সাহিত্য

জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে হাসি

জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে হাসি
  বাবা, দেখি তো! কাছে আয়! পাক ঘর থেকে ছেলেকে ডাকেন সাবিহা। ছেলেটা গোসল পাগল।  সুযোগ পেলেই বাথরুমে দৌড় দেয়।  এখন দুপুর বেলা। বড় সন্তান ৩ জন ই স্কুল কলেজ ভার্সিটিতে চলে গেছে।  এই বাবুটা না থাকলে সাবিহার কি একা একা লাগতো তাই ভাবেন আনমনে। বাবুর সাথে ভাই বোনদের বয়সের পার্থক্য অনেক । কিন্তু , সে সাবিহার অবসরের সাথি । সকালে সবাই বাসা থেকে চলে যায়। বাবুর স্কুল শেষ হলে পলি বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়। এরপর মা ছেলের বেশ জমে যায়, বাকি ছেলে মেয়ে গুলো সব সন্ধ্যায় বা বিকেলে ঘরে ফিরে। গোসল শেষ হলেই মা কেন বাবুকে ডাকে বাবু তা খুব ভালোই জানে। মায়ের অনেক গরম। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। বাবুর ঠাণ্ডা শরীর জড়িয়ে ধরে গা জুড়াতে চান তিনি। বাবু গামছা দিয়ে গা পেচিয়ে মায়ের কাছে যায়। মা বাবুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেন। আর গায়ে ঠাণ্ডা পরশ মাখেন। ছোট ছেলেটা একদম ধবধবে ফর্সা। অনেকে তাইওয়ানের বাচ্চাদের সাথে তুলনা করেন। ছেলের নানা রকম গুন আছে। অল্প বয়সেই আরবি পড়তে পারে খুব সুন্দর। গান ও গায়। যতো কবিতা আছে সব গুলোকেই গান বানিয়ে ফেলে সে। উল্টা পাল্টা গান। যে গানের কোন আগামাথা নেই। আবার মাঝে মাঝে মাকে খুশী করতেও গান গায়। - মায়ের মতো আপন কেহ নাই! ছেলের সাথে সময় গুলো বড় মধুর কাটে সাবিহার। দেওয়ালে একটা কবিতা লিখা আছে- জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে হাসি মা , তোমায় কতো ভালোবাসি..... এই কবিতা দেখে দেখে পড়ে শুনায় সাবিহা, আর বাবু দৌড়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরে মায়ের। এই যে! সাবিহার বুকের ভিতর ইদানিং জ্বালা পোড়া করে শুধু। শুধু ঠাণ্ডা আর বরফ খেতে মনে চায়, ছোট ছেলের সাথে যুক্তি করে ডীপে ট্যাং দিয়ে বানানো বরফের শরবত খাওয়া হয়। বাবু মা কে কতো টা ভালোবাসে এটা পরীক্ষা করার জন্য মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন - আমি যদি মরে যাই তুমি কার কাছে থাকবে? বাবুর চোখে পানি চলে আসে। ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দুনিয়া উদ্ধার করে। সাবিহা আবার বলেন- তুমি তোমার খালামনির কাছে থেকো। নানুর কাছে থেকো তাতেও বাবুর কান্না থামেনা।সে বলে -তুমি মরার কথা বলবে না আম্মু। সাবিহার ইদানিং শরীর ভালো না। শরীরে পানি চলে এসেছে। কাজ করতে পারে না, ছেলেকে নিয়ে পড়তে বসতে ও পারে না। এরমদ্ধেই একদিন ডাক্তার বলে যান - আপনার শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ। যতো তাড়াতাড়ি পারেন হসপিটালে ভর্তি হউন। একদিন চলেও আসে হসপিটালে যাবার সময়। মেয়ে ছেলে সংসার সব ফেলে সাবিহা হসপিটালে চলে যান। বাবুকেও বাসায় একা রেখে যান। বাবু যদিও যাওয়ার বায়না ধরে। অনেক তাল বাহানা করে, হসপিটালে ছোটদের যেতে হয়না, ডাক্তাররা ইঞ্জেকশন দিয়ে দিবে, এই সেই বুঝিয়ে ওকে নিরস্ত করা হয়। কিন্তু, হসপিটালে সাবিহার মন পোড়ে ছোট ছেলের জন্য। ডাইরিতে , প্রিয় বাবু লিখে আর কিছু লিখতে পারেন না। ভাবতেই কষ্ট লাগে, যদি এই যাত্রাই শেষ হয়! মৃত্যুপথযাত্রী কখনো নিজের আসন্ন মৃত্যুকে মেনে নিতে পারে না, এটাই স্বাভাবিক। তাহলে এই শিশুটির কি হবে? ডাইরিতে কয়েকটা সান্ত্বনা মূলক বাক্য লিখে কি ওর জীবন পার হয়ে যাবে!তাই, অপরাধ বোধে কিছুই লিখা হয়না বাবুকে নিয়ে। ৩ দিন পর বাবু তার বাবার সাথে হসপিটালে আসে। নানা রকম খেলনা দিয়ে সারাদিন খেলে কেবিন মাতিয়ে রাখে। যাওয়ার সময় বাবুকে অনেক আদর করেন সাবিহা। বাবু ও বলে -আম্মু! তুমি বাসায় চলো আমাল সাতে - যাবো বাবা! যাবো। আজকে তুমি যাও। দুষ্টুমি করবে না কেমন? - না! তুমি চলো! - আচ্ছা! কাল আসবো। এখন যাও চোখের জ্বলে মা ছেলে ২ জন ভেসে বিদায় নেয়। এর ৩ দিন পর সাবিহা পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন। বাবু মায়ের লাশের সামনে যেতে চায় না। কিছু না বুঝেও অনেক কিছুই বুঝে যায় সে। মায়ের লাশ দেখতে সে প্রস্তুত নয়। তবুও তাকে দেখতে হয়। এরপর সহজ হিসাব। কিছুদিন আত্মীয় স্বজনরা বাবুকে দেখে। এরপর ভাই বোন আর বাবাই সম্বল হয় তার। মায়ের একাকীত্ব দূর করে দিয়েছিল সে। ভাই বোনরা না থাকার সময় সে মাকে সঙ্গ দিত। আর আজ সেই মা নেই বলে, স্কুল শেষে রাস্তার পাশে দোকানে , পরিচিত অপরিচিত, আত্মীয় , অনাত্মীয়দের ঘরে তাকে অপেক্ষা করতে হয়। কখন ভাই বোন কিংবা বাবা আসবে, তারপর সে ঘরে যাবে। মা কি ভাবেনি, তার একাকিত্তে যে পাশে ছিল, তাকে একা ফেলে যাওয়া টা কতোটা ঠিক? এই তো তার একাকী জীবন। শুধু দেয়ালে লাগানো কবিতা দেখে বাবু আনমনে তাকিয়ে থাকে। এতো ছোট জীবনে এতো ব্যাথা সে কোথায় রাখবে!

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)