সাহিত্য

অন্তঃরালের ছায়া- ২য় খন্ড

অন্তঃরালের ছায়া- ২য় খন্ড
a-true-relationship-is-someone-who-accepts-your-past-supports-your-present-loves-you-encourages-your-future কিছু কিছু মূহুর্ত ভীষণ রকম অসহায়ত্ব নিয়ে হাজির হয় আমাদের কাছে! পছন্দের মানুষরা খুব কাছে থাকার পরও অদ্ভুত এক একাকিত্ব ঘিরে ধরে মনকে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় প্রিয় কাউকে। চাইলেই শোনা যায় তাদের মিষ্টি কন্ঠের ধ্বনি। তবুও হাহাকার ভেতর থেকে পাক খেতে খেতে উঠে এসে গলার কাছে কুন্ডুলি পাকিয়ে আটকে যায়। অকারণেই বার বার ভিজে ওঠে চোখে। চোখ বুজঁলেই দেখা যায় বুকের ভেতরে ভেসে বেড়াচ্ছে শূন্যতা । আকাশের বুকে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ উড়ে বেড়ানোর মত। মনের ভেতর ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশা ঘুরে বেড়ায়। নাম না জানা, শব্দবিহীন কৃষ্ণগহ্বরিয় ক্ষমতাধারী এই অনুভূতির কাছে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। কোন আপনজন, কোন প্রিয় কিছুর দ্বারাই যখন মনের এই ফাঁককে পূরণ করা যায় না। তখন মন প্রশান্তি খুঁজে পায় একমাত্র প্রভুর স্মরণে। আমার মনের যখনই এমন অবস্থা হয় আমি মন প্রাণ উজার করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে ডাকি। আল্লাহর বাণীর মাঝে নিজেকে নিমগ্ন করতে চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ প্রশান্তিকর একটা মন নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করতে পারি আবারো। কথাগুলো শুনে ঘুরে নূরির দিকে তাকালো ইলমা। বেশ অনেকক্ষণ আগেই তার পাশে এসে দাড়িঁয়েছে নূরি। অন্যের পাশে এসে দাঁড়ানোটা খুবই পছন্দ নূরির। তাই বন্ধুত্ব হবার পর থেকে নিয়ে গত পনেরো বছরে যখনই কোন সমস্যায় পড়েছে বা স্বিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে সবার আগে নূরির কাছেই ছুটে এসেছে। কারণ তার জীবনে দেখা নূরিই একমাত্র মানুষ যে কখনোই ব্যক্তি বা সম্পর্কের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিছু বলে না। বরং সবসময় তাই বলে যা পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক। কাউকে স্বান্তনা দেবার চেয়েও নূরির কাছে বাস্তবতার সাথে তাকে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়াটা জরুরি। ওর কথাকে তাই প্রথম শুনলে নিষ্ঠুরতা মনে হলেও পরে ঠিকই যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। নিজের রসকষহীন কথা প্রসংগে নূরি বলে, আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে আমরা সত্যি বা বাস্তব কথা শুনতে পছন্দ করি না। আমাদের কাছে সেসব তিতা লাগে। আমরা মিথ্যা ও অবাস্তুব মিশ্রিত মিষ্টি কথা শুনতে পছন্দ করি। কিন্তু এতে যে মানসিক যাতনা ও দূর্বলতা আরো বেড়ে যায় তা বুঝেও বুঝতে চাই না। আমি তাই অবাস্তব সুগার কোটেড কথা বলার চাইতে বাস্তব তিতা কথা বলতেই পছন্দ করি। যা কারো মনকে শান্ত করতে না পারলেও তার ভাবনার অন্ধকার জগতে এক বিন্দু আলোক রশ্নি হয়তো পৌছে দেয়। নূরির কথাতে তাই নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস ইলমার। গাল ফুলিয়ে কিছুটা অভিমানী কন্ঠে বলল, তুই বলতে চাস আমি ওভার রিঅ্যাক্ট করছি? তুই চোখ বন্ধ করে একটু ভেবে দেখ গত তিনঘন্টায় তোর কর্মকান্ড। নাস্তার টেবিলে