সাহিত্য

প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা

প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা

রাহাতকে এখন দেখলে যে কেউ ভাববে, ও পাগল হয়ে গেছে।

 

এম্নিতে রাহাত হিসেবী মানুষ, ওর বয়সের আর দশটা ছেলের চেয়ে তো বটেই। বাসা, মানে ওদের পাঁচজনের মেসের যাবতীয় হিসেবের ভার তাই ওরই কাঁধে। নিজে গাধার খাটুনী খাটে না, যুক্তিতে বাকিদের খাটিয়ে নিতে পারে। একই কথা অফিসের জন্যও প্রযোজ্য। ক্লাসে তো বটেই। নিষ্কম্প পুকুরের মত আবেগ ওর, নয়টা-পাঁচটার সাপ্লাই চেইনের হিসাব এবং এর পর ছয়টা থেকে রাত নয়টার ক্লাসের মাঝে ওকে ঝিমাতে দেখে না কেউ। আড্ডাবাজ না হলেও কথাবার্তার ধীরস্থির ভাব দেখেই বোধহয়, ক্লাসেমেটরাও বেশ আকাংক্ষা করে। চায়ের বিরতিটায় তাই প্রতিদিনই জুটে যায় কেউ না কেউ। আর, এমবিএর ক্লাসে যেখানে একএকজনের বয়স এবং বাস্তবতা এক এক ধরণের, সেখানে এর চেয়ে বেশী অন্তরঙ্গতা আশা করাও যায় না। অবশ্য সেসব নিয়ে রাহাতের মাথাব্যথাও নেই।

 

কার্ণিশের দড়িটায় আরও একবার তাকিয়ে হাত বদলে এবার বাম হাতে গ্রীল ধরলো। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, তাতেও গুমোট কাটছে না। ভুরু নাচিয়ে বৃষ্টির পানি ফেললো কপাল থেকে। ‘পাগলামী’ আপন মনে বিড়বিড় করলো।

 

আধঘন্টা পর। হনহন করে নিয়নের আলোয় চকচকে রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে রাহাত। হিসেবি, ঋজু চোখগুলো আনত; থুতনী বুকে লেগে আছে। কপালের চুলে চুইয়ে পড়ছে না আর পানি, বৃষ্টি থেমে গেছে। দুই ব্লক হেঁটে বাসায় ফিরে গোসলেই গেল, যথারীতি, ফ্রেশ না হয়ে বিছানায় যাবার কথা ভাবতেই পারে না এভাবে। খেয়ে, রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে, আগামীকালের বাজারের লিস্ট আর টাকা আনোয়ারকে বুঝিয়ে ফোন কানে বিছানায় বসলো, চোখ বন্ধ। মা’র সাথে কথা বলার সময় চোখ আপনাআপনি বুজে আসে। কল্পনায় মায়ের ঘ্রাণ পেতে সুবিধা হয় ওর। ছটফটে ছোট্ট এই মহিলাটির জীবনের একমাত্র মহানায়ক সে। এই স্বার্থপর একাকীত্ব ওকে আত্নবিশ্বাসী করে তুলে।

 

আজ তিনদিন এই বদলানো রুটিনে চলছে রাহাত। মা টের পাননি, যদিও ফোন করার সময়ের হেরফেরেই সম্ভবত, একটু বেশী খোঁজখবর নিলেন আজও। পড়তে বসার ইচ্ছা ছিলো না, কালই এসাইনমেন্ট জমা। চতুর্থবারের চায়ের মগটা টেনে কুসুম গরম চা টেনে খেয়ে লেখায় মন দিলো আবার। চা ওর ক্লান্তি বা অবসাদের ওষুধ নয়, সহযোগী বরং। রাত দু’টায় বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করামাত্রই লাফ দিয়ে আজকের সন্ধ্যা, গতকালকের, পরশুর, সব দৃশ্য চোখের সামনে এসে জমা হল। আশ্চর্য! শুধু এই দৃশ্যের হাত থেকে বাঁচতে ক্লান্তির শেষ সীমায় এসে তবেই টেবিল ছেড়েছে ও, দু’বার ঢুলে পড়ে যাবার পর।

 

