উইমেন (সামাজিক,মানসিক,সুবিধা বঞ্চিত নারী)

ভাই বড়ো ধন, রক্তের বাঁধন!

ভাই বড়ো ধন, রক্তের বাঁধন!
জন্মদাতা বাবা আর গর্ভধারিণী মা, এই দুইয়ের পর সবচেয়ে মিষ্টি শব্দ হল, ভাই অথবা বোন। এ এক অদ্ভুত বন্ধন। উৎস এক, তাই নাকে, চোখে, কথায়, এমনকি স্বভাবেও দৃশ্যমান মিল থাকে ভাইবোনের। বেড়ে ওঠার গল্পগুলো আরও সুন্দর। কেউ বাবামায়ের কাঁচা চুল আর যৌবনের সন্তান, কেউ আরেকটু বেশি বয়সের। কো্নো ভাইবোন জ্ঞান হয়ে আর বাবামায়ের কাঁচা চুল দেখতেই পায় না, বড়দের কাছে শুনতে পায় শুধু। শুরুর দিকে এক দুইজন হয়ত দাদা দাদী নানা নানীদের যত্ন পায়, বাকিরা গল্প শোনে। একই ঘরে, একই তাপমাত্রায়, একই যত্নে কিংবা একজন আরেকজনের যত্নে বেড়ে ওঠার এই সম্পর্কের নামই ভাইবোন। এ নিয়ে তাই গল্প সিনেমাও হয় অনেক। বহুদিন পরে মেলায় হারানো ভাইবোন খুঁজে পেলেও মাঝের দীর্ঘ বিচ্ছেদে সম্পর্কের সুতো কাটে না এ সম্পর্কের।
সংজ্ঞা আর সম্পর্কের ধরণ তো হল। বড় হয়ে বিয়েশাদির পর এই সম্পর্কটার ধরণও বদলে যায়। সম্পর্কের সুতো তখন দুজন মহিলার হাতে। বোন আর ভাইয়ের বউ। এ দুজনের কাঁটা ঘোরানোতে সম্পর্কও ওঠে-নামে। হ্যাঁ, বাবামায়ের ভূমিকা থাকেই। মানুষ আবেগ, মমতা দিয়ে যেমন তৈরী, আবার তার মধ্যে পক্ষপাতিত্ব নামের দুষ্টু ভাইরাসও আছে।
ভেবে দেখি, ওই যে দুই মহিলার একজন যখন আমি, আমার কর্তব্য কি? মাথার ভেতর কেবলই ঘুরপাক খাওয়া কথাগুলোকে জীবনের রসে ডুবিয়ে লিখে ফেললামঃ
এক। ভাইয়ের বউ কিংবা ননদ-ননাসের সাথে আমার কোন অবশ্যকরণীয় কর্তব্যের জায়গা নেই। এমনকি তাঁদের সম্পত্তিও আমার হাত দিয়ে যাবার দরকার হয় না। এ সম্পর্কের সবচেয়ে আশ্বস্তকর দিক এটাই। এখানেও করণীয় আছে, লেখার শেষে একটা গল্প বলব।
দুই। আমার বাড়িতে কেউ বেড়াতে আসলে তিন দিন পর্যন্ত আমার সাধ্যমতো তার জন্য সমাদরের ব্যবস্থা করা আমার দায়িত্ব। সে হিসেবে প্রস্তুতি রাখতে সমস্যা নেই। সমস্যা অন্য জায়গায়, ‘ওর বাড়ি আমাকে যেতে বলে না’, ‘আমি গেলে আমাকে সমাদর করেছিলো?’, ‘আমার মায়ের সাথে কেমন করে ব্যবহার, আর আমি করব তাকে আদর?’। অতি জটিল এক মন মানুষের। দুটো কথা মনে রাখলে এই সম্পর্কের যত্ন করাটা সহজ হয়। প্রথমতঃ পাওয়ার আগে দেয়ার কাজ যে করে, তার হাত থাকে উপরে, অনেক উপরে। তাকে কেউ ছুঁতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ কারুর প্রতি ইহসান দেখানোর পেছনে কারণটা ঝালাই করে নেয়া। কেন করি? ভাই বা হাজবেন্ডের প্রিয় হতে চাই? নাকি এর বিনিময়ে আমিও সমাদর পেতে চাই? উহুঁ। আল্লাহর কাছে চাই। মানুষের কাছে পাবো- এই আশা করে করে সমুদ্র শুকিয়ে করলেও কেউ খুশী হবে না জানেন? সুতরাং সাধ্যের শেষটুকু দিয়ে করে হাতটা কাপড়ে মুছে সেই হাতেই চাই, এর বিনিময় আপনিই দিয়েন গো আল্লাহ! মজার ব্যপার হল, আল্লাহর অফুরন্ত ভান্ডারে ‘ফিদদুনিয়া হাসানাহ’ কম নেই কিন্তু। একটা চাইলে দুইটাই পাই, উপরন্তু না পেলেও মন খারাপ হয় না।
তিন। দুই ধরণের সম্পর্ক নিয়ে সাবধানবাণী আর সতর্কতার ইঙ্গিত আছে। রক্ত সম্পর্ক টুটে গেলে জান্নাতের দুয়ার বন্ধ। আবার, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক জুড়ে দিতে মিথ্যে কথার মত কবিরা গুণাহও সহ্য করে নেন আল্লাহ। ভেবে দেখেছেন?
ভাবী হিসেবে আমার কাজ, আমার হাজবেন্ডকে সতর্ক করা। নিজের বোনের প্রতি দায়িত্ব থেকে যেন পিছপা না হয়। হ্যাঁ, আমিও তার কর্তব্যের একটা জায়গা। সেকথা তো জানবেই। জানাবোও হয়ত। সেটা বোনের প্রতি দায়িত্বে অবহেলা করে নয়। সাধ্য আর প্রয়োজনমতো অর্থ, যোগাযোগ বজায় রাখা ভাইয়ের কাজ। সে যেন এখানে পিছিয়ে না যায়। তাকে যেন এ কাজ আমার অপছন্দের ভয়ে লুকিয়ে করতে না হয়। বাবার সম্পত্তিতে বোনের ভাগ যেন ঠিকমতো বুঝিয়ে দেয়। নইলে কিয়ামতের দিন আমার প্রাণপ্রিয় হাজবেন্ডকে কাঁধে মস্ত জমির মাটি সহ উঠতে হবে যে! স্বার্থ তো আমারও কম না। সতর্ক করি, সাবধান করি, উৎসাহ দিই। কেন? তাহলে আল্লাহর কাছে আমিই পাবো। ওখানে ভাগাভাগি হবে না একদম।
আর ভাইয়ের বেলায়? জ্ঞানতঃ ভাই-ভাবীর সম্পর্কের মধ্যখানে ফাটল ধরিয়ে দেয়া, একজনের কাছে অন্যজনের বাজে ব্যপার দেখিয়ে দেয়া, বাচ্চাদের যত্ন (আমার দৃষ্টিতে) যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে অভিযোগ করা, নিজে না বলে মা’কে দিয়ে ভাইকে এইসব বলানো, মারাত্নক অপরাধ। এ সব নিচু কাজের খাতায় কিছুতেই নাম লেখানো যাবে না। সাময়িক কিছু লাভ হয়ত হবে, কিন্তু আমি উপরওয়ালার গুডবুকে আর থাকবো না, আর দুনিয়ার কিছু লোক আমার মনের কালো দেখে ফেলবে। কি মারাত্নক লজ্জা! যে সম্পর্ক জুড়তে মিথ্যে পর্যন্ত বলা যায়, সে সম্পর্কে চুল পরিমাণ দুরত্ব এনে দেয়া কত বড় অপরাধ, তাদের জন্য কত কষ্টের ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন।
চার। বাচ্চাদের জন্য দুনিয়াটা শেখার জায়গা। আমাদের বড়দের রেষারেষিতে বাচ্চারা যেন ঢুকে না পড়ে, এটা নিশ্চিত করা আমাদেরই কাজ। আমার কাছের মানুষকে দেখেছি, ননদের দুর্ব্যবহার চোখের পানিতে ধুয়ে বাচ্চাদের দিয়ে ফুফুর বাসায় নাশতা পাঠাতেন। বাচ্চাদের কাছে যেন তাদের ফুফু, চাচা, মামীরা আদরের থাকেন, এটা নিশ্চিত করে যাবো। এখানেও ব্যপার আছে। যদি অপর পক্ষের সহযোগিতা না থাকে, হয়ত অনেকদূর এগোনো যাবেও না। কিন্তু একটা খাতায় আমার নামে আমার চেষ্টাগুলো লেখা থাকবে।
পাঁচ। ইসলামে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা নেই। বেশ। এক বাড়িতে লতায়পাতায় জড়িয়ে থাকাটা আধুনিক মানুষ এমনিতেই পছন্দ করে না। কিন্তু উৎসব অনুষ্ঠান, বেড়াতে আসার বেলায়? সাধ্যমত যত্ন করবো, আল্লাহর কাছে পাওয়ার জন্য করব, কিন্তু যত্ন করতে গিয়ে আল্লাহর দেয়া সীমানা আবার মাড়িয়ে দেয়া যাবে না। ননদের জামাই, ভাসুরের ছেলে, এদের বুঝিয়ে দেয়ার কাজটা করতে বা করাতে হবে। ঘরে আসতে বলে আসবে, মেয়েদের ঘরে ঢুকে পড়বে না। আমি একজন মামীকে দেখেছি, ননদের ছেলে বড় হলে পরে বুঝিয়ে বলেছেন। একজন ভাবীকে দেখেছি, তিন দেবরকে চুলার পাশে বসিয়ে পিঠা বানিয়ে দিতেন, ওদের সামনে একটা খাটো পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। আজকার শহরের বাসায় তো আরও সহজ এই ব্যপারগুলো। রুমের দরজায় দরজায় বাহারি পর্দা ঝোলে। প্রাইভেসি রাখা এখন শুধু ইচ্ছের ব্যপার। শুধু যেন, প্রাইভেসি রাখার অজুহাতে আমরা আমাদের প্রিয়জনদের তাঁদের রক্ত থেকে দূরে না রেখে দিই। আমাদের মেয়েদের অনেক বড় ভূমিকা আছে এই সম্পর্কগুলোকে গুছিয়ে দেয়ার পেছনে।
লোকে বলে, মেয়েরাই নাকি মেয়েদের শত্রু? কারণ আত্মসম্মান নামক জিনিসটা মেয়েদের মধ্যে তৈরিই হতে দেয়া হয় খুব কম। আসুন না, আমরা দেখিয়ে দিই, আত্মসম্মানবোধ বা আত্মমর্যাদাবোধ মেয়েদেরকে স্বেচ্ছাচারী নয় , বরং মানবিক করে তোলে অনেক অনেক বেশি। চারপাশে তাকান, অনুসরণ করার মত অজস্র উদাহরণ পাবেন। হেডিং এর প্রবাদটার পরের লাইনটা যেন মিথ্যে হয়ে যায়। ‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন, যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ’ এ এক নির্লজ্জ মিথ্যে দোষারোপ, এটা প্রমাণের দায়িত্ব মেয়েদেরই।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