সকালটা যেনো হাওয়াই মিঠাই! ধরার আগেই শেষ, তবুও ধরতে ছুটতে হয় রোজ। ঘড়ির কাঁটার সাথে,দিনের সব কাজ সাজাতে৷ শেষ কবে একটা গভীর ঘুম দিয়েছিলো মনে পড়ে না শুধু প্রতিদিন
আশা জাগে,আগামীকাল ইনশাআল্লাহ একটা ভালো ঘুম দিব,আসছে ছুটির দিন একটা ভালো ঘুম হবে,সামনে একদিন মায়ের বাসায় যেয়ে ভালো করে ঘুমিয়ে আসবো কিন্তু সেরকম দিন গত ১৩বছরে আর আসেনি লোপার জীবনে। ৪জন ননদ,একজন দেবর,শ্বাশুড়ি তাদের পরিবার নিয়ে তৈরি সংসারের একমাত্র ছেলের বউ,দুই সন্তানের মা,বাবার বড় মেয়ে আর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা এই এতো পরিচয় নিয়ে কি আর একটা ভালো ঘুম দেয়া যায়? না উচিত?
আফসোস কে দমাতেই মনে আশা তৈরি করে রাখে,যাতে মনটা আফসোস এর তীরে বিদ্ধ না হয়। বার্ষিক পরীক্ষা চলছে,পরীক্ষা ঠিক না মূল্যায়ন বলে যাকে। মোটামুটি ব্যস্ততা স্কুলে,সেই সাথে টিচার্স রুমে আড্ডা। নানান টপিক আর নানান যুক্তি! লোপার মাঝেমধ্যে বিরক্ত লাগে,মাঝেমধ্যে ভালোই লাগে। তবে খুব একটা মন্তব্য করে না।
হাতের কাজ টা দেখতে কেমন যেনো ঝাপসা লাগছে আজ! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। রেনুজা সেটা খেয়াল করলো। খালাকে দুই কাপ চা দিতে বলে,চেয়ারটা লোপার দিকে ঘুরিয়ে বসলেন। লোপা সেই ঝাপসা চোখেই তাকালো রেনুজার দিকে,একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
-ঠিক আছিরে আমি। ক্লান্ত লাগছে!
রেনু একটা হাসি দিয়ে আশ্বস্ত করে নিজের কাজে তাকালো। লোপার সাথে পরিচয় প্রায় ১৬ বছরের। এটুকু অন্তত বুঝতে পারে,ও কখন কি ভাবছে। হাজারটা ঝামেলা নিয়েই তো সবার জীবন,কারও চেয়ে কারোরটা কম না তবুও চলতে পথে একটু পাশের জনের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেয়াটাও অনেক বড় সাহায্য বটে।
স্কুল থেকে বের হবার আগে ম্যাসেজ আসলো, লোপার ম্যাসেজটা পড়ে আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। প্রচন্ড রাগ আর অশান্তি লাগছে। চুপ করে চেয়ারে বসে থাকে কিছুক্ষণ। রেনুর আজকে বেশ তাড়া আছে,আগামীকাল শুক্রবার বাসায় মেহমান আসবে,যাবার আগে বাজারে যেতে হবে কিন্তু লোপাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে খারাপ লাগছে!
- এই লোপা,চল একসাথে রিকশায় একটু ঘুরে আসি।
লোপা মাথা নাড়লো। রিকশায় বসে চুপ করেই আছে যদিও,রেনু নিজে থেকেই বললো,
-চা খাবি সাথে পুরি? গাছতলায় বসি চল। খালিপেট কিন্তু মাথা বেশি হ্যাং করে রাখে,কিছু খেয়ে নে আগে।
এদিকটায় কোচিং সেন্টার আছে অনেক গুলো,বেশিরভাগ ই ভর্তি কোচিং কিছু চাকরির। এক সময় ওরা দুজন এদিকে খুব আসতো,অনার্স শেষ করেই বিসিএস কোচিং করেছিলো একসাথে।
খেতে খেতে লোপা বললো,
-শাফিনের বিয়েটা ঠিক হলো,আজকে মেয়ের বাবা-মা, মামা আসবেন আমার বাসায়,ডেট ঠিক করতে।
রেনু চা এ চুমুক দিয়ে বললো,
-কোথায় ঠিক হলো বিয়ে? আর শাফিনদের নিজের বাসা থাকতে মামার বাসায় কেন বিয়ের তারিখ ঠিক করতে আসবে ওরা?
- বিয়ের আগে,নিজেদের পুরনো বাসার চাইতে মামার আলিশান বাসা দেখানোই ভালো তাই না?
বলেই হেসে ফেললো দুজনে।
-তা মেয়ে কেমন? পড়ছে?
-বিসিএস ক্যাডার,কাস্টমস এ জয়েন করেছে ৬-৭ মাস হলো।
মুখে বিষম খেলো মনে হয় রেনুজা! লোপার শ্বশুর বাড়ির মেয়েরা নাকি চাকরিই করে না,এক লোপাই প্রাইমারি স্কুলের চাকরি করতে যেয়ে অজস্র কথা শোনে,সেখানে লোকমান ভাইয়ের ভাগ্নের বউ হবে বিসিএস ক্যাডার?!! কিভাবে?
