
সাধারণত দুপুরে ক্লাস দিলে খুবই হয়রান হতে হয় সুম্বুলাকে। কারন একটাই। লোকাল বাসে করে যাওয়া আসা করা যে একজন মেয়ের জন্য কি পরিমাণ রিস্ক সেটা সে ই জানে। দুপুরে ভার্সিটির বাস আপ ট্রিপ দেয়না।
আজ যথারীতি সেই টাক ভদ্রলোকের ক্লাস, তাও বৃহস্পতিবার দুপুর বেলা। সে কি প্রচণ্ড জ্যাম ঢাকার রাস্তায়।
একেকটা লোকাল বাসের যাত্রীদের বিশেষ করে পুরুষদের আচরণ একেক রকম। এই যেমন- মহিলা সিট খালি থাকতে কেন ভালো ভালো সিটে বসলেন এটা অবশ্যই বিরাট একটা অন্যায় কাজ। এরপর যদি ভদ্রতা দেখিয়ে পুরা খালি বাস ফেলে মহিলা সিটে বসেন ও, ড্রাইভার ব্যাটা ২ চক্ষু আর ৪ পাতা খুলে চাইয়া থাকবে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু অবলোকন করবে।
এতেই শেষ না। যে কোন স্টপেজে থামলে সে বারবার তাড়া দিতে থাকবে আফা! কই নামবেন!
যেন মহিলা নেমে গেলেই তার কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
আর সাধারণ সিটে বসার ও বিশাল বিশাল অশান্তি তো আছেই। কিছু কিছু সিট আছে যেগুলোর পিছন সাইডে হালকা ফাঁকা থাকে। একদিন সুম্বুলা আর তার এক বান্ধুবি বলাকায় করে উত্তরা যাচ্ছিলো। হটাত সুম্বুলার বান্ধুবি চিৎকার করে উঠলো! সুম্বুলার কানে কানে বলল- পিছনে লুঙ্গি পড়া বাবার বয়সী লোকটা সিটের ফাঁকা যায়গা দিয়ে খুব বাজে একটা কাজ করেছে, যা সুম্বুলাকে বলার কোন ভাষাই সে খুঁজে পাচ্ছেনা।
সুম্বুলা বরাবর প্রতিবাদী মেয়ে। ঐ লোককে ঝাড়া শুরু করলো।
- ঐ মিয়া! বস্তি থেকে আসছেন নাকি? মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের সাথে এসব করেন? ইতর চামার কোথাকার
- এই মেয়ে মুখ সামলে কথা বোলো! বাপের বয়সী মানুষ দেখছ না?
- বাপের বয়সী দেখেই তো বলছি! এই বয়সেও শুধরাতে পারলেন না? লোফার গিরি করে বেড়ান! ছিঃ
এবার বাসের সমস্ত লোক সমস্বরে চিল্লিয়ে উঠে সুম্বুলা আর তার বান্ধুবিকে বলল- তোমাদের ই চরিত্র খারাপ। এমন মুরুব্বির নামে উল্টা পাল্টা কথা বোলো। বেয়াদব! আরও অনেক বাজে বাজে কথা!
সুম্বুলা রাগে দুঃখে কেবল ফোঁস ফোঁস করে। কি বিপদ! একটা মানুষ ও লোকটাকে একটা উচিৎ বিচার করলো না!
এরপর থেকে লোকাল বাস সুম্বুলার অ্যালার্জি হয়ে গেছে। নিতান্ত নিরুপায় না হলে সে উঠে না। সেদিন সাবিহা এসে বলল- জানো! আপু !৮ নাম্বার বাসে সিটে বসে ছিলাম! একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। গায়ের সাথে ঘেঁষে সে কি নোংরামি করলো! এদের কি কোন মা জন্ম দেয়নি?
আজ আবার সেই দুপুর বেলা ক্লাস। লোকাল বাসে গুলিস্তান যেয়ে রিক্সা নিয়ে কার্জন হল চলে যাবে। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল সে। পুরা খালি একটা বাস। সিট গুলো ও মোটামুটি খারাপ না। একটা সিটে বসে দরকারি কলগুলো করে নিচ্ছিল সুম্বুলা। এর মধ্যে বাস একটা যায়গায় থামল। একজন ৩০/৩৫ বছর বয়স্ক পুরুষ উঠলেন। তিনি পুরো খালি বাস খালি রেখেই সুম্বুলার পাশে এসে বসলেন।
এসেই চাপা শুরু করলেন। সুম্বুলা অনেক কষ্টে গা বাঁচিয়ে বসে রইলো গুটিসুটি হয়ে। জীবনে বাসে হওয়া অপমানের ব্যাপারে এতো ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে যে এখন আর কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছা করেনা। রাস্তায় সত্যি ই অনেক জ্যাম। আর গুটিসুটি হয়ে বসতেও ভারি কষ্ট হচ্ছে তার। গাড়ি নাট্য মঞ্চের সামনে দাঁড়ালে সুম্বুলা অনেক হাটতে হবে দেখেও নেমে পড়ে।
হাটতে হাটতে দেখে নাট্য মঞ্চের ফাঁকা মাঠে কতক মহিলা সামান্য প্লাস্টিক বিছিয়ে শুয়ে আছে এই মধ্য দুপুরে।
সুম্বুলা একবার নিজেকে তাদের যায়গায় ভাবে। নাহ! আর ভাবা যায়না! এরাও তারই মতো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ!
হাটতে হাটতে দেখে, একজন ছোটখাটো মহিলা উপর হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। বেচারি প্রতিবন্ধী।
আহারে! একদম ৪ পেয়ে জীবের মতো পড়ে আছে সে। খুব কষ্ট লাগলো দেখে। এতো সুন্দর ভাবে পর্দা করেও পথে ঘাটে যদি এতো বাজে বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাহলে এই নারীর জীবন কেমন! ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে সুম্বুলার। তার সামনে বেশ কিছু টাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বোধ হয় , এগুলো গুছানর শক্তি ও তার নেই। সুম্বুলা ভাবে তাকে কিছু টাকা দিবে। দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে পার্স নিয়ে টাকা দেয়। এরপর আনমনা হয়ে জায়।হটাত পিছন থেকে কে জানি বলে ওঠে-
"এই মাল! খারা!"
সুম্বুলা একটু অবাক হয়ে গেলো। কথাটা কি কেউ তাকে উদ্দেশ্য করে বলল। এই সময়ই সে বোকামি টা করলো। পিছন ঘুরে তাকাল। আসিয়ান বাসের ড্রাইভার তার দিকে ৩২ দাঁত ভেটকে চকচকে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে আছে।
সুম্বুলা হতাশ হয়ে যায়। সমাজটা এতো খারাপ হয়ে গেছে। যেমন এই পুরুষগুলো খারাপ , মেয়েগুলো ও কম না । এই যে ফ্ল্যাশ মব, বিজ্ঞাপন কিসে নেই নারী! নারীকে এতো সহজলভ্য করে তুলেছে নারীরাই। কিন্তু, সম্মান বজায়ে রাখার অনুভূতি নেই বলে তারা আজ নিজেদেরকে মালে পরিণত করেছে। যার ফলে, আজ শালীনতার ভূষণেও কারো কিছু যায় আসেনা।
দ্রুত কার্জন হলের উদ্দেশ্যে রিক্সা নেয় সুম্বুলা। ভাড়া চুকিয়ে নামছে রিক্সা থেকে এমন সময় এক বিউটি কুইন খুব সাজু গুজু করে একদিক থেকে আসছে, আর তার ছেলে বন্ধুরা আরেক দিক থেকে বলছে- আজকে সিমিরে এক নাম্বার আইটেম লাগতেছে! সিমি! লুকিং নাইস! লাইক আ পিস ইয়ার! সিমি নামক মেয়েটির তেমন কোন বিকার নেই, সে হাসছে, মধুর হাসি।
সুম্বুলা বুঝল! নিজেকে পিস বলা আর শুনার অনুভূতিটা একেক জনের কাছে একেক রকম! অন্যদের কেন তাদের জন্য এভাবে ইভ টিজিঙের শিকার হতে হয়!
নিঃশ্বাসে মিশে যায় সুম্বুলার অপমান বোধের যন্ত্রণা।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)