বিবিধ

টাকার মূল্যে নারীর মূল্যায়ন!

টাকার মূল্যে নারীর মূল্যায়ন!
images “নারী ঘরে করেন এমন কাজের আর্থিক মূল্য গত অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশের সমান। চলতি মূল্যে টাকার অঙ্কে তা ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। স্থায়ী মূল্যে এটা পাঁচ লাখ ৯৪ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাথমিক হিসাবে, ওই বছর চলতি মূল্যে জিডিপির আকার ছিল ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৯২০ কোটি টাকার। গবেষণায় বলা হয়েছে, একজন নারী প্রতিদিন গড়ে একজন পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সময় এমন কাজ করেন, যা জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। একজন নারী এমন কাজ করেন প্রতিদিন গড়ে ৭ দশমিক ৭ ঘণ্টা। আর পুরুষ করেন মাত্র আড়াই ঘণ্টা। একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২ দশমিক ১টি কাজ করেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে এ কাজের গড় সংখ্যা ২ দশমিক ৭। জাতীয় আয়ে নারীর যে পরিমাণ কাজের স্বীকৃতি আছে, তার চেয়ে ২ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৯ গুণ কাজের স্বীকৃতি নেই। - প্রথম আলো।“ সিপিডির এই তথ্যটা পড়ার পর থেকে কেন জানি হাসি পাচ্ছিলো আমার!তবে হাসি পেলেও আসলে মানতে হবে,যে নারীবাদী সংগঠন গুলো মাঝে মাঝে কিছু কাজ করেন,যা এই সমাজ কে চোখে আঙ্গুল দিয়ে অনেক কিছু দেখিয়ে দেয়! অনেক কিছু নিয়ে নতুন করে আমাদের কে ভাবতে শেখায়। মাঝে মাঝে চারপাশে তাকালে মনে হয়,নারী কি আদৌ সৃষ্টির সেরা জীব?তাকে কি আসলেই সুপার কম্পিউটারের চাইতে অনেক গুণ বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন মেধা দেয়া হয়েছে! পশ্চিমা থিউরী,ইসলামের নিজস্ব মডিফাই থিউরী,সমাজের তৈরী থিউরী ইত্যাদি নানা থিউরীতে ফেলে আমরা ভুলেই যাই, নারীরাও 'আশরাফুল মাখলুকাত',রাব্বুল আ'লামীনের সৃষ্টির সেরা জীব। তাকেও দেয়া হয়েছে,মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ মেধা,যোগ্যতা। রাহমানুর রাহিম তাকেও সৃষ্টি করেছেন সর্বোচ্চ সুন্দর অবয়বে। তাকেও দেয়া হয়েছে,চিন্তা শক্তির দিক থেকে একজন মানুষ হিসেবে পূর্ণ স্বাধীনতা। একজন নারী তার প্রত্যেকটা পরিচয়ে সর্বোচ্চ দিতে সক্ষম ব্যক্তিত্ব। হোক তা 'মা' পরিচয়,হোক তা 'বোন,স্ত্রী,মেয়ে' হোক সে 'একজন কর্মী তার অফিসে,সমাজে'। এবং নারীর সেই দেবার ক্ষেত্র টা তার দেয়ার পরিধিকে বেঁধে রাখতে পারে না। তা সে ঘরেই থাকুক,কি বাইরে! সে সব জায়গা থেকেই তার সাধ্যের সব টুকু দিতে পারে। প্রশ্ন আসে, নারী কেমন করে পারে এতো দিতে??? সোজা বাংলায় এর উত্তর হতে পারে,কারণ,দিতে