
‘আরে মা তুই আসছিস? মেয়েটারে একটু বুঝা তো! মন খারাপ করে বসে আছে। মিষ্টিও কিনতে দিলো না।‘
‘জী আন্টি। আপনি ভালো আছেন?’
‘আমার আর ভালো থাকা!’
মিমির এস এস সি রেজাল্ট হয়েছে। বেচারী একটুর জন্য এ প্লাস মিস করলো। নাহ ওকে একেবারেই দোষ দেয়না শিশির। পরীক্ষার ক’দিন আগে বাবা মারা গেলো মিমির। গ্রান্ড টিবির মত যন্ত্রনা, অভাব সাথে নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে মেয়েটা। বিকেল বেলা একটু বেরিয়েছিল শিশির মিমির সাথে দেখা করবে বলেই। ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই কিছু আন্টিকে বসা দেখলো। সবাই পরিচিত, কেউ আবার আধা পরিচিত।
কথা না বাড়িয়ে ড্রয়িং এর পাশেই মিমির ঘরে ঢোকে শিশির। দেয়ালের ওপাশের সব কথা শুনতে পাচ্ছে। ওকে নিয়েই কথা হচ্ছে। ‘কে গো ভাবি মেয়েটা?’ ‘আরে চিনলেন না! ওমুক ভাইয়ের মেয়ে।‘ ‘কোনটা? ওনার তো চার মেয়ে।‘ ‘এটা ছোটটা। তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।‘ ‘ও আচ্ছা! ওই যে ছোট বেলায় স্কিন ডিজিস ছিলো যে ওই মেয়েটা?’ ‘হুম। বেচারী! কষ্ট পাইছে অনেক।‘ ‘অনেক দিন আগে দেখছিলাম মেয়েটাকে। এখন অনেক বড় হয়ে গেছে মাশাআল্লাহ।‘ ‘হ্যাঁ ভাবি। মেয়েটা ভালই।‘ ‘ডাকেননা মেয়েটারে একটু কথা বলি। ওর মায়ের সাথেও দেখা হয়না অনেক দিন।‘
মিমি গেছে কিচেনে। চুপ চাপ বসে একটা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে শুনছিলো শিশির। আন্টির ডাক শুনে উঠে গেলো ও।
‘এই আন্টিকে চিনিস? ওইযে মারিয়াদের পাশের বিল্ডিং এ থাকতো।‘
‘ওহ! চিনছি। ভালো আছেন আন্টি?’
‘হ্যাঁ মা ভালো। তোমার কি অবস্থা মা? তোমার আম্মু আব্বু কেমন আছেন?’
‘ভালো আছেন আলহামদুলিল্লাহ।‘
‘তোমরা কি আগের জায়গাতেই আছো?’
‘না আন্টি। এই দিকে চলে আসছি বাসা চেইঞ্জ করে।‘
‘তোমার বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে শুনলাম।‘
‘জী আন্টি।‘
‘হুম ভালো’
‘তুমি কিসে পড়ছ?’
‘অনার্স ফাইনাল’
‘ও’
‘তোমাকে দেখতাম ছোট বেলায়। কি কষ্ট পাইছো! আহারে! তোমার তো দাগ দাগ হয়ে গেছিলো সারা শরীরে। এখন আছে?’
শিশির চুপ করে থাকে। কিছু বলে না। ও জানতো এই প্রসঙ্গটা উঠবেই। পুরোনো পরিচিতদের কাছে তো তার এই একটাই আইডেন্টিটি। মিমির আম্মু ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বললেন দেখোতো মিমি কি করে। নাস্তা পানি আনতে এতক্ষন লাগে!
হাঁপ চেড়ে বাঁচে শিশির। ‘আহারে মেয়েটা! শিক্ষিত মেয়ে! শরীরে দাগ নিয়ে তো বিয়েশাদী দিতে ভালো ছেলে পাবেনা। বাপ মায়ের কি কষ্ট!’ ‘হুম। সবই আল্লাহর ইচ্ছা! নাইলে মেয়েটা কি কপাল নিয়ে আসলো!’ কিচেনে যেতে যেতেই সেই মারিয়াদের পাশের বিল্ডিং এর আন্টির এবং বাকিদের হা হুতাশ, আফসোস শোনা গেলো। শিশিরের হাসিই পায়। আল্লাহর ইচ্ছা মনে হয় এরা সবটাই জেনে বসে আছে। এই দুই মিনিটে কপালের লেখাও পড়ে ফেলছে। বাহ!
মিমির সাথে কথা বলে যখন বেরিয়ে আসে শিশির তখনও ওকে নিয়েই কথা হচ্ছে আন্টিদের গন্ডিতে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ফিরতে হবে। কিন্তু আন্টিদের কথা গুলো ওকে খোঁচাচ্ছে। তাদের কাছে সে একটা দাগ ওয়ালা মেয়ে, সে একটা মানুষ এই ব্যাপারটার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো তার গাঁয়ে দাগ আছে। দাগ জিনিস গুলো ওকে কষ্ট দেয়না কখনো যতটা কষ্ট দেয় তার দাগ নিয়ে মানুষের মাথা ব্যাথাটা। বাসায় ফিরে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে ঘটনা গুলো। মনে মনে নিজেকে ধমকায়। সব জায়গায় তোর জন্য এইসব ঘটনা খুব কমন। প্রায় প্রতিদিন ফেইস করিস। তাও মানতে পারিসনা ক্যান? অতিতটকে অস্বীকার করতে পারবি? নাহ। শিশির তো অতিত কে অস্বীকার করতে চায়না। অতীত তো অতিত হয়েই গেছে। ভয়ংকর অতীতের হাত থেকে আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে এনেছেন। সে তো অতীত কে ছেড়ে এসেছে তাও মানুষ অতীতটাকে ওর নাকের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখবে কেনো? যাহ! যে যাই বলুক আমি এখন ভালো আছি, আমি আমার মত চলব। এতো কথা কানে নিতে গেলে আর ভালো থাকতে হবে না। নিজেকে বোঝায় শিশির। বুক সেলফের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ও। এই একটা জিনিস তার মন ভালো করে দেয়ার জীয়ন কাঠি। হুম বই। কখনো ওর স্কিন ডিজিস বা ওর দাগ গুলো নিয়ে কিচ্ছু বলেনি। সবটা সময় অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত সঙ্গ দিয়ে এসেছে। কোনো আপত্তি তোলেনি। কাঁদিয়েছে হাসিয়েছে কিন্তু কষ্টটা পুষে রাখতে দেয়নি। পছন্দের বইটা বাছাই করে নিয়ে টেবিলে রেখে কিচেনে গেলো। গরুর গোশত ভুনা দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে খাবে। খেতে খেতে বই পড়াটা খুব ইনজয় করে শিশির।
আরাম করে খাটে বসে মুড়ি মাখা খাচ্ছে আর বই পড়ছে। বাচ্চাদের একটা চিলার টাইপের বই। একটু পর পর হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আম্মু কি যেনো বলতে এসেছিলো। বই পড়তে দেখে চলে গেছেন। জানেন এখন যাই বলুক কিচ্ছু মাথায় ঢুকবেনা মেয়ের। হু হা করে আবার যেই সেই। পাশের ফ্লাটের আন্টি এলেন। বাসা চেইঞ্জ করে এই বাসায় ওঠার পর এই প্রথম কেউ এলো বাসায়। সব কটা রুম কিভাবে সাজানো হয়েছে দেখে টেখে ওর রুমে এসে ঢোকেন সেই আন্টি। রিল্যাক্স করে বইয়ে ডুব দিয়ে থাকাতে খেয়াল করেনি শিশির। ‘ভাবি! আপনার মেয়ে?’ অপরিচিত গলা শুনে বই থেকে মুখ তোলে ও। ফর্সা করে মোটা সোটা মহিলা। পা থেকে মাথা অব্দি আভিজাত্যের আর নিয়মিত রুপ চর্চার ছাপ। আম্মু হেসে বলেন ‘হ্যাঁ। সবার ছোটো ও’ ‘ও! ওর হাতে কি ভাবি? কুষ্ঠ হইছিলো নাকি?’ আম্মু চট করে মলিন মুখে তাকায় শিশিরের দিকে। শিশির বই থেকে মুখ তুলে আন্টির দিকে তাকিয়ে আছে। আম্মু যতটা সম্ভব সংক্ষেপে শিশিরের হাতের দাগের ব্যাখ্যা করে আন্টিকে ওর রুম থেকে ড্রয়িং এ নিয়ে বসান। শিশির নাস্তা দিতে দিতে আন্টির আক্ষেপ শুনছে। ‘আহারে! মেয়ে মানুষ। ভালো কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। দেখেন দাগ গুলো সারানো যায় কিনা। বিয়ে শাদীর একটা ব্যাপার আছেনা!’ আম্মু কিছুক্ষন চুপ করে থেকে প্রসঙ্গ চেইঞ্জ করেন তাও মহিলার হায় আফসোস থামেনা। ভাল্লাগেনা আর শিশিরের। যেটুকু সৌজন্য না দেখালেই নয় সেইটুকু করে চলে আসে শিশির। বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আকাশ দেখে, চাঁদ দেখে আরো কত কিছু মনে পড়ে যায়!
শিশিরের যখন ৬ মাস বয়স তখন ভুল টিকা পুশ করার কারনে ভয়ংকর স্কীন ডিজিসে আক্রান্ত হয় শিশির। সেই ৬ মাস বয়স থেকে শুরু করে টানা তের বছর......... শিউরে ওঠে শিশির। ওই যন্ত্রনা কাতর তেরটা বছরের একটা দিনের কথাও ভাবতে চায়না ও। নিজের জন্য, সবার জন্য জলজ্যান্ত একটা যন্ত্রনার আকর ছিলো সে। সেই স্কীন ডিজিসের দাগ বয়ে বেড়াচ্ছে শরীরে। আল্লাহর অশেষ কৃপায় শিশির এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু দাগ গুলোর জন্য সেই যন্ত্রনা গুলো আজো ওকে ভোগ করতে হয়।
স্কুলের স্মৃতি গুলো জল জল করে চোখের সামনে। যখন প্রথম ভর্তি হয় শিশির তখন ক্লাসে কেউ ওর পাশে বসতে চাইতো না। টিচাররা ও সবাইকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতো ওর পাশে কেউ বসোনা কেমন? ওর রোগটা কিন্তু ছোঁয়াচে। শিশির বুঝে পায় না ছোয়াচেই যদি হবে তাহলে বাসায় আব্বু আম্মুর কিচ্ছু হয়না কেনো? বড় হয়ে জেনেছে রোগটা ছোঁয়াচে ছিলো না। ক্লাসের সব গুলো মেয়ে ওকে খুব ক্ষেপাতো এটা সেটা বলে। খুব কান্না পেতো ওর। একদিন শিশির সাহস করে ক্লাস টিচারকে বলেছিলো। বিচার তো দূরে থাক টিচারের ধমক খেয়ে কেঁদে ফেলেছিলো ও। খুব নাকি হিংশুটে মেয়ে সে তাই ক্লাসমেটদের সইতেই পারে না খালি খালি মিথ্যে বিচার দেয়! ব্যাস, সেই থেকে জমের মত ভয় পেতো টিচারদেরকে। স্কুলের বিশাল মাঠটাতে খেলতে খুব ইচ্ছে করত ওর কিন্তু কে খেলায় নেবে ওকে! একটা মেয়ে নাম ঈশা। খুব চাইতো শিশিরের সাথে বসতে, গল্প করতে কিন্তু টিচারের মানা আর অন্যান্য মেয়েদের টিটকারীর ভয়ে পারতোনা। শিশির ছোট হলে কি হবে সবই ও বুঝতো। প্রথম পরীক্ষার দিন শিশির খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলো। ওর পাশের মেয়েটা যখন ওর মতই ঘাবড়ে গিয়ে ফোপাতে ফোপাতে কেঁদে ফেললো তখন মেয়েটার সাথে সাথে শিশিরও ভ্যা.........। ম্যাম মেয়েটাকে কোলে নিয়ে কি সুন্দর আদর করে থামালেন। কিন্তু শিশিরকে কেনো যেনো প্রচন্ড ধমক খেতে হয়। গানের রেকর্ডিং থেকে শুটিং থেকে শিশির বাদ পড়ে যায় এই একটা কারনে। স্কুলের অনুষ্ঠানে ব্যাক থেকে কন্ঠ দিতো সে আরেকজন লিপ সিং করতো স্টেইজে। কারন একটাই। ওইটুকু বয়সেই শিশির সব বুঝতো কিন্তু কাউকে কিছুই বলেনি কখনো। না বাসায় না স্কুলে। কেনো যেনো রুচি হতোনা ওর এসব নিয়ে কথা বলার বা নালিশ করার। আর দশটা বাচ্চার মত উচ্ছল শিশির বুঝে গিয়েছিলো সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। তাই সব কিছু থেকে নিজেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়েছিলো। তারপরও ক্রমাগত জর্জরিত শিশির মনের ভেতরে গুমরে মরতো। প্রতি রাতের একটা রুটিন ছিলো ওর। সারাদিনের তাচ্ছিল্য বা করুনার বান গুলো রাতে খুব যন্ত্রনা দিতো ওকে। নতুন করে ক্ষত গুলো থেকে রক্ত ঝরতো। কেঁদে কেঁদে কত রাত পার হয়ে গেছে! পাশে শুয়ে থাকা আপুরাও বুঝে উঠতে পারেনি। শিশির বুঝতে দেয়নি কাউকে। কি হবে বুঝিয়ে!
শিশিরের শৈশব কৈশোর...... সুস্থ থেকেও প্রতিবন্ধির মত কেটেছে দিন গুলো। যখন যেখানে গিয়েছে এই একটা কারনেই তাকে ক্ষত বিক্ষত হতে হয়েছে, হচ্ছে। একটা সময় শিশির কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলো ও কি আসলেই মানুষ না অন্য কিছু। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে সবার সাথে নিজেকে মেলাতো সবই মিলে যেতো শুধু স্কীন ডিজিসটা ছাড়া। একদিন আম্মুকেও প্রশ্নটা করে বসেছিলো ও। আম্মু অবাক হয়ে কারন জানতে চাইলে যখন প্রতি নিয়ত ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল শিশির তখন আম্মু ওকে জড়িয়ে ধরে অঝরে কেঁদেছিলেন। তারপর নিজের উপর খুব রাগ হয়েছিলো শিশিরের। কেনো বলতে গেলো খামোখা! আম্মু যে কষ্ট পাবে সেটা মাথায় ছিলো না কেনো! সেই থেকে আর কাউকে কিছু বলেনি ও। নিজের মত করে সব সময় পরিস্থিতি গুলো ফেইস করেছে, আঘাত পেয়েছে, কেঁদে কাটিয়েছে অসংখ্য রাত।
এখন শিশির সুস্থ। দাগ গুলোও দু একটা ছাড়া মুছে গেছে সময়ের পরিক্রমায়। এই দু একটাও একদিন থাকবেনা শিশির জানে। কিন্তু মানুষের মনে যে দাগ বসে গেছে সেই দাগ কখনো মুছে ফেলার মত বলে মনে হয় না। এছাড়া ওকে দেখলে বার বার একই প্রসঙ্গ টানার আর কি কারন থাকতে পারে?
শিশিরের হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। শৈশব কৈশোর পুরোটা জুড়ে মানুষের চোখে করুনা, তাচ্ছিল্য আর ঘেন্নার ছায়া গুলো কেনো যেনো কোনো সময়ই ওকে ঠিক থাকতে দেয়না। এলোমেলো করে দেয়। জীবনের ছুঁড়ে দেয়া এই চ্যালেঞ্জটা ও নেয়নি। ইচ্ছে করেই নেয়নি। ও যে কারো করুনার, ঘৃণার পাত্র না, ও যে অনেক যোগ্যতা আর অযোগ্যতার আবর্তে একটা মানুষ সেটা ও জানে ওর সৃষ্টিকর্তা জানে সবাই জানে। চ্যালেঞ্জ নিয়ে অনেক কিছু করে নিজেকে প্রমান করার মধ্যে একটা দাসত্বের ছবি দেখতে পায় শিশির একটা অসহায়ত্ব দেখতে পায়। একটা আর্ত চিতকার শুনতে পায়। সে তো অসহায় না। বরং কিছু অসুস্থ মানসিকতার অসুস্থতার শিকার সে। নিজেকে প্রমান করা! প্রমানিতকে নতুন করে প্রমান করার কি মানে হতে পারে! যাদের মনের দাগ মোছার নয় তাদের জন্য তো আরো না। ব্যর্থতা ওর না। ভাবে শিশির। ওর জায়গায় ও শত ভাগ ঠিক আছে। ব্যর্থতা তাদের যাদের কাছে একটা মেয়ে মানেই আগে নিখুঁত, লোভনীয়, অরনামেন্টেড, চোখ ধাধানো কিছু একটা তারপর হয়তো মানুষের ডেফিনেশনের সাথে মিলিয়ে নিয়ে মানুষ বলা যেতে পারে।
এই ভাবনাটাই শক্তি এনে দেয় শিশিরকে, সব কিছু মোকাবেলা করার শক্তি। আম্মু ডাকছে। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। হাতের কাজ গুলো সারতে সারতে আরেকজন শিশিরের কথা মনে পড়ে। যখন সব দিক থেকেই ওর দুনিয়া ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছিলো যখন শিশির ধরেই নিয়েছিলো একমাত্র মৃত্যুই সব সমস্যার সমাধান তখন একটা মানুষ হাত বাড়িয়ে দিয়ে নতুন করে ওকে ভাবতে শিখিয়েছে। একজন টিচার। শিশির আপু। আদর্শিক ভাবে বৈপরীত্য ছিলো কিন্তু মানুষ কে চামড়া দিয়ে যাচাই করার মত নীচুতা তার মধ্যে ছিলো না। শিশির আপুকে নিয়েও শিশির এর কম কথা শুনতে হয়নি। সবার অভিন্ন পরামর্শ ছিলো শিশির আপুর কবল থেকে ওকে সরিয়ে আনা। কিন্তু ডুবতে থাকা মানুষ তো খড় কুটো হলেও তা নিয়ে বাচতে চায়। সেখানে শিশির আপু ছিলো একটা ভেলা। ক্লাস এইটে পড়ুয়া শিশির ছাড়েনি আপুকে। যারা টেনশনে মরে যাচ্ছিলো তাদের মুখের ওপর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো খুব তো আদর্শের বড়াই করো মানুষ কে যখন চামড়া সর্বস্ব ভাবো তখন আদর্শ কই যায়? শিশির আপু কই আছে এখন কে জানে! যেখানেই থাকুক খুব ভালো থাকুক আপু। খুব খুব ভালো থাকুক।
দ্রুত হাত চালায় শিশির। ক্লাস আছে অনেক পড়া বাকি। ঘুমানোটাও জরুরি। জোর করে ভুলতে চায় সব কিছু। কাজ সেরে চুল আঁচড়াতে আয়নার স্মনে দাড়াতেই গোলাপী একটা কৌটো চোখে পড়ে। খুব শুভাকাঙ্ক্ষী একজন দাগ সারানোর ক্রীম দিয়ে গিয়েছিলেন গত সপ্তায়। মেজাজটা খিচড়ে ওঠে। এই ক্রিম তো ওর রুমে ছিলোনা। কে এনে রাখলো! প্রচন্ড রাগে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দাগ উধাও এর ক্রীমটা। মাথাটা দপ দপ করছে চোখ থেকে গরম পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে যায়। বাঁধা দেয়না শিশির। আর কত? এর শেষ কোথায়? জোরে জোরে দম নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে আরেকটা দিন ওয়েইট করছে। সব গুলো মানুষ নামের চামড়া সর্বস্ব জীব ভেবে রাখছে আগামী কাল একটা দাগওয়ালা মেয়ের সামনে সে কি কি প্রশ্ন ছুড়বে, কি কি করুনা করবে, কতটা তাচ্ছিল্য করবে। আরেকটা লড়াইয়ের জন্য তৈরী হয় শিশির। নিজেকে মানুষ প্রমান করার লড়াই না, মানুষের মনে বসে যাওয়া দাগ মুছে দেওয়ার লড়াই। যারা নিজেদের পরিচয় ভুলতে ভুলতে চামড়ায় এসে ঠেকেছে তাদেরকে মনে করাবার লড়াই, তাদেরকে বলে যাবার লড়াই “মনে করে দেখ তোরা মানুষ ছিলি!”
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)