বিবিধ
বেগম রোকেয়া: দুটো কথা, কিছু অনুভুতি

ছোট বেলা থেকে বাংলা ইংরেজী পাঠ্য বইয়ে নানান ভাবে বেগম রোকেয়া কে নিয়ে পড়াশুনা। সত্যি বলতে কি প্রচুর বিরক্তি ধরে যেত এই নামটা শুনেই। এত রকমের সাল, প্রতিষ্ঠানের নাম, তার অমর কাজকর্মের ফিরিস্তি জেনে আর খাতায় লিখে কি লাভটা হবে তা নিয়ে বিস্তর গজর গজর হয়ে যেত। প্রাণ পনে এড়িয়ে যেতাম। আরো মেজাজ খারাপ হবার পালা এলো যখন তার অবরোধবাসিনী পড়লাম। ভোঁতা মাথায় যদ্দুর ধরে তদ্দুরে শুধু পর্দাপ্রথা কে পচিয়ে যাওয়াটাই চোখে পড়েছিলো। প্রতিটা লাইন পড়তাম আর একধাপ করে শিওর হতাম যে উনি অনেক অনেক বাড়িয়ে লিখেছেন। কিন্তু তাও কেনো যেনো দাঁতে দাঁত চেপে তার সম্পর্কে জানার চেষ্টাটা শুরু করলাম এবং যদ্দুর পারা যায় চালিয়ে গেলাম। ঠিক “কেন যেন” না এর পেছনে একটা গল্প আছে। ফ্যামিলি আড্ডায় বেগম রোকেয়াকে নিয়ে কথা উঠলে বিরক্তি নিয়ে অবরোধবাসিনী যখন উগড়ে দিলাম তখন ভাইয়া বলছিলেন এই মহিয়সীর মত ইসলামের সঠিক ধ্যান ধারনা আকড়ে ধরে প্র্যাকটিস করে টিকে থাকা ওঠা তৎকালীন গোঁড়া ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সময়ে পুরো বিশ্বের সাথে লড়াই করার সমান কঠিন ছিলো। এই কঠিন কাজটাই তিনি পেরেছেন। ভাইয়ার কথা থেকে কৌতূহল এবং তারপর দাঁতে দাঁত চাপা অভিজান, ফলাফল এক বুক শ্রদ্ধা আর টুপি খোলা সম্মান।
আর যেখান থেকে আজকে কী বোর্ড পেতে বসার অবতারনা তার পেছনে ‘বেয়াদব থেকে আদব শেখা’র মত একটা ব্যাপার আছে। মুক্তমনায় গিয়ে ফরিদ আহমেদ এর ব্লগ পোস্ট “রোকেয়াঃ অন্য আলোয় দেখা” লেখাটি পড়ে শ্রদ্ধাটা আরো বেড়ে গেলো। লেখকের উদ্দেশ্য ছিলো বেগম রোকেয়াকে হেয় করা। সেই প্রচেষ্টাটাই শাপে বর হলো।
বর্তমানে শিক্ষা ব্যাবস্থার যেই রকম উন্নতি দেখা যাচ্ছে তাতে হাত দিয়ে ছুতে পারা ভবিষ্যতেই ক’জন মানুষ অবশিষ্ট থাকবে কে জানে! বাকি সময় তোলাই রইল। ধর্মীয় শিক্ষা যেখান থেকে একটা দোপেয়ে জীবের মানুষ হওয়া শুরু সেই শিক্ষা দিনকে দিন মুছে ফেলা হচ্ছে সেক্যুলারিজমের জয়জয়কারে। এইরকম পরিস্থিতিতে একজন মা ই পারেন সন্তানকে দোপেয়ে জীব থেকে মানুষ বানাতে। এইদিনটা হয়তো প্রায় বছর শতেক আগে বেগম রোকেয়া দেখতে পেয়েছিলেন। তাই বলে গেছেন-
“মুসলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে কোরান শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন। আপনারা কেহ মনে করিবেন না যে, প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কোরান শিক্ষা দিতে বলিয়া আমি গোঁড়ামীর পরিচয় দিলাম। তাহা নহে, আমি গোঁড়ামী হইতে বহু দূরে। প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থাই কোরানে পাওয়া যায়।“
“কোন ভদ্রলোক বায়না ধরেছেন যে আই এ পাশ পাত্রী চাই। কেউ চান অন্তত ম্যাট্রিক পাশ, তা না হলে তারা খ্রীস্টান বা ব্রাক্ষ্ম হয়ে যাবেন। এসব বিকৃত রুচির প্রধান কারণ বর্তমান ধর্মহীন শিক্ষা।“
নারীযে শুধু সন্তানকেই মানুষ বানায় না একজন ধার্মিক নারী স্বামীর মানুষ হয়ে ওঠারও জীয়ন কাঠি এবং স্বামী, সন্তান উভয়ের জন্যই একজন নারীকে এমন জীয়ন কাঠি হতেই হবে সেটা মনে করি ভারতবর্ষে বেগম রোকেয়ার চেয়ে স্পষ্ট ভাষায় কেউ বলে যেতে পারেননি।
“উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ভদ্রলোকের ঘরে এখন “এম এ পাশ” বউ না হলে আলো হয় না। কিন্তু এজন্যে সে বেচারাদের গালাগালি না দিয়ে বরং যাতে তাঁরা আমাদের হাতছাড়া না হন, তারই ব্যবস্থা করতে হবে। আমার আরো জানা আছে যে, অনেক বিকৃত-মস্তিষ্ক ধর্মহীন লোক উপযুক্তা বিদুষী ভার্যার হাতে পড়ে শুধরে গিয়ে চমৎকার পাকা মুসুল্লী হয়েছেন।“
যখন এদেশে পাখি জামার জন্য সুইসাইড হয়, ঘরে ঘরে সিরিয়ালিক কলহ লেগেই থাকে, নির্যাতন, ধ..., অসম্মান যখন মেয়েদের পেছনে ছায়া হয়ে লেগে থাকে আর তবুও যখন নারীজাতি ঐশ্বরিয়া ক্যাটরিনা হওয়ার জন্য সর্বস্ব দিয়ে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে বাবা মা সন্তানকে খু... করে বসে অন্ধকারের টানে তখন আমরা বুঝে যাই একজন আয়শা ফাতিমা কতটা প্রয়োজন। আজকের এই অস্তিত্ব সংকটে পড়া নারীদেরকে বেগম রোকেয়া বলে গিয়েছিলেন নিজের সত্বার দিকে ফিরে আসতে শেকড়ের কাছে ফিরে আসতে অন্তত কয়েকজন আয়শা ফাতিমার প্রয়োজনীয়তা বেগম রোকেয়াকে ঘরে ঘরে আয়শা ফাতিমা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছে। আফসোস! সেই স্বপ্ন তাঁর চোখে আর বইয়ের পাতায়ই রয়ে গেলো।
“দুরবস্থার একমাত্র ঔষধ- একটি আদর্শ মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়….. আদর্শ মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়ে আদর্শ মুসলিম নারী গঠিত হবে – যাদের সন্তান-সন্ততি হবে হযরত ওমর ফারুক, হযরত ফাতেমা জোহরার মতো।“
বেগম রোকেয়ার প্রবন্ধ গুলো পড়লে মনে হতেই পারে যে নারীদেরকে তিনি বহির্মুখী হওয়ার মাধ্যমেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভাঙার ডাক দিচ্ছেন। আসলেই কি তাই? সমাজের মূল হলো পরিবার। আর পরিবারের প্রাণ নারী। পরিবার বিমুখ হয়ে কথিত নারী অধিকার আদায় যে সমাজ ধ্বংসই করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। সমাজ গড়তে যে জানে তারই ভাঙার কাজ শোভা পায়। আর এই ভাঙা গড়ার কাজের মূল ক্ষেত্রই পরিবার যার অতন্দ্র প্রহরী একজন নারীই। একজন আদর্শ শিক্ষিত নারীর পক্ষেই সম্ভব একটা মানুষের মত মানুষে সমাজ গঠন করা যা অন্যান্য সমস্ত কাজের চেয়ে ভারি, গুরুত্ববহ, এবং মর্যাদার। এই কথাগুলোর অনুরণন বেগম রোকেয়ার কন্ঠে
“আশা করি আপনারা সকলেই সুগৃহিণী হইতে ইচ্ছা করেন, এবং সুগৃহিণী হইতে হইলে যে যে গুণের আবশ্যক, তাহা শিক্ষা করিতে যথাসাধ্য চেষ্টাও করিয়া থাকেন। কিন্তু আজ পর্য্যন্ত আপনাদের অনেকেই প্রকৃত সুগৃহিণী হইতে পারেন নাই। কারণ আমাদের বিশেষ জ্ঞানের আবশ্যক, তাহা আমরা লাভ করিতে পারি না। সমাজ আমাদের উচ্চশিক্ষা লাভ করা অনাবশ্যক মনে করেন। পুরুষ বিদ্যালাভ করেন অন্ন উপার্জ্জনের আশায়, আমরা বিদ্যালাভ করিব কিসের আশায়? অনেকের মত আমাদের বুদ্ধি বিবেচনার প্রয়োজন নাই। যেহেতু আমাদিগকে অন্নচিন্তা করিতে হয় না, সম্পত্তি রক্ষার্থে মোকদ্দমা করিতে হয় না, চাকরীলাভের জন্য সার্টিফিকেট ভিক্ষা করিতে হয় না, “নবাব” “রাজা” উপাধিলাভের জন্য স্বেতাঙ্গ প্রভুদের খোসামোদ করিতে হয় না, কিংবা কোন সময়ে দেশরক্ষার্থে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে হইবে না। তবে আমরা উচ্চশিক্ষা লাভ (অথবা Mental culture) করিব কিসের জন্য? আমি বলি, সুগৃহিণী হওয়ার নিমিত্তই সুশিক্ষা (Mental culture) আবশ্যক।“
“যদি সুগৃহিণী হওয়া আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে স্ত্রীলোকের জন্য সুশিক্ষার আয়োজন করিবেন।“
অবরোধবাসিনী পড়ে মেজাজ যাদের আমার মত খিচড়ে গিয়েছিলো তাদের জন্য-
“তাঁহারা প্রায়ই আমাকে বোরকা ছাড়িতে বলেন। বলি, উন্নতি জিনিসটা কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তবে বুঝিবে যে জেলেনী, চামারনী, কি ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা উন্নতি লাভ করিয়াছে।“
“রেলওয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়াইয়া কোন সম্ভ্রান্ত মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে, তাঁহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ঐরূপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকের ঘৃণা উদ্রেক করিলে কোন ক্ষতি নাই। … রেলওয়ে ভ্রমণকালে সাধারণের দৃষ্টি (public gaze) হইতে রক্ষা পাইবার জন্য ঘোমটা কিম্বা বোরকার দরকার হয়।“
“আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠন (ওরফে বোরকা) সহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয় না।“
জানিনা কি লিখতে কি লিখেছি। এলোমেলো কিছু পংক্তি আর একজন মহিয়সীর কথা জুড়ে দিয়েছি মাত্র। আসলে বেগম রোকেয়াকে নিয়ে কি লিখব কিভাবে লিখব সবটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মাথাটা শূন্য ঠেকছিলো। তবুও তুলে ধরার চেষ্টা করেছি নারীর প্রায় হারাতে বসা মর্যাদা, সম্মান, অধিকার ফেরানোর পথ যা বেগম রোকেয়া দেখিয়ে দিয়েছেন। পুরুষের পায়ে পা দিয়ে তাদের সাথে সাথে দৌড়তে থাকলে না পুরুষ হওয়া যায় না নারী হয়ে থাকা যায়। শাশ্বত জীবনাদর্শ, বাস্তবতা, দায়িত্বানুভুতি, প্রকৃতিগত বাস্তবতা সব কিছুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভারসাম্যপূর্ণ নারীর পথচলা যেমনটা হওয়া আজ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে দাবি রাখে সেটা বেগম রোকেয়া প্রতিটি নারীর কানে বলে যাবার চেষ্টা করেছেন প্রানপনে। তারই কিছু অংশ তুলে ধরলাম। আর প্রথমেই বলেছিলাম ‘বেয়াদব থেকে আদব শেখা’র কথা। ব্যাপারটা কিছুটা আমার লেখায় ঘটেছে। ভদ্রলোক বেগম রোকেয়ার এই উক্তিগুলোর সেক্যুলার ব্যাখ্যা দিয়ে বেগম রোকেয়াকে ভিলেনের জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছেন। একই উক্তিগুলোর উলটো ব্যাখ্যাটা আমি দিয়েছি আমার মত করে। এটা সেই ভদ্রলোককে দেয়া কোন জবাব না। যাইহোক নারীজাগরনের প্রকৃত রুপের কিছুটা অংশ তুলে ধরার এই এলোমেলো প্রচেষ্টাটা সফল হোক, আল্লাহ এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করুন।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)