হলে সইতে জানতে হয়! দেয়া খুব সহজ কাজ না, এমনি এমনি কাউকে নিজের শ্রমের বিনিময় দিতে মানুষ চায় না,এটা দিতে হলে অনেক সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হয়। আর রাব্বুল আ'লামীন নারী কে সহ্য করার সেই অসীম ক্ষমতা দিয়েছে এবং তার সাধ্যের সর্বোচ্চ দেবার ক্ষমতাও অসীম করে দিয়েছেন। নারী যা যা,যতটুকু সইতে পারে,এবং তার বিনিময়ে কতটুকু দিতে পারে তা চিন্তা করতে হলেও অনেক কিছু সহ্য করতে হয়,যেটার ক্ষমতা আমাদের সমাজের নেই! সিপিডির এই অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা মন্ত্রী আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আমার মা অনেক কষ্ট করে আমাকে হিসাববিদ বানিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দেয়নি, মায়ের অবদান জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।’ আমার কথাটা পড়ে মনে হচ্ছিলো,ঐ অনুষ্ঠানে থাকা পুরুষদের কে যদি জিজ্ঞেস করা হতো,'আপনি আপনার স্ত্রীর কাজের কতটুকু মূল্যায়ন করেন?আপনি যদি স্ত্রীর কাজের মূল্যায়ন না করতে পারেন,তাহলে আপনার সন্তান কি করে পারবে,তার মায়ের কাজের মূল্যায়ন করতে?' তাহলে মনে হয়,সিপিডি আরেকটা গবেষণা করে ফেলতে পারতো! নারীর ঘরের কাজ কে কেমন করে স্বীকৃতি দিবে দেশ?? একটা দেশ তো সমাজের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকে,আর সমাজ হচ্ছে পরিবারের সমষ্টি। যেখানে পরিবার থেকে কোন স্বীকৃতি দেয়া হয় না, সেখানে আমাদের সমাজ কেন মেয়েদের কাজের কোন মূল্যায়ন করবে?,হোক তা ঘরে কি বাইরে! আমাদের সমাজে ঘরে কাজ করলে সেই ঘরের মানুষেরাই প্রশ্ন করে, 'ঘরে থাকা মহিলারা কি কাজটা করে শুনি??' 'সারাটা দিন ঘরে করো কি শুনি?' আর বাইরে কাজ করলেও একই ঘরের মানুষেরা বিশ্বাস করে,' এই মেয়ে তো নিজেকে ছেলেদের সাথে তুলনা করতে চায়' 'চাকরী করা মেয়ের আবার ঘরে কিসের সম্মান?সে তো টাকা ইনকামের জন্য কাজ করে,বিনিময়ে টাকা তো পাচ্ছেই!' 'বাইরে কাজ করে,মানে এই মেয়ে কে দিয়ে সুখের সংসার হবে না!' বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, সমাজ নারী কে একজন মেয়ে হিসেবে জীবনে চলতে পথে তার মতামতের সম্মান দিতে পছন্দ করে না!তারা তাকে অধিনস্ত্য হিসেবে ভাবতে চায়! একজন স্ত্রী হিসেবে তার অধিকার তার কাজের সম্মান দিতে পছন্দ করে না,তাকে অনেকটা হুকুমের দাসী কিংবা জীবন্ত মেশিন ভাবতে বেশি পছন্দ করে! এবং একজন মা হিসেবে যথার্থ মর্যাদা না দিয়ে,বরং সব কষ্টের দায়ভার তাকে দিয়ে,সব ক্ষেত্রে তার নীরব সম্মতি চায়!! আর যেসব মেয়েরা বাইরে কাজ করতে আসে,তাদের কে নিজেদের মুনাফা-ভোগের মাধ্যম এবং সমাজের অবাঞ্ছিত কেউ হিসেবে তুলে ধরে রাখতে চায়! ইউনিভার্সিটি