সাহিত্য

অন্তঃরালের ছায়া- শেষ খন্ড

অন্তঃরালের ছায়া- শেষ খন্ড
3d-abstract_other_spring-patio_61663 কথা বলতে বলতে লাঞ্চের সময় হয়ে গেলে ইলমাকে নিয়ে নূরি অফিসের পাশের এক রেষ্টুরেন্টে এলো। খাবারের অর্ডার দেবার পর ইলমা বলল, তাহলে তুই বলতে চাইছিস স্বামী-স্ত্রীর কখনোই একে অন্যের অতীত জানতে চাওয়া ঠিক না? না ঠিক তা বলতে চাইছি না। একে অন্যেকে অতীত জানতে আসলে তেমন কোন সমস্যা নেই। কিন্তু অতীতকে কেন্দ্র করে বর্তমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করাটা কখনোই ঠিক না। অন্তত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি চমৎকার একটি ভালোবাসাময় সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। যেমনটা তোর আর আনান ভাইয়ার মধ্যে রয়েছে। সেক্ষেত্রে অতীতের প্রভাব বর্তমান সম্পর্কের উপর পড়তে দেয়াটা অনেক বড় একটা ভুল। হুমম... এখন মনেহচ্ছে কেন যে ডায়েরি পড়তে গিয়েছিলাম। আসলে এখানে পুরো দোষ তোরও না। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে সন্দেহ মনে দানা বাঁধলে সেটা যাচাই করে দেখতে চায়। সন্দেহ নিয়ে আমার কাছে কেউ এলে আমি পরামর্শ দেই যতবার সুযোগ মিলবে সন্দেহকে যাচাই করে নেবেন। সন্দেহ প্রমাণিত হোক বা না হোক এরফলে অন্তত মনে বিরাজমান অশান্তি দূর হয়ে যায়। তাহলে? স্বামী-স্ত্রীর সতর্ক থাকতে হবে একে অন্যের মনে সন্দেহ তৈরি হতে পারে এমন কিছু করা থেকে। আনান ভাইয়া যদি তার পুরনো ডায়েরিটা ফেলে দিতেন বা তোর হাতের নাগালের বাইরে রাখতেন। তাহলেই কিন্তু এই অকারণ সমস্যাটি তৈরি হতো না তোদের জীবনে। কারো অতীতে যদি এমন কোন ঘটনা থেকে থাকে, তাহলে বিয়ের আগেই তার উচিত যথাসম্ভব সেই ঘটনার সাথে রিলেটেড সবকিছু জীবন থেকে ধুয়ে মুছে দূর করে নতুন সম্পর্ক শুরু করা। এখন তুই আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন। মনযোগ দিয়েই তো শুনছি। আচ্ছা বল। ভালো লাগা ও ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কিয় একটা বাণী পড়েছিলাম। যার বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায়-“ যখন কারো একটি ফুলকে ভালো লাগে সে ফুলটিকে গাছ থেকে ছিঁড়ে নেয়। আর যখন কেউ ফুলকে ভালোবাসে তখন গাছের যত্ন করে, গাছে পানি দেয়।” অর্থাৎ, ভালোলাগার জন্য মানুষ অন্যকে অন্যকে কষ্ট দিতে পারে। কিন্তু ভালোবাসার জন্য নিজে কষ্ট সহ্য করে। অন্যকে ভালো রাখার জন্য নিজে ত্যাগ স্বীকার করে। কখনো কি ভেবে দেখেছিস আমাদের জীবনে বিদ্যমান সম্পর্কের বন্ধনগুলোকে ঘিরে আমাদের আবেগ কি ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা? ইলমা বলল, আমি বুঝতে পেরেছি তুই যা বোঝাতে চাইছিস। আসলেই আমরা আমাদের সম্পর্কগুলোকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসাতেই শিখি না। ভালোলাগাকেই আমরা ভালোবাসার মনেকরি। তাই নিজের খুশির জন্য অন্যকে কষ্ট দিতে, ব্যথিত করতে দ্বীধা করি না। বরং আনন্দ পাই। নূরি আমি বরং আনানের অফিসে চলে যাই। অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গিয়েছে। বিষয়টা নিয়ে দুজন কথা বলে সবকিছু ক্লিয়ার করি। হাসি মুখে ইলমাকে বিদায় দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সেলফোন হাতে নিলো নূরি। আসিফকে স্কাইপে অনলাইন দেখে একমূহুর্ত দ্বিধা করলো এরপর টাইপ করতে শুরু করলো। জীবনে সমস্যা তৈরি করতে পারে এমন সবকিছু থেকে সবসময় দূরে থাকার চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু এমন কিছু যদি জীবনের অংশ হয় তাহলে? ইচ্ছা-অনিচ্ছা, অজ্ঞতা কিংবা পরিস্থিতির স্বীকার! কারণ যাই হোক একবার কোন কিছু জীবনের অংশ হয়ে গেলে তাকে আর আলাদা করার উপায় থাকে না। একটা আপেলের পঁচে যাওয়া অংশ কেটে ফেলে দিয়ে বাকিটুকু খেতে তেমন কোন আপত্তি থাকে না বেশিরভাগ মানুষেরই। কিন্তু একজন মানুষের খারাপ দিকটা এমন কেটে বাদ দেয়া যায় না বলেই হয়তো পুরো মানুষটাকেই জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাই আমরা। কিন্তু এটা কি ঠিক? ম্যাসেজ সেন্ড করার প্রায় সাথে সাথেই জবাব এলো, তোমার কি ধারণা? এত দ্রুত জবাব আশা করেনি নূরি। হাসি ফুটে উঠলো চেহারা জুড়ে। লিখলো, আমি আসলে তোমার ধারণা জানতে আগ্রহী। আমার ধারণা তো আমার কাছেই আছে। যে কোন সময় জেনে নিতে পারবো। কিন্তু জানার সময় ধারনাটা সঠিক না বেঠিক সেটা যাচাই করার জন্য একটা মানদন্ড প্রয়োজন পড়বে। তাই তোমারটা জেনে রাখতে চাইছি। যে কোন বিষয়ে মানদন্ডের জন্য কুরআন-হাদিসই কি যথেষ্ট নয়? জ্বি যথেষ্ট। তাহলে? ভুল হয়ে গিয়েছে তোমাকে জিজ্ঞেস করা। সরি! আচ্ছা মানুষের আনন্দিত হওয়া আর ব্যথিত হওয়ার মানদন্ড কি? মানে? মানে মানুষ কত অল্পে আনন্দ হয় সেটা নিয়ে কি অন্যালাইসিস করেছো কখনো? আবার কত অল্প থেকে অল্প কারণে ব্যথিত হয় সেটা নিয়ে কি ভেবেছো? আমি ভেবেছি। ভাবনার ফলাফল কি জানো? উহু! বলো এখন জেনে নেই। ফলাফল হচ্ছে আনন্দের চেয়ে বেদনা প্রভাবশালী। আবার বেদনা তৈরি করা যতটা সহজ, আনন্দ তৈরি ততটা সহজ নয়। যেমন ধরো, রাস্তায় তোমার সামনে কেউ পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ব্যথা পেলো। তার ব্যথা দেখে তোমার বেদনাক্ত হবার সম্ভাবনা নাইনটি ফাইভ পার্সেন্ট। কিন্তু জীবনে আসা কোন সাফল্যের কারণে কেউ রাস্তায় চলতে চলতে উল্লাস প্রকাশ করছে। এটা দেখে তার আনন্দে আনন্দিত হবার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি। কি বুঝলে? বুঝলাম অন্যের দুঃখ আমাদেরকে যতটা দুঃখী করে, অন্যের আনন্দ ততটা আনন্দিত করতে পারে না। নিজ নিজ জীবনের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। আমরা আনন্দের চেয়ে দুঃখের চর্চা বেশি করি। আসলে সমস্যাটা কোথায় জানো? কোথায়? সমস্যাটা হচ্ছে অর্ধেক কেটে ফেলে দেবার পর আপেল খুব সহজেই খেয়ে নেয়া যায়। কিন্তু মানুষের দাগ হচ্ছে দুধের সাথে পানির মিশ্রিণের মত। লেবুর রস বা সিরকার প্রয়োগে খুব সহজেই