো। এই দৃশ্য দেখে ইহুদী সেনারা আনন্দে হই হই করে উঠলো। একজন বলল- ঐ নালায়েক বাচ্চার উপর দিয়ে ট্যাঙ্ক চালিয়ে দেই চল, ওদেরকে একসাথে ওদের আল্লাহর কাছে পাঠিয়ে দেই! দেখি! ওদের আল্লাহ কি করতে পারে। এই বলে উল্লাস করতে করতে ট্যাঙ্ক চালিয়ে দিলো শুয়ে থাকা খালিদের উপর, যার বুকে আছড়ে পরে কান্না করছিলো শিশু জুহাইর। এরপর ২ টি দেহই নিথর পরে রইলো। বাহিরে গোলাগুলির আওয়াজ শুনেই বাপ ছেলে ঘরে ফিরছেনা দেখে আফিফা খুব অবাক হোল। পিতা পুত্র একজন আরেকজনকে খুঁজতে যেয়ে ২ জনই হাওয়া হয়ে গেলো নাকি! আফিফা বের হোল বাড়ির সামনে রাস্তায়। একি! রাস্তায় এতো রক্ত কেন! কিছুক্ষণ আগে ট্যাঙ্কের আওয়াজ শুনে আফিফা খুব চিন্তায় ছিল। পরে ভেবেছিল দূরে কোথাও হয়তো। আরেক টু সামনে যেয়ে আফিফা একদলা রক্ত মাখা মাংস পিণ্ড দেখতে পেলো। যাতে তার ছেলে জুহাইর আর খালিদের কাপড় দেখা যাচ্ছে। আফিফার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। বুঝে নিলো সে কি হারিয়েছে। এক ফোঁটা অশ্রু ও নেই তার চোখে। জুহাইর খালিদের রক্তভেজা গাজার এক মুঠো বালি হাতে নিয়ে আকাশের পানে চেয়ে আফিফা বলল- হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো! এদের অত্যাচারের! তুমি এদের বিচার করো। ( গল্পটি দৈনিক পত্রিকায় গাজায় সমসাময়িক ইজারাইলি অভিযানের একটি বাস্তব কাহিনী অবলম্বনে লেখা)

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)