লাইফের প্রথম দিকে,ভার্সিটির এক সেমিনারে এসেছিলেন দেশের প্রখ্যাত একজন অর্থনীতিবিদ। তখন চারপাশে সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার আইন নিয়ে বেশ ঝড় চলছিলো। তো সেই স্যার তার বক্তব্যে বলছিলেন, 'আমি ৩২ বছরের সংসার জীবনে আমার স্ত্রীর পেছনে যতটাকা খরচ করেছি,তার তুলনায় বিয়েতে দেয়া মোহরানা টা কিছুই না,এবং এখন যদি সে সম্পত্তিও দাবী করে আর পরিমানও সে ক্ষেত্রে অনেক কম!' তখন আমি হাত তুলে বলেছিলাম,'স্যার কথাটা অনেক বেশি গদবাঁধা হয়ে গেলো না? আপনি ৩২বছর আপনার স্ত্রীর পেছনে খরচ করা টাকার পরিমাণ,মোহরানার পরিমাণ,সম্পত্তির পরিমাণ উল্লেখ করলেন,কিন্তু আপনি চিন্তা করে বলুন তো স্যার,আপনার স্ত্রী এই ৩২বছর আপনার জন্য যা করেছে তার পরিমাণ কতটুকু? রোজ আপনার খাবার তৈরী করা,আপনার কাপড় রেডি করা,আপনার বাড়ী-সন্তানদের দেখা শুনা করা,আপনার সব রকমের চাহিদা পূরণ করা এই সব কাজের পরিমাণ= আপনার খরচ করা টাকার পরিমাণ আসলে কতো এটা উল্লেখ করবেন না?' আমার প্রশ্ন শুনে স্যার হেসে বলেছিলেন, ' কিন্তু তোমরা তো টাকা টা ই বড় করে দেখো!তোমরা টাকাও চাও আবার সম্মানও চাও!' আমি বলেছিলাম, 'সরি স্যার,আমরা টাকা চাই না,চাই স্বীকৃতি! যখন একজন নারী হিসেবে কোন অবস্থানেই নারীরা নূন্যতম স্বীকৃতি টুকু পাচ্ছিলো না তখন পশ্চিমারা এসে শিখিয়ে গেলো, টাকা= সম্মান+স্বীকৃতি! নারী,তোমার কাছে টাকা আছে?থাকলে তোমার আছে সম্মান,আছে তোমার কাজের মর্যাদা! ব্যাস,আমরা তাই লুফে নিলাম আর সেই সুযোগে সমাজের মুখোশধারী পুঁজিবাদী অধিপতিরাও প্রতিষ্ঠা করে ফেলল সেই থিউরী! সমাজ দূরে ঠেলে দিলো সেই থিউরী,যা কোন রকম টাকার পরিমাণ ছাড়াই ১৪০০ বছর আগে নারীকে মানুষ হিসেবে দিয়েছিলো উপযুক্ত সম্মান এবং স্বীকৃতি। যে থিউরী সমাজে নারীকে টাকা ইনকামের মাধ্যম হিসেবে নয়,বরং নারী কে রেখেছিলো সুন্দর সমাজ তৈরীর উপযুক্ত কারিগরের অবস্থানে!' স্যার সেদিন আমার কথা এক্সসেপ্ট করেছিলেন এবং সব শেষে বলেছিলেন,'এই অবস্থার যদি পরিবর্তন চাও তাহলে তোমাদের কে ই এগিয়ে আসতে হবে,মনে রেখো।' আজ পর্যন্ত গবেষণা করে অনেক কিছুই বের করলেও খুব ইম্পোর্টেন্ট কথাটাই বের করতে পারে না,আর তা হলো কারা এবং কোথায় আসলে নারীর কাজের মূল্যায়ন করতে গেলে,তার উপযুক্ত সম্মান দিতে সবচেয়ে বেশি বাঁধা দেয়?? এই ৭৫শতাংশ নারীরা কি আদৌ জানে?এজ এ হোমমেকার,তারা যা করে তা কতোটা মূল্যবান! কিংবা ঐ ২৫শতাংশ যে বাইরে কাজ করছে,তারা কি আদৌ জানে?ঘরের কাজ-বাইরের কাজ দু'টোই এক সাথে সামলানো কতোটা মূল্যবান কাজ! যেখানে নারী ঘরে-বাইরে উভয়ক্ষেত্রেই সম্মানিত,মূল্যবান সেখানে কেন তারা ভাবে? যে,আমি ঘরে থাকলেই মূল্যহীণ আর বাইরে গেলেই মূল্যবান! কেন নারীকে এভাবে ভাবতে হয়,যে আমি ইনকাম করি না বলে পরিবারে আমার মূল্য কম?!! আবার কেন যে সব নারীরা ঘরে কাজ করেন,তারা বাইরে কাজ করা নারীদের কাজের মূল্যায়ন করতে চান না?