অনির্ধারিত

“তুমি মর কারো ঠেলায়,কেউ-বা মরে তোমার চাপে”

“তুমি মর কারো ঠেলায়,কেউ-বা মরে তোমার চাপে”
উপদেশ এক মারাত্নক বস্তু। কেউ চাইলে বা কাউকে শুধরে দিতেই উপদেশ দিই। অথচ আমার দেয়া উপদেশ ওজনে মস্ত ভারি হয়ে আমাকেই ধ্বংসে ফেলে দিতে পারে। কিভাবে?
 
ঈমানের তিনটা স্তর। কোন অন্যায় অশৈলী কিছু হতে দেখলে হাত দিয়ে থামানো, নইলে মুখে প্রতিবাদ করা কিংবা অন্তত অন্তরে ঘৃণা করা।
এখন সোশ্যাল মিডিয়া এসে যাওয়াতে ম্যালা উপকার হয়েছে। স্কুল কলেজের অনেক বান্ধবীকে খুঁজে পেয়েছি। এমনকি চিনতাম না এমন অনেক ছেড়ে আসা মানুষের সাথেও চেনাজানা হয়েছে। কিন্তু নিজেকে আরও ধুয়ে নেয়ার প্রয়োজনও শিখায় এই হই হুল্লোড় ভরা মিডিয়া।
 
আমার চোখে আমি কারুর একটা দোষ বা ভুল কাজ দেখলাম। আমার করণীয় কি? হাত-মুখ-মন? এই সূচী ধরে আগাবো? আগে হাতে থামানোর চেষ্টা করবো। তারপর না ফিরলে আচ্ছামত বকবো। আর এর পর মনে ঘেন্না করবো, কাকে? ওই মানুষটাকে, গজগজ করে বলবো, ‘উফফ কেমন জানি। আমি বাবা এইসব পারি না। কিভাবে কথা বলে? এতো জাজমেন্টাল কেন? কেন এইভাবে না পরে অইভাবে হিজাব পরে? কেন বাচ্চাকে এভাবে পালে, ওভাবে পালে?’ ব্যাস! দায়িত্ব খতম। আর যদি কোনোটারই সুবিধা করতে না পারি, তাহলে উপদেশ ঝাড়বো, ‘তোমরা যারা এইভাবে হিজাব পর’। এর পর হাত ঝেড়ে ঘুমাতে যাবো। সুন্দর। মন ভালো। রাগও ঝাড়া হল, ঈমানেরও সব স্তরের চরম পরাকাষ্ঠা দেখানো হল। না?
 
না। হল না। আমি জানি না, কে কোন পরিস্থিতিতে আছে। কে কোন জুতো পায়ে হাঁটে, সে জুতোয় কেমন ব্যথা। আমি জানিনা, যে মহিলাকে চাকরি করার জন্য আমি তুলোধুনো করেছি যে তার বাচ্চারা মানুষ হবে না, তার কথায় একদিন আমার বাচ্চাও ভুল পথ থেকে ফেরত আসতে পারে। আমি জানিনা, যে বাচ্চাটা বখে গেছে বলে তার বাপ মা’কে ভর্ৎসনা করছি, একদিন আমার মেয়েকে আমি আঙ্গুল তুলে দেখাবো, ‘উনার মত হবে’। আমার কথায়, মন্তব্যে, স্ট্যাটাসে আমি নাস্তিক নাস্তিক বলে মুখে ফেনা তুলছি যাকে দেখিয়ে, সে হয়ত আল্লাহর কাছে যাবার আগে শেষবার ফিরবে, হয়ত ওই দুনিয়ায় তার মর্যাদা আমার চেয়ে বেশী হবে?
 
তাহলে কি করব? উপদেশ দিবো না? দিবো। সাধারণ উপদেশ দিতে মনে রাখবো, যেন কেউ এ থেকে কষ্ট না পায়, বিরূপ হয়ে না যায়। আমি মুবাশশিরের উত্তরাধিকারী, বড়জোর সুসংবাদ দিতে পারি। আমাকে তো নিষেধ করা হয়েছে, যেন সহজ করি, যেন বীতশ্রদ্ধ না করি। যে আল্লাহকে খুশী করতে দুনিয়ার সব্বাইকে আমি বিচার আচার সেরে আগুনে ফেলে দিচ্ছি, সেই আল্লাহই বলেছেন এইসব। আর যদি খুব বুদ্ধিমান হই, তাহলে এই মানুষগুলোকে দিয়েই আমার দুয়ার শব্দ সাজাবো। ‘আল্লাহ, দেন এই মানুষটাকে বদলে’। উমারের নেতা উমারকে এমন করে চেয়ে এনেছিলেন, আমি জানি তো। তিনি আল্লাহকে বলতেন, ‘হয় উমার নইলে আবু জাহল, একজনকে আমাকে দেন, অন্তর খুলে দেন’। এই না হলে নেতা? আর আমি কীবোর্ডে ঝড় তুলে ব্যাস, হাটের মধ্যে উপদেশ দিয়ে বাড়ি ফিরবো? ভাববো, ‘যাহ, কর্তব্য সেরে ফেললাম?’ কোনোদিনও না। সওয়াবের আশায় বলা দাওয়াতের শব্দে কারও অন্তর দমে গেলো, কান্না আসলো, নিরাশ হয়ে গেলো কেউ, এই সবের ওজন তো ওইটুকু সওয়াবের কাছে জিতে যাবে। হিতে বিপরীত না হয়ে যায়।
 
আমি নিজে সাধারণ টলোমলো ঈমানের মানুষ। ভালো তো দূর, অন্যায় না, এমন কাজের সঞ্চয় নাই। পাওয়ার আশায় এই হারানোর আয়োজন করতে আমার ভীষণ ভয় লাগে। আমার মুখের কথায় কেউ কষ্ট পাওয়ার চেয়ে আমার কাছে ‘নিরবতাই হিরন্ময়’। তেমন কোন মহামানুষের ‘ধুয়ে দেয়া’ টাইপের লেখা দেখলে অতি নিরবে চোখ নামাই, আর মনে মনে আউড়াই, ‘দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর’। প্লীজ!
 
ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট 
শিরোনামঃ বোঝাপড়া- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)