দুধ থেকে পানি আলাদা করে ছানা তৈরি করে ফেলা যায়। সমস্যা বাঁধে ছানা দিয়ে মিষ্টি তৈরি করতে গিয়ে। ছানা দিয়ে কিন্তু খুব সহজেই সন্দেস বানিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই ছানা দিয়ে আমরা রসগোল্লা বানাতে চেষ্টা করি। ফ্যাক্ট হচ্ছে রসে সেদ্ধ করলেই ছানার বল রসের গোল্লাতে পরিণত হয় না। নির্দিষ্ট মাপ আছে, টেকনিক আছে রসগোল্লা বানানোর। এছাড়া ছানার সাথে আরো কিছু উপকরণও যোগ করতে হয়। মানুষের অতীত অনেকটা দুধ থেকে ছানা তৈরির মত। ছানা তৈরির মতই কারো অতীত খুঁজে বের করাও বেশ সহজ। কঠিন হচ্ছে রসগোল্লা তৈরির প্রসেসিং। তাই হয় তোমাকে রসগোল্লা তৈরিতে এক্সপার্ট হতে হবে, নয়তো সন্দেস পছন্দ করতে হবে। তা না হলে ছানা তৈরি থেকে বিরত থাকতে হবে। আশাকরি বোঝাতে পেরেছি। হুমম... কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই এইসব থিওরী মেনে চলার চেষ্টা করতেই নারাজ। মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়ে ভাবি এত ভালোবাসাবাসি, এত টান, এত আকর্ষণ থাকার পরও সম্পর্কগুলো ভেঙে যায় কেন? জীবন দিয়ে দেবার দাবীদারেরা একে অন্যের জন্য নিজ নিজ ছোট্ট ছোট্ট ইচ্ছে-অনিচ্ছে, অপছন্দ-অপছন্দের ত্যাগ স্বীকার করতে পারে না কেন? কোন ব্যক্তিই যেখানে ভুলের উর্দ্ধে নয় সেখানে ক্ষমা করে দিতে পারে না কেন উভয়ের ভুলগুলোকে?! কেন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেয়ে ভেঙে ফেলাটাকেই পছন্দ করতে শুরু করছে মানুষ? দেয়াল না তুলে সেতু নির্মাণে আগ্রহী হয় না কেন? একসাথে কাটানো পুরো সময়টাই তো অসুন্দর বা নিরানন্দে ভরা থাকে না। তাহলে কেন সুন্দর ও আনন্দময় মূহুর্তগুলো অবমূল্যায়িতই থেকে যায়? কেন আমরা হাসি দিয়ে দুঃখটাকে জয় করতে পারিনা? কেন ঘৃণার আঁধারে ঢেকে যায় ভালোবাসায় সূর্য? বাড়িতে ফিরে আজ দুজন মিলে গবেষণা করলে কেমন হয় বলো তো তোমার এই অষ্ট কেন’র? হাসির ইমোর সাথে ফাটাফাটি হয় লিখে সেন্ড করলো নূরি। খাবার এলে প্যাক করে দেবার অনুরোধ করলো। ইলমার মতো তারও এখন বিনা নোটিশে হাজির হতে ইচ্ছে করছে আসিফের অফিসে। যদিও সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেকেই উল্টো সারপ্রাইজ হতে হয় নূরিকে। যেদিনই সে না বলে আসিফের অফিসে হাজির হয় আসিফ জরুরি কোন মিটিংয়ে থাকে নয়তো অফিসের বাইরে। প্রথমদিন সামান্য আহত হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে নিজেও সারপ্রাইজড হবার প্রস্তুতি থাকার কারণে তেমন কষ্ট পায়নি। আসলেই পূর্ব প্রস্তুতি যে কোন নেতিবাচক কিছুর সাথে মানিয়ে নেবার চমৎকার একটি ফর্মূলা। তাই একটি সম্পর্ক যত মধুরই হোক না কেন কিংবা একজন মানুষ যতই ভালো হোক না কেন, তার ভেতরে নেতিবাচক কিছু থাকতেই পারে! এই ভাবনাটা এবং এটা মেনে নেবার উদারতা যে কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রেই একটি শক্তিশালী পিলার।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)