সরাসরি জিজ্ঞেস করার পর আনান ভাইয়া যখন স্বীকার করেছিলেন যে, হ্যা উনি একটি মেয়েকে পছন্দ করতেন। কিন্তু নানাবিধ কারণে তাদের বিয়ে সম্ভব হয়নি। শুনে তুই কি করেছিলি? টেবিলে থাকা খাবার সব ছুঁড়ে টুরে ফেলেছিল। যা মুখে এসেছে বলেছিস আনান ভাইয়াকে। এরপর একদিনও আর সংসার করবি না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিস। কোথায় এসেছিস? আমার অফিসে! এসে এমন হাউমাউ জুড়ে দিয়েছিলি যে বাধ্য হয়ে আমাকে সব কাজ বন্ধ করে তোর সাথে বসে থাকতে হয়েছে। ইলমা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ঘরের কথা পরে জানলো কেমনে? নূরি টেবিল থেকে নিজের সেল ফোন এনে ইলমার হাতে দিয়ে বলল, সকাল থেকে কমপক্ষে পঁচিশটা এসএমএস করেছে আনান ভাইয়া আমাকে। আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছে বেচারা। তাকে নিয়ে করা স্বামীর উদ্বেগ মিশ্রিত এসএমএস গুলো দেখে মনের ভেতরটা কেমন যেন ছলছল করে উঠলো ইলমার। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ না করে বলল, হয়েছে আহ্লাদ করে তোকে বেচারা ডাকতে হবে না। ঢং করে এসএমএস পাঠাচ্ছে এখন। প্রেম করার সময় তো মনে ছিল না আমার কথা। নূরি হেসে বলল, তখন তুই থাকলে কি আর অন্যকারো সাথে প্রেম করতে যেত? জানের মায়া আছে না বেচারার। ফান না নূরি আমি সত্যিই সিরিয়াস। আমি তখন ছিলাম না ঠিক কিন্তু আমি একদিন জীবনে আসবো ইনশাআল্লাহ এটাও তো নিশ্চিত ছিল তাই না? তাহলে কেন নিজেকে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছিল? কই আমি তো জড়াইনি নিজেকে এমন কিছুই সাথে। এমন কত অনৈতিক হাতছানি তো আমিও পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি অপেক্ষা করেছি আমার জীবনসাথীর জন্য। মনের সবটুকুন ভালোবাসা তাকেই দেব বলে অবৈধ কোন আহ্বানে সাড়া দেইনি। এই ব্যাপারে তোর মত শুদ্ধ ও পবিত্র জ্ঞান হয়তো ঐ সময় ছিল না আনান ভাইয়ার। তাছাড়া তোর বেড়ে ওঠার পরিবেশ ছিল শরীয়তের আলোকে। কিন্তু আনান ভাইয়া কোন প্রাক্টিসিং ফ্যামিলিতে বড় হননি। উনি ইসলামকে নিজের চেষ্টার দ্বারা জানতে শুরু করেছেন সেটাও খুব বেশিদিন হয়নি। কিন্তু এটাও তো ঠিক ইসলামকে জানতে শুরু করার পর থেকে গত চার বছর যাবত উনি চেষ্টা করছেন শরীয়তের প্রতিটা বিধান মেনে চলতে। শরীয়তের এই জ্ঞান যদি আগে থাকতো তাহলে হয়তো উনিও ভালোবাসার ফুল বাগান সাজিয়ে তোর জন্যই অপেক্ষা করতো। ইলমা তুই কেন বুঝতে চাইছিস না যা করছিস, যা করতে চাইছিস এতে তোর ক্ষতিই বেশি হবে। ভালো করে ভেবে দেখ যদি তুই সংসার না করিস তাহলে কি হবে? আনান ভাইয়া্র জীবনে সেই মেয়েটি তো আর ফিরে আসবে না। মাঝখান থেকে তোমাদের সুন্দর সুখের জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাবে। আমি কি করবো বল! মানতেই পারছি না ওর আগে কারো সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। হুমম... বুঝতে পারছি! আচ্ছা চল তোকে একটা মজার কথা বলি। ছোটবেলায় নানান ধরণের নীতিবাক্য তো আমরা সবাই পড়েছি! কিন্তু নীতিবাক্যে আমাদেরকে একটু অন্যরকম ভাবে শেখানো হয়েছিল। যেমন ধর, “সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।” এই লাইনটার সাথে আমরা বাড়তি আরেকটি লাইন শিখেছিলাম।“কেউ যদি আমার সামনে চলে ভুল পথে হাসিমুখে সেই কথা বুঝিয়ে বলবো তাকে।” এরপর, “ আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে”। বাড়তি লাইনটি ছিল “ মানুষ মাত্রই করতে পারে ভুল সর্বদা এই কথাও রাখি যেন স্মরণে”। ঠিক তেমনি “সদা সত্য কথা বলিবো” এর সাথেও আরেকটি লাইন শিখেছিলাম। “অপরের সত্য কথা মানিয়া নেবার মতো উদার হইবো”। বুঝতে শেখার পর যখন এমন এক লাইন বাড়িয়ে পড়ানোর কারণ জানতে চেয়েছিলাম। ভাইয়া জবাবে হেসে বলেছিলেন, ছোটবেলা থেকেই নিজের সাথে সাথে অন্যের চিন্তাও তোমাদের কচি মনে বুনে দেয়া হয়েছে। এরফলে তোমরা কখনোই স্বার্থপর মানুষ হবে না ইনশাআল্লাহ। নিজের সাথে সাথে অন্যের কথাও ভাববে এবং অন্যেকে বুঝতে চেষ্টা করবে। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ভাইয়া হান্ডেড পার্সেন্ট রাইট। আমি অন্তত পক্ষে শুধু নিজের চিন্তা করতে পারি না কখনোই। যে আঘাত করে তাকে পাল্টা আঘাত আমি করতে পারি না। মনেহয় আহা মানুষটি তো ততটাই ব্যথা পাবে যতটা আমি পেয়েছিলাম। তাই বদলে আঘাত না করে বুঝিয়ে বলি। ইলমা হেসে বলল, তোর কাছে এলে নিজেকে রবোর্ট মনেহয়! যে রবোর্টের মাইন্ড কন্ট্রোলের রিমোর্ট থাকে তোর হাতে। তুই যেভাবে চালাতে চাস ঠিক সেভাবেই চালাস। নূরির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলেও কন্ঠে একই রকম গভীরতা ধরে রেখে বলল, আমার অভিজ্ঞতার আমি আরেকটি জিনিস দেখেছি। সেটা হচ্ছে অনেকেই সত্য বলতে চেয়েও সত্য বলতে পারে না কারণ যার কাছে সত্যটা বলতে চাইছে তার সত্যকে মেনে নেবার মত উদারতা বা সত্যকে হজম করবার ক্ষমতা নেই। পনেরো নাম্বার এসএমএসটা দেখ। আনান ভাইয়া লিখেছেন, ইলমা এতটা কষ্ট পাবে জানলে আমি কখনোই সত্য কথা বলতাম না। ওর কাছে আমার অ্যাফেয়ারের কথা স্বীকার করতাম না। বানোয়াট কিছু একটা বলে দিতাম। কিন্তু আমার সংসারের শান্তি নষ্ট হতে দিতাম না। কতটা কষ্ট থেকে এমন কথা বলেছেন আনান ভাইয়া সেটা কি বুঝতে পারছিস? আমি পারছি। সাথে সাথে আবারো একবার শিওর হলাম কেন মানুষ সত্য বলতে ভয় পায়! কেন অপ্রয়োজনেও মিথ্যা বলে। কারণ আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষেরই সত্য কথা মেনে নেবার মত মানসিকতা নেই। জীবনটাকে সহজ ও সুন্দর করার পেছনে নিজের চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগানোর চেয়ে, কিভাবে কেঁচো খুঁড়ে সাপ বের করে সেই সাপের বিষাক্ত ছোবল খাওয়া যায় তাতে আমরা পারদর্শী। এমন সুন্দর একটা সংসার, প্রেমময় একজন স্বামীকে যদি কেউ শুধুমাত্র অতীত ইস্যুর কারণে ছেড়ে দিতে চায়। আমি বললো এটাই হচ্ছে, সুখে থাকলে ভূতে কিলায় এর পারফেক্ট উদাহরণ। অনেকক্ষণ চুপ থেকে ইলমা বলল, এখন আমি কি করবো? নূরি বলল, আমার বেতনকে হালাল করতে সহায়তা করতে পারিস। মানে? মানে মাসে মাসে বেতন তো আমি বন্ধুবান্ধবদেরকে টিস্যু সরবরাহ করার জন্য পাই না! তুমি তোমার দুঃখগাঁথা নিয়ে প্রস্থান করলে আমি আমার ডিউটি পালনে মনোনিবেশ করতে পারি। খিলখিল করে হেসে উঠলো ইলমা। হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো নুরিকে জড়িয়ে ধরার জন্য। তর্জনী ঝাঁকিয়ে চোখ পাকিয়ে ইলমাকে সাবধান করে নূরি বলল, খবরদার যদি আমার কাছে আসিস। যা বলার দূরে থেকে বলবি। কক্ষনো আমার গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করবি না। কিন্তু সব হুমকি ধামকি তুচ্ছ করে হাসতে হাসতে ইলমা জড়িয়ে ধরলো নূরিকে।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)