সাহিত্য

আবেশ

আবেশ
"আম্মু, আমরা আগামীকাল পাহাড়ে বেড়াতে যাব,হ্যাঁ?"
রেনু এক মনে সুতার কাজ করে যাচ্ছে,টগরের কথায় মাথা নাড়ে কেবল! রেনুর সায় পেয়ে টগর আবার বলতে শুরু করে,
- পাহাড়ে উঠেই আমরা একসাথে আইসক্রিম খাবো,তারপর নেমে চলে আসবো বাসায়,বেশি দেরি করলে রিক্সা পাব না,তাই না?  
রেনু মাথা না তুলে আবার সায় দিলো। টগর দ্বিগুণ উৎসাহে কথা বলতেই লাগলো। এক সময় কোন শব্দ না পেয়ে রেনু মাথা তুলে দেখলো,টগর ঘুমিয়ে গেছে। হাত থেকে জামাটা রেখে ছেলের গায়ে কাঁথাটা দিয়ে দিলো,এরপর বিছানা ছেড়ে দেয়ালে হেলাম দিয়ে টুলের উপর বসলো। বাচ্চাটা ঘুমিয়েছে,এবার একটু নিঃশ্বাস নেয়া যাবে! 
এক গ্লাস পানি খেয়ে রান্নাঘরে গেলো,খাবার সব গুছিয়ে,টগরের বাবার জন্য প্লেটে রেখে হাড়ি-বাসন পরিস্কার করে রান্নাঘর টা মুছলো। রুমে এসে ঘুমন্ত ছেলে দিকে তাকিয়ে আবারো নিঃশ্বাস ফেললো। 
রোজ ই ছেলেটা কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাবার গল্প করে,অথচ এই চার বছরে ওকে নিয়ে কারো বাসা ছাড়া কোথাও যাওয়া হয়নি। ছেলে যে এরকম কেবল ওকেই বলে তা না, বাবাকেও বলে কিন্তু বাবাও একই ভাবে এড়িয়ে যায়! 
বছরে দু'বার গ্রামের বাড়ি আসতে যেতেই সারা বছর হিমশিম খেতে হয়,সেখানে কোন পার্ক বা শহরের বাইরে? অসম্ভব! কিন্তু এই ছোট্ট বাচ্চাটার কেন যে এতো ঘুরার শখ! সারাক্ষণ ই তার ভাবনায় আছে,কোথাও বেড়াতে যাবে খেলবে,নানান রকমের খেলনা কিনবে। 
বারান্দা থেকে শুকনো কাপড় গুলো এনে ভাঁজ করগে করতে খেয়াল করলো,ছেলের পায়জামা দুটো ছিঁড়ে গেছে,ভালো আছে আর দুটো। শীত আসি আসি করছে,রেনু দু'মাস আগেই কামাল কে বলেছে,ছেলের জন্য শীতের কাপড় লাগবে,কামালের একটা ভালো জ্যাকেট অফিসে পরে যাবার জন্য। কিন্তু কামাল এখনো কিছু বলেনি।
দরজার শব্দে দ্রুত ছুটলো। কামাল হাত মুখ ধুয়ে এসে ছেলেকে আদর করে দেয়,রেনুর এই দৃশ্যটা অসম্ভব পছন্দের। বড় হয়ে টগর কাউকে না বললেও মনে মনে ঠিকই আনন্দ পাবে,এই স্মৃতিচারণ করে যে, ওর বাবা রোজ বাড়ি ফিরে ঘুমন্ত ওকে আদর করতো। খেতে বসে কামাল বললো,
- শীত তো প্রায় শুরু হয়ে গেলো,আমার পুরনো জ্যাকেট টা সকালে মনে করে দিও তো। রাতে ফেরার সময় লাগে। 
রেনু কিছু বললো না। কামাল আবার বললো,
- আব্বার দাঁত ফিলিং করাতে হবে,প্রায় ৭হাজারের মতো লাগবে। এতো টাকা লাগবে দেখে ডা এর কাছে যাচ্ছে না,ব্যাথা নিয়েই দিন কাটাচ্ছে! ভাবছি বেতন পেয়ে দিব কিছু। 
রেনু আগের মতো ই চুপচাপ। কামাল খাওয়া শেষ করে সেমাইর বাটি নিয়ে রেনুর মুখের সামনে এক চামচ ধরলো,রেনুর একবার ইচ্ছে করলো একটা ঝারি দিতে কষে,আবার মনে হলো,কার সাথে এতো রাগ করবে? সেই তো কষ্ট তার ই! কামালের মুখের দিকে না তাকিয়ে সেমাই মুখে নিয়ে বিছানার এক পাশে এসে বসলো। কামাল সেমাই খেয়ে বাটি চামচ ধুয়ে রেখে এসে বললো,
-চিনি কম দিয়েছিলে? ভালো করেছো! আজকাল মিষ্টি বেশি খাওয়া হচ্ছে। 
রেনু আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক গলায় বললো,
-চিনি শেষ, এক চামচের মতো আছে সকালে ছেলের নাশতা খেতে লাগবে। 
কামাল এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রেনুর দিকে তাকিয়ে বললো,
- তুমি এতোও রেগে আছো কেন? 
-রেগে নেই তবে খুব খুশী থাকতেও পারছিনা৷ স্বাভাবিক আছি। 
কামাল একটু থেমে বললো,
-আগামিকাল, আল্লাহ চাহে তো স্যালারি হবে,আব্বাকে এই মাসের টাকার সাথে দাঁতের জন্য টাকা দিলে কেমন হবে? 
রেনু কোন জবাব দিলো না। কামাল কিছুটা বিরক্ত হলো,এতোও রাগ দেখানোর কি আছে? মাসের শেষ, বাজার নেই ঘরে এটা তো খুব অস্বাভাবিক কিছু না,বেতন পেলে কিনবে। প্রতি মাসেই তো এরকম হচ্ছে। একটু রাগ করেই বললো,
- আব্বাকে বাড়তি কিছু টাকা দিচ্ছি এটা কি তোমার খুব অপছন্দ হচ্ছে?  
রেনু এবারো কিছু বললো না। এটা হচ্ছে ওকে রাগিয়ে দেবার টেকনিক কামালের। ওর অভিমান করে থাকাটা তার খুবই অপছন্দ! রেনুর অভিমান কে কামালের মনে হয়,ভাব দেখানো। 
কামাল কোন জবাব না পেয়ে লাইট অফ করে বালিশ নিয়ে শুয়ে পরলো। শুধু শুধু বসে থাকার মানে হয় না,যেখানে আরেকজনের ভাবের জন্য কথাই বের হচ্ছে না। 
আজকাল খুব ক্লান্ত আর খিটখিটে লাগে রেনুর। সেই বিয়ের পর থেকেই তো নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসার করে যাচ্ছে। বৈচিত্র্যতা বলতে এই ৪বছরের ছেলেটাই একমাত্র৷ যার হাসি,কান্না, বড় হওয়া দেখে রেনু অনেক কিছুই ভুলে যায়। তবে আজকাল টগরের দিকে তাকালেও চিন্তার ভাঁজ পরে! শেষ কবে ডিম খাইয়েছে ওকে মনে পরে না,দুধ? ছেলেটাকে নিয়ে খুব আফসোস লাগে। কামাল কাকে কি দিচ্ছে এই নিয়ে রেনুর কোন কষ্ট বা রাগ নেই কিন্তু ওর ঘরের অভাবটা কামাল আর সে ছাড়া কেউই বুঝার জন্য নেই। বারবার মনে হয়, 
নিজে অভাবের সংসারে বড় হয়েছি, অভাবের সাথেই সংসার করছি,বাচ্চাকেও অভাবেই রাখছি! 
কামাল কি এভাবে ভাবে? কে জানে! কিছু বললেই বলে,তুমি বেশি আবেগ দেখাও! ছেলেপুলে অতো আহ্লাদে বড় করতে নেই,কষ্ট করেই বড় হলে মানুষ হবে। 
এসব কথা ভালো লাগে না রেনুর৷ দায় এড়ানো মনে হয়। বিয়ের পর থেকে চেষ্টা করছে একটা চাকুরী করার কিন্তু কামালের কড়া নিষেধ৷ রেনু তীব্র আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে,একটা সময় আসবে,সেদিন এমন হাহাকার লাগবে না,কামালের সাথে রোজ এই নেই সেই লাগবে বলে কথা কাটাকাটি হবে না,হাতে কিছু টাকা নিয়ে টগর কে বলবে,
-চলো বাবা আজকে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব। খেলনা কিনে দিব! 
চোখ ভিজে আসে কেবল। সেই সময় আর আসে না।  
পরদিন অফিসে যাবার আগে কামাল বলে বাজারের লিস্ট করে রাখতে,সন্ধ্যায় এসে লিস্ট নিয়ে বাজারে যাবে,কোন অপ্রয়োজনীয় জিনিস যেনো না লিখে,যা না হলেই না সেটাই শুধু লিখবে। রেনু মাথা নাড়লো। 'না হলেই না' 'অপ্রয়োজনীয়' এসবের কি কোন ধারা বাধা সংগা আছে?
বিকেলে টগর পাশের বাসার বাচ্চাটার সাথে খেলতে যেয়ে মুখ কালো করে ফিরে আসলো। জিজ্ঞেস করলো রেনু,কিছু বলে না। বিছানায় শুয়ে আছে! সে কি অভিমান ছোট্ট মুখটা জুড়ে। রেনুর ভেতর‍টায় ঢেউ উঠে। 
-বাবা কি হয়েছে আমাকে বলো,প্লিইইজ! 
- সাবিতরা বেড়াতে যাবে, শিশু পার্কে তাই খেলবে না আজকে। আমি বলেছি,আমিও যাব শিশুপার্কে ও আমাকে বকা দিয়েছে! বলেছে,তুমি কোথাও যেতে পারবে না,যাও! 
বলতে বলতে চোখ ভিজে গেলো টগরের।
-মা আমরা কবে শিশুপার্ক এ যাব? বাবা নিয়ে গেলো না তো!
রেনু কাঁপা হাতে বাচ্চাকে জড়িয়ে আদর করলো। কিছু বলতে পারলো না। মনে হচ্ছিলো,সে মা না হয়ে টগরের বাবা হলেই ভালো হতো,এসব সময় থেকে পালিয়ে বাঁচা যেতো। নিজের কান্না চেপে বাচ্চাকে আদর করলো। 
এরপর বললো,
-চলো টগর,আমরা বাইরে থেকে হেঁটে আসি৷ 
সাথে সাথেই কান্না থেমে গেলো টগরের,কিছুটা সন্দিহান ভাবে তাকালো,মা কে তৈরী হতে দেখে আশ্বস্ত হলো। 
শহরের একদম শেষ প্রান্ত থেকেও বেশ ভেতরে রেনুদের বাসা। মানুষ আশেপাশে থাকলেও নিরাপদ না,কোন না কোন ঝামেলা লেগেই থাকে। অনেকটা এই কারণেই,টগরকে বাসা থেকে বের হতে দেয় না আর রেনুও একা বের হতে সাহস পায় না,কামালের ও কড়া নিষেধ। কিন্তু আজ সাহস করেই বের হলো। 
দুয়া পড়ে ছেলের হাত ধরে বাইরে এসে রেনুর কেমন অদ্ভুদ লাগা শুরু হলো৷ খুব কঠিন কিছু কি সে করেছে? গাছগাছালি ঘেরা একটা জায়গায় এসে রেনু দাড়ালো,রাস্তাটা এখনো পিচঢালা হয়নি। টগর আস্তে আস্তে গাছ গুলো ধরে হাটছে,সেও কিছুটা অপ্রস্তুত কিন্তু ভালো লাগছে। একটু একটু করে প্রশ্ন করতে লাগলো,আশেপাশে দেখতে লাগলো। হাটতে হাটতে ওরা মেইন রোডের কাছাকাছি চলে এসেছে,হাল্কা বাতাস আর দিনের শেষ সময়টা বেশ ভালো লাগছে। 
সন্ধ্যে হয়ে আসছে প্রায়,রেনু এবার ছেলেকে বললো,
- চলো,বাসায় যাই। 
-আমরা কি আরেকদিন আসবো? 
-হু 
টগর একটা হাসি দিলো মায়ের দিকে তাকিয়ে। রেনুর ভেতরটা পূর্ণ হয়ে গেলো যেনো। এক হাতে বাসার চাবি আরেক হাতে টগরের ছোট্ট হাত। রেনুর ভেতরে একটা ভালো লাগার আবেশ জমেছে,সেই আবেশটা হারাতে চাচ্ছে না। টগরের জন্য,নিজের জন্যেও। 
#ছোটগল্প 
 

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন
তিনকোণা শত্রু

তিনকোণা শত্রু

Women Express

৪ এপ্রিল ২০২৩

So, if you wishing...

So, if you wishing...

Women Express

১৫ মার্চ ২০২৩

টুকরো কথন-৩

টুকরো কথন-৩

Women Express

৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