সাহিত্য

অন্তঃরালের ছায়া... ১ম খন্ড

অন্তঃরালের ছায়া... ১ম খন্ড
download (1) মানুষের মনের রাজ্যে বিচরণ করাটাকে নূরির সবচেয়ে প্রিয় শখ বললে মোটেই ভুল হবে না। নিজেকে মনোজাগতিক অভিযাত্রী ভেবে প্রায়শই পুলকিত হয় সে। তাই সময় পেলেই নিজের বা অন্য কারো মনের ট্যাকিংয়ে বেড়িয়ে পড়ে। নতুন কিছু দেখার, শোনার, বোঝার, অনুভব ও উপলব্ধি করার মাধ্যমে উন্মোচন করার চেষ্টা করে মন নামক রহস্যপুরীর রহস্য ভান্ডারের ক্ষুদ্র কোন রহস্যকে। মনকে মন দিয়ে উপলব্ধি করার এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি কাজ করে নূরির ভেতর। ছুঁয়ে দেখতে চায় স্পর্শের বাইরে অতলান্তে নিমজ্জিত থাকা মনের ভাবনাগুলোকে। কিন্তু কিছু কিছু অভিজ্ঞতার কারণে কারো মনের অবগুণ্ঠিত ভাবনার রাজ্যে প্রবেশ করতে এখন বেশ ভয় ভয় লাগে নূরির। কেননা অদ্ভুত শীতলতা ছড়ানো নিস্তব্ধতা বিরাজ করে সেখানে! চারিদিক অন্ধকারের ধোঁয়াচ্ছন্ন কুয়াশার চাদরে ঢাকা! কখন যে কি সামনে বেড়িয়ে আসে সেই আতংকে থাকতে হয়! চলার পথের প্রতি মোড়েই ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারে নতুন কোন অদেখা চমক! হঠাৎ বিজলীর মত ঝলসে উঠে চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে অজানা কোন তথ্য। হুমড়ি খেতে পড়ে যেতে পারে অগভীর কোন খাঁদে। সুঁচালো পাথরের খোঁচা এসে লাগতে পারে বাহুতে! চোরাকাঁটা বিঁধে রক্তাক্ত হতে পারে পদযুগল।   সামনে বসে চোখের অঝোর শ্রাবণে নিজেকে সিক্ত করে চলা বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে নূরি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না ঠিক কি করবে! সে কি দেখার চেষ্টা করবে ভাবনারা কোন ধারায় প্রবাহিত ইলমার মনের অবগুণ্ঠিত কোনে? সন্ধান করে দেখবে ইলমা মুখে যা বলছে সেটাই সত্যি নাকি মনের কথা ভিন্ন কিছু? চোখ ঘুরিয়ে রুমের বন্ধ জানালার দিকে তাকালো নূরি। হাত বাড়িয়ে আলতো ধাক্কায় খুলে দিলো জানালা। হুড়মুড় করে রুমে ঢুকলো বরফ শীতল বাতাস। মূহুর্তেই কাঁপন ধরিয়ে দিলো শরীরে। ইলমাও ঠান্ডায় কুঁকড়ে গিয়ে মুখ তুলে একবার নূরির দিকে আরেকবার খোলা জানালার দিকে তাকালো! ইন্টারকম চেপে দুই কাপ কফির অর্ডার দিয়ে নূরি বলল, কান্না করেই যদি সমস্যার সমাধান হয়ে যেত তাহলে এই দুনিয়াতে কেউই সমস্যাগ্রস্ত থাকতো না। চোখের পানির বানে সমস্যা ভাসিয়ে দিতো। তারপর নতুন সমস্যা তৈরিতে ঝাঁপিয়ে পড়তো।   খানিকটা ক্ষোভের স্বরে ইলমা বলল, তুই সবসময় এভাবে কথা বলিস কেন?   কারণ আমার কাছে বলার মত এমন কথাই আছে। তোকে খুশি করার জন্য বলতে হলে আমাকে অন্যের কাছ থেকে কথা ধার করে আনতে হবে। আপাতত আশেপাশে কেউ নেই। তাই নিজের কথাই এখন সম্বল আমার।   তোর কাছে আসাই আমার ভুল হয়েছে। এরচেয়ে রাস্তায় চলন্ত কোন গাড়ির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তাম সেটাই ভালো ছিল। আনান যা করেছে এরপর বেঁচে থাকার কোন অর্থই নেই আমার।   কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূরি বলল, তুই কি একটা তথ্য জানিস?   কি তথ্য?   জীবনের সব রাস্তায় তা সেটা যেমনই হোক না কেন। মানে, সমতল, উঁচু-নীচু, খাঁদা-খন্দে ভরা, কিংবা কন্টকাকীর্ণ! সব রাস্তাতেই অবশ্যই ইউ টার্ন থাকে। কিছু দূর চলার পর যদি মনেহয় ভুল পথে চলছি কিংবা পথ চলাটা যদি খুব বেশি কষ্টসাধ্য হয়ে যায় তাহলে ঘুরে ফিরতি পথ ধরা যায়। কিন্তু মৃত্যু ওয়ান ওয়ে জার্নি। মৃত্যুর রাস্তাটা আমাদেরকে এমন এক মোড়ে নিয়ে যায়। যেখানে কোন ইউ টার্ন থাকে না। অর্থাৎ, ভুল হয়েছে ভেবে কেউ ফিরে আসতে পারে না। তাই সঠিক পথ খুঁজে নেবার কোন সুযোগও সে আর পায় না।   আবারো মাথা নীচু করে বসলো ইলমা। ফোঁপাতে শুরু করলো আবারো। নূরি বলল, আমার কথা শুনে রাগ করিস না। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় যদি চিন্তা করিস তাহলে তোর কাছেও মনেহবে যে তুই যা করছি এটাকে ওভার রিঅ্যাক্ট বলে।   মুখ তুলে এবার জলন্ত চোখে নূরির দিকে তাকালো ইলমা। রাগে কড়মড়িয়ে বলল, আমি ওভার রিঅ্যাক্ট করছি? আমি? আমি?   নূরি বলল, হুম! তুই ওভার রিঅ্যাক্ট করছিস।   কি দেখে তোর এমন মনে হলো?   অনেককিছু দেখে। আমি তো আসলে হুট করে কথা বলি না। অ্যানালাইস করি, রি-অ্যানালাইস করি, নিজের কাছে ক্লিয়ার হই। অতঃপর অন্যেকে বলি।   ঝাটকা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ইলমা। নূরিকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গটগট করে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। ইলমার আচরণে মোটেই বিচলিত হলো না নূরি। কিছু কিছু মানুষের স্বভাবই হচ্ছে সবকিছু নিয়েই হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দেয়া। সুখের বাঁধে এক চিলতে দুঃখের চিড় দেখা মাত্রই সেটা নিয়ে এমন অস্থির হয়ে যায় যে তাদের অস্থিরতার কারণে সেই ছোট্ট চিড়টাই রূপান্তরিত হয় বিশাল ফাটলে। ফলে সুখের বাঁধ ভেঙে জীবনে প্রবেশ করে কষ্টের বন্যা। এই বন্যার জন্য তারা নিজের অতি সতর্কতাকে দায়ী না করে, দায় চাপায় অন্যের কাঁধে। ইলমা ইচ্ছে ঠিক তেমন স্বভাবের মানুষ। কেউ খাবার খায় সোজা হাতে আর কেউ খায় ঘাড়ের পিছন দিয়ে ঘুরিয়ে। ইলমা হচ্ছে ঘুরিয়ে খাওয়া দলের মানুষ। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবে, খাল কেটে কুমির আনবে। অতঃপর এখন আমার কি হবে গো বলে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেবে। কফির ট্রে হাতে ইলমাকে রুমে ঢুকতে দেখে হাসি চাপলো নূরি। তার জীবনে দেখা সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে মেয়েদের মধ্যে অন্যতম ইলমা। এতটা কনফিউজড কিভাবে হতে পারে একজন মানুষ যে নিজের আচার-ব্যবহার, কর্মকান্ডের পেছনে কোন যুক্তি আছে কি নেই সেটা ভেবে দেখারও দরকার মনে করে না? যা মনে আসে ব্যাস করে ফেলে!   স্বশব্দে ট্রে টেবিলে রেখে ইলমা বলল, মাথা ধরেছে প্রচন্ড। কফি খেয়েই চলে যাবো আমি।   নূরি নিজের কফির মগ নিয়ে হেসে বলল, অকারণে হাউমাউ করলে মাথা তো ধরবেই!   আমি অকারণে হাউমাউ করছি? তুই যদি জানতে পাস তোর স্বামী বিয়ের আগে প্রেম করে বেড়িয়েছে মেয়েদের সাথে কি করতি শুনি?   আনান ভাইয়া কি একাধিক মেয়ের সাথে প্রেম করেছেন বিয়ের সাথে?   প্রেম একটা করা যা দশটা করাও তাই। তুই আমার প্রশ্নের জবাব দে আগে।   প্রেম একটা করা যা দশটা করাও তাই? ইলমা আনান ভাইয়ার অতীত জানার পর কষ্ট পাওয়া কিংবা রাগ করাটাকে যদি সঠিক বলিও। তোর এমন মন্তব্য করাটাকে কি ঠিক বলা যাবে? নয় মাস ধরে একজন মানুষের সাথে তুই সংসার করছিস। যে মানুষটার প্রশংসা শোনাতে শোনাতে তুই আমাদের কান ব্যথা করে দিতি। সেই মানুষটার একটি নেতিবাচক অতীতের কথা জানা মাত্রই তুই যে কথাবার্তা, কর্মকান্ড করছিস এটা কি ঠিক হচ্ছে? বিয়ের আগে স্বামীর অন্য কোন মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল এটা কোন স্ত্রীর জন্যই আনন্দের সংবাদ হতে পারে না। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী মধ্যে যদি খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে বর্তমানে। সেক্ষেত্রে এমন সংবাদ এতটা বড় আকার ধারণ করারও সুযোগ রাখে না, যতটা বড় তুই করেছিস।   একটা মেয়ে হয়ে তুই এভাবে বলতে পারছিস? স্বামীর অতীত প্রেম কোন বড় বিষয় না?   বর্তমানে স্বামী যদি সম্পর্কের ব্যাপারে অনেষ্ট থাকে তাহলে অতীত প্রেম অবশ্যই বড় কোন বিষয় না। তুই ভেবে দেখ আনান ভাইয়া কি স্বামী হিসেবে অসাধারণ একজন মানুষ নন? শুধুমাত্র একটা নেতিবাচক অতীত আছে বলে কি এই ভালো মানুষটিকে এভাবে অপমানিত করা ঠিক হচ্ছে তোর? উনি তো তোকে ইচ্ছে করে অতীত জানাননি। তুই গোয়েন্দাগিরি করে জেনেছিস। যে জিনিস হজম করার ক্ষমতা তোর নেই সেই জিনিস জানতে কেন গিয়েছিলি? তোর মনে যখন সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল তখনই আমি সাবধান করে বলেছিলাম জীবনের কিছু অংশের উপর থেকে কখনোই পর্দা সরানো উচিত না। মনের কিছু কথা কখনোই শুনতে যাওয়া ঠিক না। কিন্তু তুই আমার কথা শুনিসনি।   নূরির কথার কোন জবাব দিলো না ইলমা। মনের আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণে যে উত্তপ্ত লাভার স্রোত নেমেছিল কিছুটা কমেছে সেই ধারা। আনানের পুরোনো ডায়েরি পড়ে মনে যখন সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। প্রথমে নূরিকে এসেই জানিয়েছিল সেই কথা। নূরি বার বার তাকে মানা করেছিল অতীত ঘাঁটাঘাঁটি করতে। কিন্তু সত্য জানার অদম্য ইচ্ছার কাছে ভেসে গিয়েছিল নূরির পরামর্শ। ধীরে ধীরে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ইলমা। মেঘ শূন্য আকাশের পানে তাকিয়ে আবারো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো তার আখিদ্বয়।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)