সাহিত্য

অভিমানী মনের আত্মদহন... ১ম খন্ড

অভিমানী মনের আত্মদহন... ১ম খন্ড
551192_doroga_tsvetyi_park_peyzaj_3000x2000_(www.GdeFon.ru) চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে বসলো মারওয়া! আরেকবার ভালো করে তাকালো ঘড়ির দিকে। সত্যি সত্যিই এগারোটা বিশ বাজে! এটা কি হলো?! সে এতক্ষণ ঘুমোলো কি করে?! সকালে ঘুম থেকে উঠার পর মাথা ভার লাগছিল খুব। তাই আধঘন্টার জন্য শুয়েছিল আবার। কিন্তু অ্যলার্ম তো দিয়েই শুয়েছিল! তাহলে? সময়মত অ্যলার্ম কেন বাজলো না দেখার জন্য মোবাইল হাতে নিলো। আজ শুক্রবার কিন্তু সে দিয়েছে শনিবার! এই তাহলে ঘটনা! নিজের উপরই মেজাজ খারাপ হতে লাগলো। এগারোটায় বেশ জরুরি একটা মিটিং ছিল। আরো কিছুক্ষণ গুম ধরে বসে থেকে অফিসে ফোন করে আসতে পারবে না জানিয়ে দিলো। অফিসে যেহেতু যাওয়া হচ্ছেই না আরেকটু ঘুমিয়ে নিলে কেমন হয়? এমন অলস চিন্তার জন্য ধিক্কার দিতে দিতে বিছানা থেকে নামলো মারওয়া। শরীর ও মনের আলসেমী দূর করার জন্য শাওয়ার নেয়া হচ্ছে তার জন্য বেষ্ট অপশন। অবশ্য শুধু আলসেমীই না শাওয়ার মারওয়ার মনের স্যাঁতস্যাঁতে, খিটপিটে, চিড়চিড়ে, ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব দূর করতেও বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো, মন বিষয়ক একটা অ্যাড তৈরি করলে কেমন হয় বলো তো মারওয়া? অ্যাডের জিঙ্গেল হবে “ মনের স্যাঁতস্যাঁতে, খিটপিটে, চিড়চিড়ে, ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব দূর করতে চান? হিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকার কারণে দেখতে না পাবার মতই আপনার হাতের কাছেই লুকিয়ে আছে অবিশ্বাস্য ফর্মূলা। নিজেকে আপাদমস্তক ডুবিয়ে দিন পানিতে, ধীরে ধীরে মন সিক্ত হবে প্রশান্তটিতে!” আপি আপনি কার সাথে কথা বলছেন? প্রশ্ন শুনে ঘুরে পেছনে তাকালো মারওয়া। ছোট ভাইয়ের নববধূ আফরা চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করেই তিনমাস আগে আফরা আর আবিরের বিয়ে হয়েছিল। ব্যস্ততার কারণে তখন দুজনকে বাসায় দাওয়াত দিতে পারেনি মারওয়া। ব্যস্ততা কিছুটা কমে যাবার পর দুজনকে কয়েকদিনের জন্য তার বাসায় নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল। গত পরশু হাজির হয়েছে ক্ষুদে দম্পতি। যারা সকালে হুড়মুড় করে তৈরি হয় অফিস যাবার জন্য নয় বরং ইউনিভার্সিটি যাবার জন্য। গতকাল নাস্তার টেবিলে বসে আবির যখন বলছিল, আফরা তাড়াতাড়ি করো আমার ক্লাস মিস হয়ে যাবে! অনেক মজা পেয়েছিল মারওয়া। আফরার প্রশ্নের জবাবে হেসে বলল, ক্লাসে যাওনি তুমি? জ্বিনা আপি। আজ যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবে আবির গিয়েছে। নাস্তা করবেন না আপি? আমি চায়ের পানি চাপিয়েছি অনেকক্ষণ আগেই। চা বানাবো আপনার জন্য? আধঘন্টা পরে বানাও। আমি শাওয়ার নিতে যাচ্ছি। নাস্তার টেবিলে বসে আফরার দিকে ভালো করে তাকালো মারওয়া। নাক-চোখ ঈর্ষৎ লালচে, ফোলা ফোলা লাগছে। কান্না করেছে সেটা রুমে যখন দেখেছে তখনই বুঝতে পেরেছিল। কেন কান্না করেছে সেটা হচ্ছে গিয়ে প্রশ্ন! নববধূদের হাসি-কান্না দুটোই বৈচিত্র্যময়তায় টইটুম্বুর! চলতে চলতে হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ার মত, বিয়ে হচ্ছে মেয়েদের জন্য বড় হতে হতে হঠাৎ আবার ছোট্ট হয়ে যাওয়া। এক্কেবারে ইক্টুসখানি একটা পিচ্চি বাবুনি যাকে বলে। যে একটুকেই হাসে, একটুতেই কাঁদে। আদুরে আদুরে আবদার করে, সেসবে হেরফের হলেই অভিমান করে। কিন্তু পরিবারের মানুষগুলো এসব বোঝে না বেশির ভাগ সময়ই। তারা মনেকরে বড় হয়েছে বলেই বিয়ে হয়েছে। আর বিয়ে হয়েছে মানেই তুমি এখন বিশাল সব দায়িত্বের বোঝা মাথায় নেবার জন্য প্রস্তুত। কেউ বুঝতে চায় না একটা মেয়ে হিসেবে সে বড় হয়েছে। কিন্তু একজন বধূ হিসেবে মাত্রই তার জন্ম হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা বোঝে না বলেই একটি মেয়ে নতুন সম্পর্কের জন্মলগ্নের আদর কদর থেকেও বঞ্চিত হয় বেশির ভাগ সময়ই। চুপচাপ নাস্তা সেরে নিলো মারওয়া। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হেসে বলল, মাশাআল্লাহ তুমি তো বেশ মজা করে চা বানাও। আমি কফি সবার হাতে খেলেও চা সাধারণত নিজের হাতের বানানো ছাড়া খেতে পারি না। মনেহয় আমার চা আমি ছাড়া অন্যকেউই বানাতে পারবে না। কিন্তু তোমার চা সত্যিই মজা হয়েছে। হাসি ফুটে উঠলো আফরার চেহারাতে। থ্যাঙ্কইউ আপি। আমি যে কয়দিন থাকবো রোজ আপনাকে চা করে দেবো। ইনশাআল্লাহ। এখন বলো কেমন কাটছে তোমাদের সময়? আফরাকে চুপ থাকতে দেখে মারওয়া হেসে বলল, তুমি আমার সাথে মনের সব কথা শেয়ার করতে পারো। খানিকটা অভিমানী কন্ঠে আফরা বলল, আপি কথা দিয়ে কথা না রাখা কি ভালো? কথা দেয়া মানে হচ্ছে ওয়াদা করা। আর ওয়াদা রক্ষা করা তো মুমিনের শান। কিন্তু আবির কখনোই কথা দিয়ে করা রাখে না। ফোন করার কথা বলে ফোন করে না, বাসায় ফেরার এক সময় বলে কিন্তু কখনোই সেই সময়ের মধ্যে বাসায় ফেরে না। ঘুরতে যাবার প্ল্যান করেও আবার ক্যান্সেল করে দেয়। সবসময়ই এমন করে নাকি মাঝে মাঝে? একটু চুপ থেকে আফরা বলল, বেশ কয়েকবার করেছে। মারওয়া হেসে বলল, খুব অভিমান জমেছে তোমার মনে বুঝতে পারছি। তুমি আবিরের কাছে জানতে চাওনি কেন এমন করেছে? কেন কথা দিয়েও সেটা রাখেনি। জানতে তো চেয়েছিই। অজুহাতের তো কোন অভাব নেই ওর কাছে। ঠিকই নিজের স্বপক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলে। আবিরের যুক্তিগুলোকে তুমি অজুহাত কেন ভাবছো? সত্যিও তো হতে পারে তাই না? হয়তো যা যা বলেছে সেসবই ওর ওয়াদা ভঙ্গের কারণ ছিল। এমনটা কি হতে পারে না? আফরাকে চুপ দেখে হাসলো মারওয়া। বলল, আমি ভাইয়ের সাপোর্টে কথা বলছি এমনটা ভাবছো নাতো আবার? আফরা হেসে বলল, না আপি এমন ভাবছি না। আমারো বিয়ে হয়েছিল তোমার মত অনেক ছোট বয়সে। ইনফ্যাক্ট তোমার চেয়েও দুই আড়াই বছর ছোট ছিলাম আমি বিয়ের সময়। তোমাদের ভাইয়া প্রচন্ড রকম ব্যস্ত একজন মানুষ ছিলেন। আমাদের বিয়ের পরপর পারিবারিক কিছু সমস্যার কারণে উনার সেই ব্যস্ততার মাত্রা আরো বেড়ে গিয়েছিল। যখন ফোন করে উনাকে পেতাম না, ম্যাসেজ করার করার কয়েক ঘন্টার পরেও রিপ্লাই আসতো না, বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছি আমি উনি ফোন করে জানাতেন কাজে আটকে পড়েছেন, আমি কথা বলতে চাইতাম আর উনি ক্লান্তির কারণে ঘুমোতে চাইতেন। তখন আমারো এমন তোমার মত অভিমান হতো খুব। খুব খুব অভিমান। উনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না, আমার কোন গুরুত্বই নেই উনার কাছে ইত্যাদি ভেবে ভেবে ওয়াশরুমে, ছাদের কোনায় বসে কত যে কান্না করেছি। কত শত নেতিবাচক কথা যে চিন্তা করেছি। কেন যে বিয়ে করেছি সেই আপসোসের সীমা থাকতো না। আফরা লাজুক হাসি হেসে বলল, আমারো এমন ভাবনা মনে আসে আপি। মারওয়া হেসে বলল, জানি। আমরা মানুষেরা একে অন্যের থেকে যতই আলাদা হই না কেন! কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের ভাবনারা একাকার! যাইহোক,অভিমান আর জেদের বশে অনেক সময় ইচ্ছে করে ইগনোর করতাম তোমাদের ভাইয়াকে। হয়তো বাইরে যাবার কথা বলেছে আমি শরীর খারাপের বাহানা করতাম। মুখ ফুটে কিছু বলার স্বভাব ছিল না আমার। তাই এভাবে অভিমানের প্রকাশ ঘটাতাম। কিন্তু আমি যে অভিমান করে বাইরে যেতে চাচ্ছি না সেটা উনি বুঝতে না পারার কারণে বলতেন, আচ্ছা তাহলে তুমি বিশ্রাম নাও। আমার অভিমান তখন আরো বেড়ে যেত। মনেহতো উনি আমাকে বুঝতেই চেষ্টা করছেন না। যদি করতেন তাহলে আমাকে জোর করতেন। কিন্তু একবারও আমার মনেহতো না যে, আমি না বললে, না বুঝতে দিলে উনি কিভাবে জানবেন আমার মনের মধ্যে কি চলছে?! কারো মনের ভাবনা তো কেউ দেখতে পায় না। এমন একদিন আমি উনাকে ফোন করেছিলাম রিসিভ করে আমাকে কোনকিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, একটু পরে তোমাকে ফোন দিচ্ছি বলে উনি লাইন কেটে দিয়েছিলেন। সেদিন আমার প্রচন্ড রাগ হয়েছিল। একটূ পর যখন উনি ফোন দিয়েছিলেন আমি ধরিনি। একটু পর পর ফোন দিয়েই যাচ্ছিলেন। আমিও ফোন না ধরার পণ করে বসেছিলাম। আমার কিছু হয়েছে এই চিন্তায় অস্থির হয়ে উনি কাজ ফেলে বাসায় ছুটে এসে যখন দেখলেন আমি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি রেগে গিয়েছিলেন প্রচন্ড। এতদিনের জমিয়ে রাখা ক্ষোভ আমিও চাপা দিয়ে রাখতে না পেরে বিস্ফোরিত হয়েছিলাম। আফরা হেসে বলল, সেদিন বুঝি অনেক ঝগড়া হয়েছিল আপনার আর ভাইয়ার? মারওয়া হেসে বলল, উহু! সেদিন আমরা একে অন্যের তরে ভুল বোঝাবুঝির জানালা রুদ্ধ করে দিয়ে সর্বাবস্থায় একে অপরকে বুঝবো, কখনো বুঝতে না পারলে জিজ্ঞেস করবো, কিন্তু কখনোই ভুল বুঝবো না এই দ্বার খুলে দিয়েছিলাম। কিভাবে আপি? মারওয়া হেসে বলল, তোমার ভাইয়া আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন কিভাবে অভিমান আমাদের চিন্তা চেতনাকে আত্মকেন্দ্রিক করে দেয়। আমাদের ভাবনারা তখনো ডালপালা মেলে কিন্তু শুধু নিজেকে ঘিরে। অভিমানি মনের জগত হয় ‘আমিময়’। অথচ চিন্তার কেন্দ্রটিকে আমি থেকে একটু ঘুরিয়ে দিলেই সবকিছু অনেক সহজ হয়ে যায়। আচ্ছা চলো কিচেনে যাই আমরা। আবিরের সবচেয়ে পছন্দের কিছু খাবার রান্না করা শিখিয়ে দেব তোমাকে। রান্না করতে করতে গল্পও করা হয়ে যাবে। আফরা হেসে বলল, জ্বি আপি চলেন।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)