অনির্ধারিত

''দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...''

''দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...''
বাসের শেষ স্টপেজে নামার একটা একঘেঁয়ে আনন্দ আছে। চাপাচাপি, হৈচৈয়ে ভরা বাসটা প্রবল তান্ডবের পর ঘুমিয়ে পড়া বাচ্চাটার মত নিরীহ হয়ে যায়। সেই ফাকাঁ ফাকাঁ একলা বাসে মহিলা সিটে বই পড়ছি। হেল্পার ছেলেটা একজনের জায়গা ফাকাঁ রেখে পাশে বসলো। ছোট একটা মানুষ , বয়স বড়জোর পনর , কিন্তু সেটা শরীরের্ বয়স। মনে মনে হয়ত সে আরও অনেক বেড়েছে , বাড়তে হয়েছে। হয়তো এমন গালি সে হাসতে হাসতেই দিতে জানে , যার মানেই আমি বুঝবো না। হয়ত চোখের সামনে সে কাউকে মরতে দেখেছে , কোন প্রিয়জনকে , হয়ত জ্যান্ত মানুষের হাঁটুর ওপর দিয়ে চাকা চালিয়ে পালিয়ে এসেছে ড্রাইভারের পাশে বসে। রাস্তায় এক জায়গায় ট্রান্সফরমার লাগাচ্ছে। ছুটির দিনের ভর দুপুরবেলা। রাস্তায় জ্যাম তো নাইই, দিলখুশার মত জায়গায় শুধু দুইটা বড় বাস দাঁড়িয়ে আছে, ট্রান্সফরমার লাগানো হলে যাবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বিরক্ত হয়ে বললাম, রাস্তা তো খালি ,রং সাইডে গেলেই হয়। একটু জোরেই বলে ফেলেছি, ড্রাইভার সত্যি সত্যি স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে রওনা দিলো। "খালাম্মা , গেলাম কিন্তুক!" ঝামেলার জায়গাটা পার হয়ে আইল্যান্ডে ছোট্ট একটা ফাঁকা দেখে এক যাত্রী বললেন, "এইদিকে দিয়া যাওয়া যাবে?" এইবার অল্প কয়জন যাত্রীর সবাইই উৎসাহী , কেউ বলে না না হবে না , কেউ বলে যান যান। মনে হল, ড্রাইভার একা না , সবার চেষ্টায় নব্বই ডিগ্রীতে বেঁকে আইল্যান্ড দিয়ে পার হয়ে আসলো বাসটা। হেল্পার ছেলেটা বাহাদুরের মতো তাকালো , "দ্যাখসেন পারায় আসলাম?" হেসেই সম্মতি দিলাম। এরপর পাশেই বসে সে তাঁর গল্পের ঝুলি খুলে দিলো। কোনদিন সে পাঁচ কিলোমিটার চালিয়েছে আট মিনিটে, কোনদিন হাত দিয়ে হ্যান্ডেল না ধরে গুলিস্তান থেকে সাইন্স ল্যাব গিয়েছে। স্বভাবজাত সংকোচ আমাকে সংকুচিত করে রাখছিলো। শুধু, মানুষ হবার কারণেই মনে হয়, আর একজন মানুষের অদৃশ্য উষ্ণতা আমাকেও পেয়ে বসলো। আমি ভুলেই গেলাম, একটু আগেই সভয়ে দেখছিলাম সে তাঁর চাইনিজ ফোনটায় একের পর এক ছবি দেখছিলো। সম্ভবত সে-ও মনে রাখেনি। আধবুড়ি আমাকে পেয়ে অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে বসেছে। সরল চোখগুলো আর তাঁর পেছনের অভিজ্ঞ চাউনি দেখে হতাশা বা অপরাধবোধ নয়, একটা জিজ্ঞাসা আমার দিকেই আমার মনযোগ ঘুরিয়ে দিলো। এই যে এতো কাজ, দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরা, সারাদিনের কাজগুলো মনে হয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলা, কিন্তু এই ছেলেটি কিংবা তাঁর মা কিংবা তাঁর বোন, কী করেছি আমাই তাদের জন্য? আমার বাসার পাশেই যাদের শহুরে ছনের ভ্যপসা ঘর, যার উনুনের কালো কালি মাঝে মাঝে আমার বাড়িতেও এসে ভুরু কুঁচকানোর কারণ হয়, আমি শুধুই তাদের ভালোবাসি। কাজের শেষে বাসায় যাবার পথে হাতে একটু বিস্কুট বা রুটি অথবা এক গ্লাস দুধ তুলে দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলি। কিংবা বাস থেকে নামার সময় ব্যাগটা এগিয়ে দেবার জন্য থ্যাঙ্কু বলে ওর গুল খেয়ে কালো হয়ে যাওয়া কচি দাঁতের হাসি দেখি। আর বড় কিছুর সাধ্য যে নাই! আমাকে ক্ষমা করবেন প্রভু? সীমার মাঝে থেকে অসীমের ভালোবাসাকে ধারণ করতে পারি নি। আপনার হাতের চেয়ে আমার হাত দু'টি যে অনেক অনেক ক্ষুদ্র??   (কোনদিন না দেখা , আসল কন্ঠ না জানা একটা মানুষ ফোন করলো। বাইরে যাবো , হাতে কাজের ভিড়। বাসে যাবো, বলতেই হেসে বললো, "শান্তি আপার আরও একটা পোস্ট আসছে তাহলে?" জীবন যুদ্ধের অক্লান্ত মুজাহিদ, এই পোস্টটা তোমার জন্য। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা কোন মানুষকে ভালোবাসা ছাড়া দেয়ার আর কিচ্ছুর সন্ধান জানা নাই শান্তি আপার . . . )

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)