আবার কেন যারা বাইরে কাজ করেন,তারা ঘরে কাজ করা নারীদের কাজ কে মূল্যবান ভাবতে পারেন না? নারীকে পুরুষের তুলনায় দায়িত্ব কম দেয়া হতে পারে,তাকে শারিরীক ক্ষমতা কম দেয়া হতে পারে,কিন্তু মানুষিক সক্ষমতা,সম্মান পাবার অধিকার,উপযুক্ত মূল্যায়ন পাবার যোগ্যতা কোন অংশেই কম তো নয়,বরং বেশিই দেয়া হয়েছে। দায়িত্বের দিক থেকে যদি ইকুয়্যাল সেন্সে চিন্তা করা যায়,তাহলে দেখা যায়  পরিবার,সমাজ এর কোথাও কোন পরিমাণে কম দায়িত্ব নারীকে দেয়া হয়নি। তাহলে নারীরা কেন এটা বিশ্বাস করতে চায়,যে সে বাইরে কাজ করলে তার দায়িত্ব বেশি,আর ঘর এ করলে কম?! এই সব প্রশ্নের উত্তর গুলো একটা জায়গা কে আর একটা বিষয় কে দায়ী করে,তা হলো, নারীকে তার ঘর উপযুক্ত সম্মান-স্বীকৃতি দেয় না,আর তাই সে পারে না নিজের ঘরে থেকেও নিজের সম্মান আর স্বীকৃতি আদায় করে নিতে,ফলে নারী বাইরে এসে সম্মান খুঁজে আর সমাজ আজো নারীকে টাকার মাপে মাপতে শেখায় প্রজন্মের পর প্রজন্মকে! আজ কর্মজীবি নারী হিসেবেই হোক কি ঘরে থাকা নারী,রাষ্ট্র যদি নারীর কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি দিতে চায়,তাহলে সবার আগে নারীর কাজে স্বীকৃতি দিতে হবে তার ঘর কে,তার আপনজনদের কে। আর পুরুষকে এই কাজ গুলো করতে শেখাতেও হবে একজন নারী কে ই! কখনো মা,কখনো বোন বা স্ত্রী যে ভূমিকাতেই থাকুক না কেন,সমাজ কে এটা মেনে চলতে শেখাতে হবে,যে একজন নারীর প্রতি যে দায়িত্ব দিয়ে পুরুষ কে পাঠানো হয়েছে,যে কারণে তাকে নারীর চাইতে কিছু ক্ষেত্রে উপরে মর্যাদা দেয়া হয়েছে পুরুষ কে আগে সে দায়িত্ব পরিপূর্ণ ভাবে পালন করতে হবে, একজন নারী কে মানুষ হিসেবে সম্মান,তার অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা এবং তার কাজের যথার্থ স্বীকৃতি দেবার দায়িত্ব একজন পুরুষ কে দেয়া হয়েছে বলেই,পুরুষের দায়িত্ব বেশি। নারীকে অধিনস্ত্য কেউ নয়,বরং সহযাত্রী ভাবতে শিখতে হবে,কারো মা,স্ত্রী এবং মেয়ের পাশাপাশি সে একজন পরিপূর্ণ মানুষ এটা বিশ্বাস করতে সমাজ বাধ্য। অধিকার,সম্মান এবং ভালোবাসা কোন দিক থেকেই নারী-পুরুষদের প্রাপ্য একে অপরের কাছে কোন অংশে কম নয়। সুতরাং ঘরে যখন নারী তার এই অধিকার গুলো পরিপূর্ণ ভাবে পাবে,তখনই সম্ভব হবে সমাজে এবং রাষ্ট্রে নারীর কাজের উপযুক্ত সম্মান প্রতিষ্ঠা হওয়া। তখন নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শিখবে সমাজ,টাকার অংকে নয়! টাকা ইনকামের মাধ্যম হিসেবে নয়!

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন