সাহিত্য

ফুটিয়া ছিনু মোরা একই বৃন্তে......

ফুটিয়া ছিনু মোরা একই বৃন্তে......
ফজরের নামাজের পর কুরআন তিলাওয়াত সেরে আবারো ঘুমানোর অভ্যাস সাবিরার। অবশ্য অভ্যাস না বলে বদভ্যাস বলাই ঠিক হবে। কারণ এই ঘুমের জন্য অনেক কথা শুনতে হয় তাকে পরিবারের বিভিন্ন জনের কাছ থেকে। যদিও সেসব কথাতে সাবিরার কিছু এসে যায় না। তার নীতি হচ্ছে, যেই কাজ সে করবে না সেই ব্যাপারে কারো কথার প্রভাব নিজের উপর পড়তে না দেয়া। মানুষের কথা শুনতে শুনতে নিজস্ব সত্ত্বা বলেই আর কিছু থাকে না মেয়েদের। নিজের জীবনকে নিজের মত করে উপভোগ করার কিছু অংশও থাকা উচিত প্রতিটা মানুষের জীবনে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের সারাটা জীবন চলে যায় অন্যকে খুশি করতে। অথচ অন্যেকে খুশি করার জন্য নিজের মনে যে সুখ থাকা যে শর্ত সেই কথা কেউ বোঝে না। যাইহোক, কেউ বুঝুক বা না বুঝুক সাবিরা বোঝে এবং মেনেও চলে। কুরআন তিলাওয়াত শেষ করে উঠার পর পানি পিপাসা লাগলো খুব সাবিরার। বাধ্য হয়েই তাই পানির সন্ধানে রান্নাঘরের দিকে রওনা করলো। ঢুকতেই চোখে পড়লো ছোটবোন মাহিরা জানালা খুলে বাইরে  তাকিয়ে আছে। সাবিরা বলল, এই ঠাণ্ডার মধ্যে জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কথা বলছিস না কেন? কি দেখছিস এমন করে? মাহিরা বিন্দুমাত্র না নড়ে বলল,  আধারাচ্ছন্ন লাজুকতার ঘোমটা সরাইয়া ধীরে ধীরে রবি তাহার আলোকিত মুখখানা  পৃথিবীকে দর্শন করিবার আয়োজন করিতেছে। আমি মুগ্ধ নেত্রে তাহাই অবলোকন করিতেছি। সাবিরা অবাক কণ্ঠে বলল, রবিটা কে? আমি তো রবি নামে কাউকে চিনি না। তারমানে তো মাহরাম না।আর তুই মুগ্ধ নেত্রে নন মাহরাম রবিকে অবলোকন করিতেছিস? আস্তাগফিরুল্লাহ। বাবা শুনলে তো স্ট্রোক করবে। এবার ঘুরে বোনের দিকে তাকালো মাহিরা। হেসে বলল, ভেরি ফানি। শোন এই কুসুম কুসুম আলোস্ফুত প্রভাতে তোমার এইসব অতি দুষ্টু ধরণের শব্দগুচ্ছকে গলধঃকরন করিতে চাই না আমি।  সুতরাং, চা লাগলে বলো করে দিচ্ছি। নিয়ে তুমি প্রস্থান করো। সাবিরা এগিয়ে গিয়ে বোনকে ধরে হেসে বলল, এই যে তুই তোর জীবনের প্রতিটা ভোর বাড়ির সবার জন্য চা গরম, চা গরম করতে করতে শুরু করিস, আচ্ছা তোর বিরক্ত লাগে না? তুমিও তো তোমার জীবনের প্রতিটা ভোর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছো। তোমার কি কখনো বিরক্ত লাগে? জানি লাগে না। কারণ এটাতেই তোমার আনন্দ । ঠিক তেমনি সবাইকে নিজ হাতে সকালের চা দেয়াতে আমার আনন্দ। ওহ...আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে নিজেকে ‘আনন্দ বিতরণ তহবিল’ হিসেবে গড়ে তোলা তোর এম ইন লাইফ। মাহিরা হেসে বলল, নিজেকে  ‘আনন্দ বিতরণ তহবিল’ ভাবতে সত্যিই কেমন যেন সুখ সুখ অনুভূতি হয়। ভেবে দেখো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দের সমাহার তো আমাদের সবার কাছেই আছে। সবাই যদি একে অপরের মনে জ্বালিয়ে যেতে পারতো আনন্দের মৃদুমন্দ আলোচ্ছাস। কতই না ভালো হতো তাহলে। রাতের আকাশের বুকে টিমটিমে তারকার ফুলরাশির মতো প্রতিটি মনের অন্ধকার কোণ উদ্ভাসিত হতো স্বপ্নাশেষের বাতায়নে। তোর কথাকে মাঝে মাঝে আমার স্লিপিং পিল মনেহয়। যত শুনি ততই ঘুম পায়। বয়স হয়েছে তো আজকাল ঘুমে কিঞ্চিৎ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই তোর কথাকে বোতলে ভরে কাছে রাখবো কিনা ভাবছি! যাইহোক তোর তহবিল থেকে কিছু আনন্দ ছোট ভাইয়া আর ছোট ভাবীর জন্য বরাদ্দ কর। দুইজনকে গতরাতে আলাদা আলাদা বাড়িতে ফিরতে দেখেছি। মাহিরা হেসে বলল, আনন্দ ছড়ানোর জন্য কিন্তু কোথায় নিরানন্দ বিদ্যমান সেটার খোঁজ রাখাটা শর্ত। আর এই কাজটিতে তোমার কোন তুলনা নেই সেটা কি জানো? পরিবারের কোথায়, কখন, কার, কি সমস্যা হচ্ছে সব তোমার জানা থাকে। জানা থাকে কারণ সংসারে আমি চক্ষু মেলিয়া বিচরণ করি। তোর মতো বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজিয়া রাখি না। হেসে, আমি করবো বলো? যত পড়ি ততই অনুভব করি এই পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারের কাছে আমার জ্ঞান কত ক্ষুদ্র! কত ধরণের জ্ঞানই না ছড়ানো রয়েছে এই পৃথিবীতে! আর কতই না তার শাখা-প্রশাখা...! সাধ জাগে যদি ছুটে বেড়াতে পারতাম জ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা...অলিতে গলিতে...! যদি আস্বাদন করতে পারতাম একটু একটু করে অমীয় সেই সুধা! না সব জ্ঞান ধারণ করতে চাইবার মত ক্ষমতা বা দুঃসাহস কোনটাই আমার নেই! তবে জ্ঞানের সব রঙকে ছুঁয়ে দেখার লোভ আছে এটা অস্বীকার করতে চাই না! জ্ঞানের প্রচণ্ড অভাব বোধ থেকেই মনেহয় আমার মনে জ্ঞানাহরনের এই তৃষ্ণার জন্ম! যাইহোক, ভাইয়া-ভাবীর কি হয়েছে সেটা কি জানো? সবসময় যা হয় তাই হয়েছে। মতের অমিল। আর দুজনেরই তো একই রকমের স্বভাব। জীবনের সুখ-স্বস্থিকে কোরবানী করে দেবে কিন্তু নিজ নিজ মতকে নয়। আসলে প্রতিটা সম্পর্ককেই কখনো কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, যখন কোন একটা বিষয়ে একে অপরকে বোঝানোটা খুব বেশি কঠিন হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতি গুলোতে তাই একে অপরকে বোঝানোর চেষ্টা না করে বরং বোঝার চেষ্টা করা উচিত। তাহলে জীবনের অকারণ জটিলতার সুযোগ অনেক কমে যায়। চলো ভাইয়া-ভাবীর রেসলিংয়ে রেফারি হওয়া যায় কিনা চেষ্টা করে দেখি। এখন? অসম্ভব। ঘুম কম হলে আমার চোখের নীচে কালি পড়বে, মেজাজ খিটপিট করবে, ক্ষুধামন্দা দেখা দিবে, সারাদিন ঘুম ঘুম লাগবে। যার প্রভাব গিয়ে পড়বে আমার শরীর ও মনে। আর ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি’ ইট’স ওকে। কিন্তু ‘পরের কারণে শরীর ও মনের সৌন্দর্য দিয়া বলি’ ইট’স নট ওকে। তোর শখ তুই রেফারি, গোলকিপার, উইকেট কিপার যা ইচ্ছে হয় হ। আমার পক্ষে এখন ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করা ছাড়া অন্য আর কিছুই সম্ভব নয়। মাহিরা হেসে বলল, তুমি কি জানো তোমার কথা রস টুপটুপ রসোগোল্লার মতো? আর স্বাদে গন্ধে এতটাই অতুলনীয় আমিই পারবো গপাগপ দশ-পনেরোটা খেয়ে ফেলতে। সাবিরা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ হজম করতে পারলে অবশ্য তোর কথার স্বাদও মিষ্টই। আসলে কি জানিস তোর কথা হচ্ছে আমলকীর মতো। খেতে তিতকুটে কিন্তু কিছুটা সময় পেরোবার পর মিষ্টতায় ছেয়ে যায় মন। মাহিরা কিছু না বলে হেসে আবারো জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতিতে মনোনিবেশ করলো। কিছুটা সময় নীরবতার পর ধীরে ধীরে বলল, পাথরে তৈরি মানুষের ভিড়ে পাতলা কাঁচের তৈরি ভঙ্গুর মনটিকে নিয়েই বড়ই বিপদে থাকতে হয়। খুব সাবধানে চলতে হয় প্রতি মুহুর্তে। কখন না কার টোকা লেগে ফেটে যায় মন, কারো আঁচড় না দাগ ফেলে দেয় সারাজীবনের মত স্বচ্ছ কাঁচের উপর। বেশ অবাক হয়ে বোনের দিকে তাকালো সাবিরা। এভাবে বলছিস কেন? তোর মুখে অভিযোগ,  হতাশা বা আক্ষেপ এই ধরণের কথা কেন জানি না ভীষণ বেমানান লাগে। এখানেই তো সমস্যা। মানে? সবসময় যদি কেউ আশা জাগানিয়া কথা বললে তার অর্থ কিন্তু এটা নয় যে, তার জীবন ক্যানভাসে হতাশার কোন আঁচড় পড়েনি বা পড়তে পারবে না। আমার কি মনেহয় জানো? কাঁটার আঘাতের রক্তাক্ত পদচিহ্ন ফুলে ফুলে ঢাকা পড়ে যায় বলেই হয়তো ফুল ছড়িয়ে যারা পথ চলে তাদের ক্ষতবিক্ষত পদযুগল কারো দৃষ্টি গোচর হয় না। বেদনার মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আসার অভিজ্ঞতা থাকে বলেই হয়তো কষ্টের নদীগুলোর বুকে তারা রচনা করতে পারে ছোট্ট ছোট্ট সাঁকো। কিন্তু একথা কেউ বোঝে না। আসলে কেউ বুঝতে চায় না বলেই হয়তো বোঝে না কারো প্রফুল্লতা, আনন্দময়তার অর্থ এটা নয় যে সে দুঃখ-কষ্ট-বেদনা শূন্য। তাই কারো উপর মানান-বেমানানের সীলমোহর লাগিয়ে দেয়া ঠিক না। কারণ মানুষ বড় ভঙ্গুর প্রাণী। সর্বাবস্থায় তার কাছে তাই একই রকম আচরণ আশা করা ঠিক নয়। তাছাড়া ছায়া ও আশ্রয়দানকারী বৃক্ষকেও কিন্তু ঝড়ের প্রকোপে সমূলে উৎপাটিত হতে দেখা যায়। কোন কারণে মাহিরার মনকে আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুঝতে পারলো সাবিরা। বোনকে কাছে টেনে নিয়ে তাই আদুরে গলায় বলল, চল আজ প্রাতঃভ্রমণে বের হই। মাহিরা কিছুটা আপত্তি করলেও সাবিরার আবদারের তোড়ে সেটা ভেসে গেলো। দুই বোন বেড়িয়ে গেলো প্রাতঃভ্রমণে। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পাশের পার্কে চলে গেলো দুজন মিলে। একে অন্যের হাতে হাত রেখে স্মৃতির যানে চড়ে ছোট্টবেলার দিনগুলিতে অতীত ভ্রমণ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসায় জায়গা খুঁজতেই সাবিরার চোখ চলে গেলো পার্কে ঝুলতে থাকা দোলনাতে। আশেপাশে তেমন কোন মানুষজন না থাকাতে মনের আনন্দে দোলনাতে দোল খেতে খেতে গল্পে মশগুল হলো দু’জন......

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)