উইমেন (সামাজিক,মানসিক,সুবিধা বঞ্চিত নারী)

'মানুষ যদি সে না হয় মানুষ, দানব কখনও হয় না মানুষ''

'মানুষ যদি সে না হয় মানুষ, দানব কখনও হয় না মানুষ''
ফার্মগেট রুটের বাসগুলো এমন খতরনাক! বসেছি ড্রাইভারের পাশের সিটে। সমস্যা সেটা না। উলটো ঘুরে বসায় বাসের সবার চোখ আমার দিকে। যেন এক্ষুণি বলে উঠবো; ''সম্মানিত যাত্রী মহোদয়, মুসলমানদের আমার সালাম, হিন্দু ভাইদের নমষ্কার...'' ইত্যাদী। জোর করে চোখ ফিরিয়ে হাতের বইয়ে মন দিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বুঝলাম, এটাই একমাত্র সমস্যা না। মালিবাগ মৌচাকের বিচ্ছিরী রাস্তায় বারেবারে গিয়ার বদলাতে হচ্ছে ড্রাইভারের, আর প্রতিবার আমি উপহার পেয়ে চলেছি একখানা করে কনুইএর গুঁতো। :-x একটু পর, বাসে উঠেই বেকায়দায় পড়লেন এক মহিলা। মহিলা সিট ভর্তি। দাঁড়াতেই হয়েছে তাঁকে। কিন্তু অবলম্বন একটি মাত্র খাম্বা, ডান হাতে ধরে রেখেছেন বটে; কিন্তু ব্রাস ব্রেক কষলে কিংবা চলতে শুরু করলে ক্লকওয়াইজ বা এন্টিক্লকওয়াইজ আধপাক ঘুরে গিয়ে অন্যদের গায়ে পড়ছেন। পাশে দাঁড়ানো কিছু 'মানুষ' বেশ উপভোগও করছিলেন যদিও, আমার পাশেই বসা এক মহিলা ধমকে উঠলেন, ''কাঁধ ধরেছেন কেন? ছাড়েন। অন্য কিছু ধরেন'' পৃথিবী কী অত্যাশ্চর্য জায়গা! ধমকে ওঠা মহিলাও উঠেছেন কিছুক্ষণ আগেই। দুই মিনিট পর উঠলেই এখন উনি দাঁড়িয়ে যেতেন। ভাবলাম, এইবার! কাজে নামতে হবে। বই ব্যাগে রেখে চেইন আটকে ব্যাগের হ্যান্ডেল বাম হাতে পেঁচিয়ে নিলাম। আর ডান হাত? দাঁড়িয়ে থাকা আপুটার হাত শক্ত করে ধরে বললাম, ''হাত ধরেন''। কী অদ্ভুত এক হাসি দেখলাম। কারো ওপর নির্ভরতার অনুভূতি জানি, কিন্তু নির্ভর করে নির্ভার হতে পারার হাসি দেখিনি কখনও আগে। আধঘন্টা প্রায়, হাতের টনটনে ব্যথা উপেক্ষা করে ধরেছিলাম আরেকটি হাত। আধঘন্টা পর বসার জায়গা হল , আমার পাশেই বসে গেলেন ক্লান্ত আপুটা। আমিও হাত ঝেড়ে সোজা হয়ে বসলাম।নামার জায়গা এসে গেছে আমার। নামতে যাবো, একটা উষ্ণ হাত, আমাকে স্পর্শ করে জানিয়ে দিলো, না বলতে পারা অনেকগুলো কথা। খেয়াল করলাম্, হাতে শাখা-নোয়া। নামার আগমুহূর্তে, যখন হেলপার টিপস দিচ্ছে, ''বাম ফা আগে দ্যান'', এক পলকে দেখলাম, হ্যাঁ, মাথায় সিঁদুরও আছে। আমি হিন্দু নই। যার সামনে আমি মাথা নোয়াই তিনি আমার সামনে মূর্তি ধারণ করেন না। সামাজিক নিরাপত্তার জন্য তিনি আমাকে হিজাব করতে বলেছেন দেখেই আমি মাথা ঢেকে কাজে যাই। কিন্তু যে মানুষটি মূর্তির সামনে মাথা নুইয়ে শান্তি পায়? কিংবা সামাজিক নিরাপত্তায় সোডিয়াম পাইরোবোরেট সিঁথিতে মাখে? তাকে কি বলবো আমি? মানুষ?? নজরুলের অই দুইটা লাইন আমাকে মানুষ চিনতে শেখায়ঃ ''অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ- কান্ডারী, আজি দেখিব তোমার মাতৃ-মুক্তি-পণ। হিন্দু না ওরা মুসলিম-ওই জিজ্ঞাসে কোন্‌ জন, কান্ডারী, বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।।'' সৃষ্টিকর্তাকে সম্মান যে যেভাবেই করুক, সে বিচারের দন্ড আমার হাতে কি? মানুষ যখন, বিচারের কাঠগড়ায় আমি আর সে তো একই পাশে! হাতে হাত ধরে তাকে মানুষ বলতে আমার বাঁধা কি? আমার ধর্ম আমাকে যদি 'মানুষ'ই না চেনায়, তবে কিসের এতো উৎসবের ডামাডোল? কাকে নিয়ে তবে হবে সৃষ্টির উল্লাস? কার জন্য এতো বৈচিত্র্যময় পৃথিবী? আমার স্রষ্টাই যদি সত্যি হন, তিনি যদি তাঁর সকল সৃষ্টিকে মায়াভরে লালন পালন করে যেতে পারেন, তবে আমি কোন ছার যে তাকে নাক সিঁটকাই?

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