মেয়েটা বাসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলো। রাহাতের একটু আগেই। বাসে উঠেওছে আগেই। মহিলা সিট আগেই ভরপুর, বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাহাতেরও উপায় নেই, কাছেই দাঁড়াতে হোল। রাহাতের বোন নেই, বাস্তববাদী মা ওকে কোনদিন বলে দেননি মেয়েদের শ্রদ্ধা করতে হয় কি না। শুধু গল্প শুনিয়েছেন, প্রতিটা অপমানের, প্রতিটা লজ্জ্বার, প্রতিদিনের চলার পথেরসারা দুনিয়ার কাছে চেপে যাওয়া টুকরো গল্পগুলো, হয়তো আঠারো উনিশের রাহাত সেসব শুনে বোঝারও যোগ্য ছিলো না তখন। কেনই যেন, কোন মহিলাকে দেখলে তার পেছনে ফেলে আসা ঘরটার কথা ভাবনায় এসে যায় ওর। কাজটা শুধুই সময় কাটানোর জন্য যদিও, রাস্তায় দিনে যার চারঘন্টা কাটে তার জন্য এ ছাড়া উপায়ও নেই আর।

 

শুধু এই একটা মেয়ে, শ্যমলা হাতের শক্ত মুঠিতে ধরা ব্যাগ সামলে বাসের সিট আঁকড়ে ছিলো, রাহাত জায়গা ছেড়ে দাঁড়িয়ে ইশারা করায় বললো, ‘আমি ওখানে বসবো না।’ পেছানোটা খারাপ দেখায়, রাহাত দাঁড়িয়েই থাকলো। এর মধ্যে জায়গাও দখল হয়ে গেছে অবশ্য। ‘আমি ছেলেদের পাশে বসি না’ মেয়েটা আবার বললো। সৌজন্যের হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরেছিলো ঠিকই, কোথায় যেন একটা মায়া না কী যেন একটা গলার ঠিক কাছটায় উঠে আসছিলো বারবার। পরেরদিন না চাইতেই আবার দেখলো মেয়েটাকে। অবিশ্বাস্য, অভূতপূর্বভাবেই মেয়েটা নামার একটু পর নেমে পেছন পেছন ছুটলো। যে বাড়িটায় ঢুকেছে মেয়েটা, তার উল্টাদিকে নির্মীয়মান বাড়িটার একতলায় দাঁড়িয়ে সিঁড়ির জানালায় উর্ধ্বগামী ছায়া জরিপ করলো রাহাত। চারতলা। এবার খালি বাড়ির চারতলায় গিয়ে চোরের মত উঁকি দিয়ে দেখলো, হ্যাঁ, ডানের ফ্ল্যটে দেখা যাচ্ছে তাকে। উচিত অনুচিত ভাবার সময় পায়নি, প্রবল কৌতুহল আর কী যেন একটা স্নিগ্ধ আকর্ষণ ওকে মশার কামড় আর আরও পাঁচটা চিন্তা ভুলিয়ে দিচ্ছিলো।

 

নতুন বাড়ি, বারান্দায় গ্রীল বসেনি এখনও, রেলিং ছাড়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে তৃতীয় দিনের সন্ধ্যায় রাহাতের প্রথমবার মনে আসলো, ওকে দেখা যাচ্ছে না তো? অবশ্য ওপক্ষের সে খেয়াল নেই। আর দশটা চাকুরীজীবি মেয়ের মত ঘরে ফিরেই হাতের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেয়েটা। মা’কে সারাজীবন এমনই দেখেছে রাহাত। মায়ের সাথে সাথেই লেগে থাকতো ও, এঁটুলীর মত। ভাইবোনের অভাববোধ হয়নি ওর, এজন্যই বোধহয়। রান্নার সময়টায় আজও সেই ছোট্ট মোড়ায় বসে মা’র সাথে গল্প করে ও। মা’র হাতগুলো কি অবিশ্বাস্য দ্রুততায় একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছে, চুলায় দুধ বা ভাত ঠিক উথলে পড়ার আগ মুহূর্তে সেদিকে নজর যাচ্ছে কিভাবে, এক অপার বিস্ময় ছিলো ওর কাছে। আজকালের মেয়েদের অবশ্য ঝামেলা আরও বেশী, আজ তিনদিন এইই মনে হচ্ছে ওর। চুলায় রান্না, হাতের ইশারায় কাজের মহিলাকে কাজ ঠিক করে দেয়া, এর পরেও কিছুক্ষণ পরপর ফোন হাতে নিয়ে কি যেন দেখছে। আর মেয়েটার সেই স্নিগ্ধ হাসিটা চোরের মত অন্ধকারে অপেক্ষমান যুবকটিকে দোলা দিয়ে যাচ্ছে বারবার।

 

রাত তিনটা। জীবনে প্রথমবারের মত, চোখ খুলে আবিষ্কার করলো ও, ওর আজ রাতে আর ঘুম আসবে না। ক্লান্তির অংশ শেষ, বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া যাবে না আজ ঘুম থেকে। গত তিনটি দিন, ভাবতে না চাওয়া যে সত্যটা রাহাতকে তাড়া না করে ঘাপটি মেরে ছিলো, আজ বিদ্যূচ্চমকের মত নাড়া দিয়ে গেছে। দৃশ্যটা দেখার পর আর এক মুহূর্তও তাকায়নি ফিরে, তরতর করে নেমে সোজা বাসা। মায়ের সাথে ফোনটাও আজকে নিয়মরক্ষার হয়েছে, মন খুলে উপুড় করার মত না। অসময়ে ঘুম ভেঙ্গে গলাটা শুকনো লাগছে। কিন্তু পানি আনতে যাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছে না।

 

বাসায় কেউ আসলে অভ্যর্থনা তো করেই মানুষ। আশৈশব বাবা ছাড়াই মানুষ হওয়া রাহাত কখনও এভাবে দেখে নি বিষয়টা। একটা মাত্র শব্দে সারা ঘর আলো করা হাসি আর উষ্ণতা নিয়ে এভাবে দরজায় যাওয়া যায়? ঘরে ফেরা ক্লান্ত মানুষটাও, দরজা থেকেই কিসের যেন গল্প করতে ধরেছেন। কী একটা মনে হতে চুলার কাছে ফিরে আসা স্ত্রীকে সে গল্পটা শোনাতে গলাও বেশ উঠাতে হয়েছিলো।

 

হ্যাঁ, স্ত্রীই। মেয়েটা অন্য একজন পুরুষের খুব খুব নিজের মানুষ। ওর হাসি, ওর মায়া শুধু সে মানুষটার জন্য। একবার রাহাতের মনেও হয়েছিলো, শক্ত পায়ে উঠে যায় সেই চারতলায়। হাত জোড় করে স্বীকার করে, ও চুরি করেছে। কিন্তু... ভদ্রতার মুখোশ আঁটা ওর অস্তিত্বে। ও পারেনি। দ্রুত পায়ে হেঁটে আস্তানায় ফিরেছে। সব আবেগ, উৎকন্ঠা, দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে অদ্ভুত এক অবসাদ এখন ওকে ভেতরে বাইরে কুঁকড়ে দিচ্ছে। আর এখন হচ্ছে অভিমান, একটা অধৈর্য্য অভিমান ওর সমস্ত সত্ত্বাকে আপ্লুত করে ফেলছে। কেন? কেন এমন হল? কেন ওই মানুষটার জায়গায় রাহাত নাই? কী এমন হত থাকলে? সৃষ্টিকর্তার প্রতি একটা ছেলেমানুষী অভিমান, নাক জ্বালা করে দুই ফোঁটা তপ্ত অশ্রু এনে ফেললো একটা নির্ঘুম মানুষের নিঃসঙ্গ থুতনী বেয়ে।

 

বেশ কিছুদিন পর। ...। একটা মুখ আঁটা বক্স এনে টেবিলে রাখলো চুপচাপ ছেলেটা। জানে, রাতে পড়ার সময় বক্সটায় আর দুই কি তিনটা পিঠাই বাকি থাকবে। তবু, একলা খেতে পারে না ও। সেরাতের তীব্র আক্ষেপও এখন বদলে গেছে তৃপ্তিতে। একটা অদ্ভুত সত্য জেনে গেছে ও। হৃদয়ের খুব গভীরে লুকিয়ে থাকা একটা অজানা অভাব মিটিয়ে দিতে বাসের সেই দৃষ্টিপাতের ঘটনাটা ঘটেছিলো কি? কে জানে!

 

দুই দুগুনে চারটা হাতের অদৃশ্য স্পর্শ, একটা শান্ত তরুণকে চিরজীবনের জন্য শিখিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে, হোক বিপরীত লিঙ্গ, সব ভালোবাসার সমাপ্তি শুধু একটাই গন্তব্যে নয়। কিছু কিছু আকর্ষণ জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, কিছু ভালোলাগা, ভালোবাসা শুধুই মস্তিষ্কে বাসা বাঁধে, সেখানেই কাজ করে যায়, ... আমরণ!

 


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)