লোপা বুঝতে পারলো রেনুর মনের অবস্থা। মুখে আগের মতো ই উদাস হাসি রেখে বললো,
- জানিস,রাফাতের বাবা কি বলেছেন? যখন তার চাচা জিজ্ঞেস করলেন,ব্যাংকার ছেলের জন্য বাড়ির বউ হিসেবে বিসিএস ক্যাডার মেয়ে আনবে তোমরা? তখন সে বিশাল একটা হাসি দিয়ে বলেছে, বিসিএস ক্যাডার মেয়ে কি হাতের মোয়া নাকি,শাফিনের ভাগ্য ভালো যে এরকম মেয়ে কে বউ হিসেবে পাচ্ছে,পরিবারে একজন বিসিএস ক্যাডার থাকাটা আজকাল অনেক বড় ব্যাপার।
বলতে বলতে স্বর ধরে এলো লোপার। আবার শুরু করলো,
- তুই যদি তার মুখের হাসি আর এক্সপ্রেশান দেখতিরে দোস্ত! আমার বুকটা ভেংগে গেছে,কিভাবে পারে বলতে? তাও আমার সামনে!
লোপা রাগে কাঁপতে থাকে! রেনুর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে৷ হায়রে মানুষ!
বেশিদিন আগের মনে হয় না অথচ ৮বছর অলরেডি চলে গেছে। পর পর তিনবার রিটেন থেকে বাদ পরে চতুর্থবার পাশ করেছিলো লোপা,ভাইভার ডাক আসলো। ততোদিনে বিয়ে,বিশাল সংসার,ছেলে সব সামলে রাত দিন পড়তো আর একটা ই আশা,বিসিএস ক্যাডার হবে। লোকমান ভাই বিয়ের আগে পরে এসব নিয়ে কোন মাথা ঘামাননাই,দেখা যাক কি হয় টাইপ অবস্থা, সংসারের কোন কাজে অবশ্য উনি বা তার বোনেরা,মা কেউ ই কোন ছাড় দেননি তবুও লোপা দমে যায়নি।
কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো ভাইভায় ডাক আসার পর। লোপার শ্বাশুড়ি ননদদের সেরকম বিরক্তি আর জামাইর নিষেধাজ্ঞা পার হয়ে ভাইভা এক্সাম আর দেয়া হয়নি। সংসার টেকাতে বিসিএস ক্যাডার হবার স্বপ্ন শেষ মুহূর্তে এসে ছেড়ে দেয়। দিতে বাধ্য হয়। ততোদিনে লোপার বাবা রিটায়ার্ড করে অসুস্থ,ভাই মাত্র একটা কোন রকম চাকরিতে ঢুকেছে,বড় মেয়ে বিসিএস ক্যাডার হয়ে ডিভোর্সি হবে,এটা কোন দিক থেকেই ভালো সিদ্ধান্ত না। অত:পর সব দিক থেকেই শূন্য হাতে জায়নামাজ এ বসেছিলো শুধু।
সেই দিন গুলো সেই কথা গুলো আজো এতো স্পষ্ট যে,আজ এতো বছর পর বাসার এই পরিবর্তন এ সবচেয়ে বেশি হৃদয় টা রক্তাক্ত হচ্ছে লোপারই। প্রাইমারিতে আসাটার সিদ্ধান্ত নিতেও কম বেগ পোহাতে হয়নি,ব্যারিস্টার সাহেবের বউ প্রাইমারি স্কুলের পড়ায় এটাও অনেক ইজ্জতহানিকর ছিলো বটে কিন্তু বিসিএস এর স্যাক্রিফাইস করার পর লোকমান সাহেব দিনের পর দিন বউয়ের চোখের পানি,বিষন্নতা দেখতে দেখতে বিরক্ত ছিলেন। দয়া করেছিলেন নাকি আসলেই সুযোগ দিয়েছিলেন কে জানে!
এই ৮বছরে লোপা যতোবার নিজের বেতন, জমানো টাকা বাবার সংসারে দিয়েছে ততোবার ও দেখেছে,স্বামীর তাচ্ছিল্য আর বাবা-মা এর দীর্ঘশ্বাস! প্রায় প্রতিমাসেই বেতনের দিন আসার আগেই মা ফোন করে,এই সেই সমস্যা বলেন,ভাইয়ের একার ইনকামে সংসার, বাবার চিকিৎসা চালিয়ে নেয়াটা খুবই কষ্টকর হয়ে যায়,নিরুপায় হয়েই মেয়েকে বলেন মা।
লোপা কেবল নিজেকেই কোথাও খুঁজে পায় না,স্বামীর বিলাসী সংসার তবুও এখানে ননদ-শ্বাশুড়িদের কাছে সে স্রেফ একজন বউ যার এই সংসারে কাজ ছাড়া তেমন প্রয়োজন নেই আবার বাবার সংসারে মেয়ের ইনকাম দরকার হলেও,দিন শেষে "সংসার ই তোর সব" জ্ঞানটা ই কেবল অবশিষ্ট! আর স্বামীর কাছে? লোপা যেনো আরোও অতলে ডুবে যায় তাই আর ডুব দিতে সাহস পায় না। ভেসেই আছে ভেসেই যাচ্ছে।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে,রেনু মোবাইলে ঘড়ি দেখে লোপার কাঁধে হাত রাখে। প্রতিবারের মতো এবারো ফুলস্টপ টা লাইনের শেষে বসাতে তো হবে। প্যারা যতোই দীর্ঘ হোক।
-চলরে এবার,ছেলেমেয়েরা একা না বাসায়? তুই না গেলে হবে?
লোপার চোখ আবার ভিজে উঠে!
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)