বিবিধ

গ্রানাডা ডে

গ্রানাডা ডে
মেয়েটার কান্ড দেখে আকাশটা তারার স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে হাসছিলো। কি পাগলামোই না করে মেয়েটা। বিরাট আকাশটার সাথে ছোট্ট এই এত্তটুকুন মেয়েটার সে কি ভাব! কোথায় কি হলো, আব্বুম্মু কি বলল, ভাইয়ার দুষ্টুমি, আপুর শাসন, দাদাভাইয়ের গল্পের আসর স......ব বলা চাই আকাশকে। আকাশটাও মিটি মিটি হেসে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে যাহরার কথা। হ্যাঁ, ছোট্ট মেয়েটার নাম যাহরা। সাজানো গোছানো শহর গ্রানাদার কোলে ছিম ছাম পরিপাটি একটা বাড়ি, সেই বাড়িরই ছাদে বসে দিব্যি আকাশের সাথে গল্প করে যাচ্ছে যাহরা। ঃ অ্যাইইইইই! তুমি তো সেই কত্ত দিন ধরে হাত পা ছড়িয়ে শুধু ভেসেই আছো আর ভেসেই আছো। সব কিছুতো দেখেছো তাইনা? বলো তো দাদাভাই ছোট বেলায় কেমন দুষ্টু ছিলেন? আহহা বলোইনা। জানো আজকে কত্ত করে দাদাভাইকে বললাম একটা গল্প শোনাতে। একটাও গল্পতো শোনালইনা উলটো বকে দিলো আমি নাকি খুব দুষ্টু হয়েছি। আমি কি দুষ্ট বলো বলো? তাইতো জিজ্ঞেস করলাম দাদাভাইয়ের দুষ্টুমির কথা। তোমার থেকে জেনে নিয়ে দাদাভাইকে বলব। মজা হবেনা? আকাশটা হাসে আবারো। শুকতারাটা ঝলমলিয়ে ওঠে। আকাশের শব্দহীন জবাব বয়ে এনে ছোট্ট যাহরার সোনালী চুলগুলো এলোমেলো করে দেয় বাতাস। কলকলিয়ে ওঠে ওর কচি কন্ঠ। ঃ এ বাবা... তোমাকে তো বলতে ভুলেই গেলাম। জানো! আজকে মসজিদ থেকে এসেই দাদাভাই কি যেনো ভাবতে বসে গেলেন। আচ্ছা দাদাভাইগুলো এমন কেনো? সুযোগ পেলেই শুধু ভাবে আর ভাবে। আজকে শুধু দাদাভাই না আব্বু ভাবছে, এমনকি ভাইয়াটাও হপ করে ভেবে যাচ্ছে। হঠাত চুপ হয়ে যাওয়া যাহরা কে উৎসুক হয়ে দেখে আকাশ। মেয়েটাও তার দাদাভাইয়ের মতো ভাবছে? কি ভাবছে? এক ঝলক বাতাস যাহরাকে সচকিত করে তোলে। ঃ 'আমি জানি ওরা কি ভাবছে।' আস্তে করে বলে যাহরা। 'ও বাড়ির হাসান চাচ্চুর কথা ভাবছে সবাই। বাড়িতে সবার মন খারাপ। হাসান চাচ্চু কে নাকি নতুন রাজার সৈন্যরা মেরে ফেলেছে। ওরা এমন করলো কেনো? এখন আমাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে নদীর পাড়ে বেড়াতে নিয়ে যাবে কে বলো? আর ওই ছবিওয়ালা বইটার গল্প? কে শোনাবে? ঝর ঝর করে কেঁদেই ফেলে যাহরা। শুধুতো হাসান নয়, কতশত টগবগে তরুন হারিয়ে গেলো পৃথিবীর বুক থেকে! কত মায়ের আহাজারি প্রতি নিয়ত জর্জরিত করে তুলছে ওর বুকটাকে তাকি জানে যাহরা! একজন হাসানের হারিয়ে যাওয়া যাহ্‌রাকে কাদায়ার আকাশটাকে যে কতো অসংখ্য হাসানের হারিয়ে যাওয়া দেখে যেতে হয়। ও যে যাহরার মতো করে কাঁদতে পারেনা। শুধু দেখে যায় অজস্র হাসানের অন্তর্ধান, অগণিত মায়ের বুক চেরা কান্না আর গুটিকয় ফারডিন্যান্ড-ইসাবেলার পৈশাচিক হাসি। ওকে শুধু সয়ে যেতে হয়। ঃ আম্মু আজকে বলেছিলো নতুন রাজাটা নাকি আমাদেরকেও মেরে ফেলবে, সবাইকে মেরে ফেলবে। কেনো মেরে ফেলবে? এই রকম একটা রাজার কাছ থেকে তো মুসা বিন নুসায়ের, তারিক বিন যিয়াদ সব্বাইকে বাচিয়ে দিয়েছিলো। ওম্মা! তুমি জানো না? আমিতো ওদের গল্প কত্ত