সাহিত্য

কবি ও কবিতা: আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম

কবি ও কবিতা: আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম

ফুল না ফোটা সময়ে সেইসব হৃদয়ের ভাষা

এই কবিতারা কবিতা যেমন সেই সঙ্গে প্রতিবাদলিপি, শোষিতের দাবী আদায়ের সাথে সংহতিপত্র । লেখা হয়েছে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে। সে তো ছিল এক ভীষণ রক্ত পিচ্ছিল যাত্রা। প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু এবং বাস্ত্যুচ্যুতির কারণ। প্রচণ্ড নাগরিক বৈষম্য, অসমতায় জ্বলে ওঠা বিক্ষোভের আগুন নেভাতে অগণন সংহার সাথে সুদূর বিস্তৃত নিপীড়ন ছিল সে যাত্রার রীতি।

উপনিবেশবাদ- উপনিবেশবাদী কানুনে, তীব্র এবং তির্যক প্রভেদে কিংবা হত্যার অনুজ্ঞায় কখনো অকপটে  কখনো সুররিয়েলিজমে বুদ্ধিজীবি, লেখক, শিল্পীরা তাদের বিদ্রোহের জানান দিয়েছিলেন। ফরাসি এবং আলজেরিয়ান এই দুই ভিন্ন রক্ত বয়েছে যাদের শরীরে, দুই সম্প্রদায়ের মানুষের হাতেই উঠেছিল কলম; যত্নের সুক্ষ্ম কাজে মূর্ত হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের ভাষা। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভুত ফ্রেঞ্চ মনোবিদ এবং রাজনৈতিক দার্শনিক  ফ্রঁ ফানোর ‘দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ’এ ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে উপনিবেশনের মনস্তত্ত্ব।  জ্যঁ সিন্যাক, কাতেব ইয়াসিন, মোহাম্মেদ দিব, ওমার আল বেরুনী কিংবা জ্যঁ মৌহুব আমারোশ যেমন লিখেছেন- কথা বলেছেন তেমনি শিমোন দ্য বোভোয়ার, জ্যঁ-পল সার্ত্র, লুইস আরাগ্যোঁ, জ্যাক গুশর‍্যোঁ ছুঁড়েছিলেন ভাষার তীক্ষ্ণ ছোড়া। সার্ত্রকে তো অন্তত দু বার ফরাসি প্যারামিলিটারি সংস্থা  OAS ( Secret Armed Organisation) হত্যার পদক্ষেপ নিয়েছিল।

তাছাড়াও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকেও প্রতিবাদ প্রতিরোধের সে আওয়াজ শোনা গিয়েছে। ‘৬২ তে আলজেরিয়া স্বাধীন হবার পরেও সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে প্রেরণা দিয়েছে যুদ্ধ কবিতা অথবা অন্যান্য হৃদয় ঘনিষ্ঠ সৃষ্টি।  সেক্ষেত্রে ইতালিয়ান নির্মাতা জিলো পন্তেকোর্ভোর ‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’র নাম উচ্চারিত হতেই হয়।

ফ্রঁন্সিস কম্ব্যের সম্পাদনায় ১৯৫৪ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত চলা আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে রচিত কবিতার সংকলন ‘Poets and The Algerian War’ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন অ্যালান ডন্ট। 

 

কবিতায় প্রতিরোধ- প্রতিরোধে স্বপ্নগুচ্ছের ডালপালা

 ।।১।।

ফরাসি কবি গ্যাব্রিয়েল কুয্যাঁ একানব্বই বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯১৮ সাল থেকে ২০১০ অবধি দীর্ঘ জীবনে পর্যবেক্ষণ করেছেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রক্তাক্ত সংঘাত। আলজেরিয়ার উপনিবেশ থেকে মুক্তির লড়াইয়ের পক্ষে থাকা এই কবির শিরোনাম খুঁজে না পাওয়া কবিতাটিতে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য মানসিক উৎকণ্ঠার একরকমের তাগিদ লক্ষ্য করা যায়। 

 

মরিস অদ্যাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী চোখ রাখেন নৈশব্দে

জামিলা বুহির্দ প্রতদিন সকালে আকাশে কান পাতেন

আর তুমি প্রিয় সহকর্মী

ওহ! আমি, জানোতো এ বছর ইস্টারে তাস্কানি যাব ভাবছি

সিয়েনার মাটি ওরকম রক্তবর্ণাও তো নয়

 

স্প্যানিশ মিযেরি কী বিপুল রহস্যের

এবং তুমি?

ট্রাউট, ট্রাউট, নিস্তব্ধতা। জলের গুচ্ছকেশ

যেন মন্থর বিশ্বস্ত পরিচয় কোন মানবীর সঙ্গে

 

আ, কবে আমার স্বদেশের জনগণ

সম্মানিত জনগণ, অবশ্যই...

উদ্বেগের সামান্য বীজ গ্রহণ করবেন?

অসহনীয় জুলুমের মনস্তাপকে এইটুকু অস্থিরতা ঠিক পেলে পুষে বড় করে তুলবে

  • মরিস অদ্যাঁ ছিলেন আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক। নিষিদ্ধ ঘোষিত আলজেরিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টি( PCA) সদস্য মাত্র পচিশ বছর বয়স্ক মরিস অদ্যাঁকে আলজেরিয়ার আন্ডারগ্রাউন্ড গেরিলা গোষ্ঠী ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (FLN) সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেফতার এবং গুম করা হয়। ২০১৮ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ কমরেড অদ্যাঁকে ঔপনিবেশিক আইনে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা অথবা ফাঁসি দেয়ার ব্যপারে এক স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন।
  • জামিলা বুহির্দ তখন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের একজন নারী সদস্য। আলজেরিয়ান রক্ত যার শরীরে বইলেও উপনিবেশবাদের আগ্রাসী নীতির কারণে বেড়ে ওঠা ছিল ফরাসি ভাষা সংস্কৃতির ছায়ায়, আত্মপরিচয় ভুলে যাবার নিষ্ঠুর নিয়মের ভেতর। এফএলএনের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু শুরুতে কেবল ছিল ফ্রেঞ্চ আর্মি এবং পুলিশ; আলজেরিয়াতে বসবাসরত কোন ইউরোপিয়ান সেটলার ছিল না। তবে ফ্রেঞ্চ ফোর্স (উল্ল্যেখযোগ্য সংখ্যক নেটিভ মুসলিম আলজেরিয়ান; যাদের হার্কি বলা হয় তারাও দখলদার সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা করত) এবং সেটলারদের বেশুমার বেসামরিক আলজেরিয়ান আক্রমণ- হত্যার প্রতিক্রিয়ায় এফএলএন তাদের নীতি পরিবর্তন করে। যার ফলে এই গ্রুপগুলোকে লক্ষ্য করে গঠিত ডেথ স্কোয়াড স্বেচ্ছাসেবকদের একজন ছিলেন জামিলা। হামলা, আত্মগোপনের এক পর্যায়ে মাত্র বিশ বছর বয়সী জামিলা গ্রেফতার হন,মুখোমুখি হন ভয়াল নির্যাতনের। গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তাকে। তবে প্রবল আন্তর্জাতিক চাপে জামিলাকে যাবজ্জীবন কারাবরণের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯৬২ তে আলজেরিয়া স্বাধীনতা লাভ করলে জামিলা বুহির্দ অবশেষে কারামুক্ত হন।  

।।২।।

 

আলজেরিয়ান সংগ্রাম’ কবিতাটিকে হরফের মিছিল বলাই যায়। এক একটা পঙক্তিতে কবি জ্যঁ এল মৌহুব আমরোশে উচ্চারণ করলেন এক একটা শ্লোগান।

 

তারপর সেই দুর্দান্ত ঐতিহাসিক মুহুর্ত এলো

এক পাল অদম্য সন্তান কোলে নিয়ে

আরও সাথে নিয়ে এলো বিশুদ্ধ ক্রোধের প্রবল বজ্রধবনি

আমরা আর প্রতারিত হব না

আর কোন শঠতার লক্ষ্যবস্তু হব না

আমাদের আর কেউ বিশ্বাস করাতে পারবেনা

পূর্ণ চাঁদের জন্মটা ওই লাল, নীল আর সাদা পনিরে

…………………………………………

………………………………………….

 

আমরা আমাদের পিতার স্বদেশ চাই

আমাদের পিতার জবান

আমাদের দোলনা আমাদের কবরকে জড়িয়ে রাখবে

আমাদেরই স্বপ্ন এবং সঙ্গীতের স্বর- মাধুর্য

আমরা আর কোনদিন কোন নির্বাসনে চরে বেড়াতে চাইনা

…………………………………………………

…………………………………………………

 

এখানে এবং এখন

আমরা উন্মীলিত সূর্যের নীচে খোলা হাওয়ায়

মাতাল বৃষ্টিতে কিংবা হতে পারে সফেদ তুষারে  চিরমুক্তি চাই।

 

আমাদের জন্মভুমি- স্বদেশ আমাদের

আলজেরিয়া

 

।।৩।।

 

পৃথিবীকে  বলবার অধিকার

মালেক হাদ্দাদ

 

তরঙ্গ তুমুলে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের মত সমূহ চিন্তা 

দ্বিধারা আটকে গিয়েছে প্রশ্নের নির্বাসনে 

নীতিকথাও টুকরো রুটির মত ঢালাই হয়েছে ছাঁচে

কিংবা কোন বন্ধুসুলভ হাতের প্রাপ্য উষ্ণতায়।

 

 

শব্দগুচ্ছ বেছে নিল কেউ , একটা শব্দ তুমি কারো জন্য ভুলে গিয়েছিলে

আমি বলেছিলাম প্রেম তো কিছুইনা দর্প কেবল

সুদীর্ঘ সময় ধরে গোলাপেরই চাষে দেখা দিল গাছ বিছুটি

আহা দেবদারুদেরও নির্মম মৃত্যুদন্ড হল  

 

বরং  অগণিত মোম জ্বলেছিল

উত্তুরে রাতে

বালুর দুর্গ থেকে ওপরে তাকালে কোন নক্ষত্র  ছিল না সেখানে

 

তবুও

তুমুল তরঙ্গের স্পর্শ লাগা পাথরের মত  ক্ষয়িষ্ণু চিন্তা 

 প্রশ্নে নির্বাসিত আমাদের সমস্ত দ্বিধা

 

অথচ আশ্চর্য  কাফন জড়িয়ে উপলব্ধ কিংবা 

 নিদারুণ শৈত্যের  নিন্দামুখর এক একটা শরীর। 

 

 

আলজেরিয়ান কবি মালেক হাদ্দাদ আরও লিখলেন,

 

এবং শান্তির প্রত্যাবর্তনে

পায়রাটি বুঝি বলে উঠবে

আমি আর শান্তির ডুমুর সরবরাহে নেই

আবার আমি ঠিক একটি পাখিই হয়ে গিয়েছি

 

।।৪।।

মাদালেইনে রিফ্যঁ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইকালে গ্রেফতার- কারাবন্দী হয়েছিলেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এই নারী কবি।পরবর্তীতে তিনি আলজেরিয়া এবং ভিয়েতনাম সংগ্রামের স্বপক্ষে অবস্থান নেন। OAS মাদাম রিফ্যঁর বিরুদ্ধেও গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল তবে তিনি সে যাত্রায় প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছিলেন।

 

তারা আগুনে, পানিতে, বিদ্যুতে মেরে ফেললো

বসন্ত থেকে দূরে- বহুদূরে আবাস ছিল যাদের

সারাটা জীবন কেটে গিয়েছিল জলের স্বপ্নে

অঙ্গার না পেয়ে কেবলই কাঁপতো যারা

মৌলুদের হিমায়িত সূর্যের নীচে

 

তীব্র অন্ধকারে জেগে ছিল

বিষাদের গুমোট বস্তিতে যাদের গোর হয়েছিল

 

এক জীবনে প্রথমবারের মত দেখতে পেয়েছিল হায়

গোসল

খুব কাছ থেকে

জীবনের সবচাইতে শেষের দিনটিতে

 

  • আলজেরিয়ান লেখক মৌলুদ ফেরাউন। লিখতেন ফরাসিতে। বিউপনিবেশন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থনের দায়ে স্বাধীনতার বছরটিতে মার্চে মৌলুদ ফেরাউন OAS কর্তৃক গুপ্তহত্যার শিকার হন।

 

 

( লেখাটি "অন্য এক দিগন্ত" তে প্রকাশিত)


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)