শুনেছি! আব্বুম্মু ওদের গল্প বলে, দাদাভাই বলে, ভাইয়া আপু ওদের গল্প বলে। হাসান চাচ্চুও বলতো। আচ্ছা ওরা মানে তারিক বিন যিয়াদ তারপর মুসা বিন নুসায়ের ওরা কি এখানে আর আসবেনা নতুন রাজাটাকে আগের রাজাটার মতো পিট্টি দিয়ে দিতে? যাহরার এতো কঠিন প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনা আকাশ। তারিক, মুসার স্মৃতি বিজড়িত গোয়াদের কুইভারের বুকে ব্যাথা ভরা স্রোত দেখে মুষড়ে পড়ে আকাশটা, তার বেদনায় ভারী দীর্ঘ শ্বাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় জাবালুত তারিকের চুড়া। আরেকজন তারিকের প্রতিক্ষায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়টাও বুঝি কেঁদে ওঠে তখন! পরদিন সূর্যের লালিমার সাথে, গোয়াদেল কুইভারের স্রোতের সাথে রক্ত স্রোত দেখে শিউরে ঊঠে আকাশ। এতো নির্যাতন! এক বুক রক্তের ভার নিয়ে গুমরে কেঁদে যাচ্ছিলো গোয়াদেল কুইভার। আল হামারা প্রাসাদের ছাদে বসে পুলকিত হয়ে মুসলমানদের খু... হওয়া দেখছিলো পাদ্রী জেমস, রাজা ফারডিন্যান্ড আর রানী ইসাবেলা। তিনজন পরামর্শ করে নিলো কিছু একটা। ঘোষনা দেবার প্রস্তুতি চলছে ফারডিন্যান্ডের। মুখে কুটিল হাসি। ঘোষনা আসলো-'যারা গ্রানাডার বড় মসজিদে আশ্রয় নেবে তাদের কোনো ক্ষতি করা হবেনা।' আকাশটা বুঝি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো একটুখানি। আবাল বৃদ্ধ বণিতা বড় মসজিদে এসে আশ্রয় নিচ্ছিলো। ছোট্ট যাহরাও আকাশকে হাত নেড়ে মুচকি হেসে মসজিদে ঢুকলো আম্মুর সাথে। মসজিদ যখন কানায় কানায় ভরে গেলো, নতুন রাজার সৈন্যরা তখন মসজিদের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দিচ্ছিলো। যাহরা দৌড়ে আসে শেষ জানালাটার কাছে। ছোট্ট হাত নেড়ে আকাশকে মসজিদের ভেতরের সব গল্প পরে বলবে বলে জানায়। জানালায় নতুন রাজার সৈন্যদেরকে দেখে ভয় পায় যাহরা। দৌড়ে আম্মুর কাছে ফিরে আসে। ততক্ষণে সব দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একপাশে একটা জায়গায় বাড়ির সবাই মিলে বসলো। চোখে মুখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছায়া। পাশেই রহমান চাচ্চু, চাচি আর চাচির ৭ মাসের গুটুল মুটল বাবু সাদমান। যাহরা সাদমানের সাথে খেলছে। দাঁত ছাড়া মাড়ি দিয়ে ক্যামন একটা হাসি দেয় বাচ্চাটা। সাথে সাথে গালে টোল পড়ে। কি আদর আদর লাগে তখন! গরমে কাঁদছে সাদমান। যাহরার খেলা, মায়ের আদর কিছুতেই মানানো যাচ্ছেনা তাকে। হঠাত এতো গরম পড়লো কেনো? এই একটু আগেও তো এতোটা বেশি গরম ছিলোনা। ওমা! ওই দিকটা কেমন ধোঁয়াটে হয়ে গেছে। সবাই আগুন আগুন করে চিৎকার দিয়ে এদিকে ছুটে আসছে। আব্বু সবাইকে নিয়ে উঠে পড়লেন। সাথে রহমান চাচাও। আব্বু, ভাইয়া, দাদাভাই, রহমান চাচা আরো কয়েকজন মিলে অনেক চেষ্টা করলো একটা অন্তত দরজা বা জানালা ভাংতে। ওইদিকে সাদমান কেদেই চলছে, গরমও বেড়েই চলছে। হঠাত যাহরা খেয়াল করল সাদমানের কান্নাটা অন্য রকম শোনা যাচ্ছে। পেছন ফেরে যাহরা সাদমানকে একটু আদর করে দেবার জন্য। কোথায় সাদমান! চাচির সারা গায়ে আগুন, তাও প্রানপণে চাচী চেষ্টা করছেন সাদমানকে বাচানোর জন্য। আর সাদমান হামাগুড়ি দিয়ে তার মাকে ধরতে চেষ্টা করছে। আগুনের শিখা এবার যাহরাকে স্পর্শ করলো। চিৎকার দিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে দেখলো পাশেই মেঝেতে তড়পাচ্ছে আম্মু। আর কাউকে দেখা যাচ্ছেনা চারদিকে শুধু চিৎকার আর কান্না। অসহ্য যন্ত্রনায় শেষ চিতকারটা দিয়ে লুটিয়ে পড়ার আগে দেখলো লকলকে আগুন গ্রাস করেছে বাচ্চাটাকে। তুলতুলে ছোট্ট দেহটা কুঁকড়ে গেলো চোখের সামনেই। তারপরও বাচার সে কি আকুতি ছিলো যাহরার! এবং একটা অন্তিম চিৎকার। কে বাচাবে ওদেরকে? ওদিকে প্রাসাদের ছাদে বসে ফারডিন্যান্ড আর ইসাবেলা উপভোগ করছিলো হাজারো বনী আদমের জীবন্ত কাবাব হওয়ার দৃশ্য আর আঙ্গুল তুলে বলছিলো "এপ্রিল ফুল।" তিল তিল করে পুড়ে মরতে থাকা যাহরাদের প্রতিটা যন্ত্রনা কাতর চিৎকার, মাংশ পোড়া গন্ধ, লক লকে আগুন, কালো ধোঁয়া ঝাঝরা করে দিচ্ছিলো আকাশটার শান্ত নীল বুক। জাবালুত তারিক শব্দহীন ভাষায় চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছিলো। গোয়াদেল কুইভারের স্রোতের সাথে কত শত অশ্রু কনা মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো তার হিসেব কে রাখে! যাহরাদের অন্তিম চিৎকার আকাশ ভেদ করে ইথার পেরিয়ে পৌঁছে যায় স্রষ্টার দরবারে। এতো জঘন্য নিষ্ঠুরতা দখে আরশে আজীমও বুঝি থরথরিয়ে কেঁপে উঠেছিলো সে দিন! আকাশটা অসহায় ভাবে দেখে যায় বড় মসজিদের আগুন কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছে কাশ্মির, ফিলিস্তিন, আফগান, মিশর, সিরিয়া, ককেশাশ, আফ্রিকা, মায়ানমার, সিরিয়া, বাংলাদেশ সহ মুসলিম মানচিত্রের প্রতিটা কোনায়। বিশ্ব জুড়ে কত সাদমানের কাবাব হওয়া লাশ দেখে আকাশটা, কত যাহরার অন্তিম চিৎকার শুনে কেঁপে উঠে আরশ! ইসাবেলা ফারডিন্যান্ডরা অট্টহাসি হেসে যায় আর সহস্রাব্দি জুড়ে খেলে বোকা বানানোর খেলা। আকাশটা, জাবাল আত তারিক আর গোয়াদেল কুইভার আজও খাক হতে থাকা মুসলিম মানচিত্রের যাহরাদের সাথে অপেক্ষা করে আছে মুসা বিন নুসায়েরের জন্য। কান পেতে থাকে ওরা তারিক বিন জিয়াদের ঘোড়ার শব্দ শুনবে বলে। ওরা কি আসছে? কবে আসবে ওরা? ১লা এপ্রিল। হুল্লোড় করে নানান ভাবে বোকা বানানোর খেলা চলছে পৃথিবী জুড়ে। আজকের কোনো এক যাহরা কোনো সাদমানকে বোকা বানিয়ে খিল খিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। আর বলছে "এপ্রিল ফুল।" আকাশের বুকে যেনো ঝাঁকে ঝাঁকে বিষাক্ত শর ছুড়ে মারে "এপ্রিল ফুল" এই দুইটা শব্দ আর বোকা বানানোর খেলাটা। তখন আকাশটা চিৎকার করে বলতে চায় এপ্রিল ফুলের শিকার যাহরাদের গল্পগুলো, তাদের শেষ চিৎকারের গল্প, তাদের পুড়ে মরার গল্প। বলতে চায় ওরাও মুসলিম ছিলো তোমরাও মুসলিম। বলতে চায় হৃদয় ছেড়া সেই ইতিহাস। কিন্তু কজনই বা থামায় বোকা বানানোর খেলা অবলা আকাশের কান্না দেখে। কজনই বা থামে মূক পাহাড়ের চিৎকার শুনে। কজন?    

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন