সাহিত্য

কনক এখন বড় আপু

কনক এখন বড় আপু
muslim family ছোটমামা শেষ যেবার দেশে এসেছিলেন সেবার কনককে একটা সুন্দর ডায়েরি গিফট করেছিলেন। এটা কনকের বিশেষ প্রিয় জিনিস। কনক মাঝে মাঝে এখানে লিখে। যেমন: একদিন লিখেছে, “আমার মনে অনেক দুঃখ তাই আমি কোনো বনে হারিয়ে যেতে চাই।” তোমরা ভাবতেই পারো কনক বুঝি পরীক্ষায় লাড্ডু গুড্ডু পেয়েছে কিংবা ওর খুব অসুখ হয়েছে কিংবা কনকের প্রিয়বন্ধু- ওই যে মেয়েটা? নাম বোধহয় সায়েমা, ওর সাথে আড়ি নিয়েছে কিংবা… আসলে ঘটনাটা সেসব কিছুই না! যদি জানতে চাও, তাহলে বলি। এক রাতের কথা। ক্রিইইইং ক্রিইইং… কলিংবেল বাজছে। দেড় বছরের ছোট্ট কায়সার ছুটে গেলো থপ থপ করে, “বাবাত্তে বাবাত্তে” বাবা হাতের ব্যাগটা রেখে কায়সারকে কোলে তুলে নিলেন, কায়সারকে আদর করতে করতে কনককে বললেন, “কনক, ব্যাগটা নিয়ে আসো তো!” কনকও হোমওয়ার্ক করা ফেলে এসেছিলো, বাবার আজকে নতুন রঙ-পেন্সিল-বক্স আনার কথা ছিলো, এনেছে কী না দেখতে। ব্যাগ হাতে নিয়ে বাবার পেছনে পেছনে যেতে কনক জিজ্ঞেস করলো, “বাবা রঙ-পেন্সিলের বক্স এনেছো?” -স্যরি কনক, আমি একদম ভুলে গেছি! আসলে আজকে কায়সারের জন্য অনেককিছু কিনতে হয়েছে তো। রঙ-পেন্সিলের কথা খেয়াল ছিলো না। কনকের চোখ ছলছল করে উঠলো। কত্ত আশা করে বসে আছে সে, কালকে ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় নতুন রঙ পেন্সিল বক্স নিয়ে যাবে। -কেন, বাবা কেন? আমারটা ভুলে যাও, ওরটা তো ভুলে যাও নি। আগে শুধু আমাকে আদর করতে এখন করো কায়সারকে। আগে আমার জন্য জিনিস আনতে এখন আনো কায়সারের জন্য! আগে আমাকেই ভালোবাসতে, এখন কায়সারকে ভালোবাসো। আমি তো তোমাদের কেউ না, বাবা? এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে কনক প্রায় কেঁদেই দিলো! বাবা, মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বাবার কোলে বসে বসে কায়সার বললো, “কলোক কাঁতে, মামমাম! কলোক কাঁতে।” কনক আর সহ্য করতে না পেরে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেলো। জামার হাতা দিয়ে চোখের পানি মুছলো। বাবা বা মা কেউ-ই যেহেতু ওর দুঃখ বুঝবে না তাই ডায়েরি খুলে লিখতে বসলো। যেই বনে হারিয়ে যাওয়ার কথাটা লিখেছে অমনি দরজা ঠেলে কেউ আসছে বোঝা গেলো। তাই চট করে ডায়েরিটা বন্ধ করে হোমওয়ার্ক খাতা খুললো। সে ভেবে রেখেছে ওরা যা-ই বলুক না কেন কনক বলবে, “আমাকে এখন ডিস্টার্ব কোরো না তো, হোমওয়ার্ক করছি।” যারা ওকে ভালোই বাসে না তাদের সাথে আর কথা কী! -কনকমণি… আমার কনক’মা… আব্বু কনকের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন। ও তাকালোই না! -কুনুকু আমার ঝুনুকু, মা পাশে বসলেন। কনক তা-ও তাকালো না। বাবা হঠাৎ বললো, “আরে! আরে! রুকু, দেখো তো ঝড়-টর আসবে কী না, এত মেঘ জমেছে!” শীতকালে না কি ঝড় আসবে! কোথায় মেঘ! বড়রা মাঝে মাঝে এত বোকার মত কথা বলে! কেউ ভুল কথা বললে কনক চুপ থাকতে পারে না। হোমওয়ার্ক করতে করতেই ওকে তা-ই বলতে হলো, “শীতকালে বাংলাদেশে বৃষ্টিই কম হয়, ঝড় হয় না। বাইরে মেঘের মত ওটা হচ্ছে কুয়াশা। ঝড় আসবে না এখন।” বাবা-মা মুচকি হাসলেন। দেখাদেখি কায়সারও দাঁত বের করে হাসলো। -আরে আমি কী বাইরের মেঘের কথা বলেছি। আমাদের এই ঘরেই একজনের মুখে মেঘ জমেছে। সে হপ করে বসে আছে। ঘরেও যেকোন সময় ঝড় আসতে পারে। কনক তখনো হোমওয়ার্ক করে যাচ্ছে, গম্ভীর মুখে বললো, “ও আচ্ছা।” -“কনক এবার আমার দিকে তাকাও! তাকাও মা!” আম্মু বললো। “রাগ হয়েছে খুব, বুঝতে পারছি। রাগ হওয়ারই তো কথা। তোমার বাবার একদম উচিত হয় নি ভুলে যাওয়া।” -আমি স্যরি কনকমণি! বাবা কনকের কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, “একটু হাসো মা!” কনক একটু হাসার চেষ্টা করলো। বললো, -কিন্তু তোমরা কেন এখন আমাকে কম ভালোবাসো, বলো? কেন কায়সারকে বেশি ভালোবাসো? -“ছিঃ কনক! কে বলেছে আমরা তোমাকে কম ভালোবাসি?! আমরা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।” আম্মু কনকে জড়িয়ে ধরলো। কায়সারও আম্মুর দেখাদেখি কনককে জড়িয়ে ধরলো। “দেখেছো কায়সারও তোমাকে কত ভালোবাসে!” -কনক, তুমি জানো না? রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যে বড়দের সম্মান করে না আর ছোটদের স্নেহ করে না সে আমাদের দলভূক্ত নয়”, তুমি ভালোবাসো না কায়সারকে? - ভালোবাসতামই তো! -আমিও জানি তুমি এখনো কায়সারকে অনেক ভালোবাসো। তাহলে? একটু ভাবো তো কনক’মা, আগে শুধু তুমি একা ছিলে এখন তোমরা দুজন হয়েছো। আগে তুমি ছোট্ট বাবু ছিলে, এখন তোমার বয়েস সাড়ে সাত হয়েছে। তুমি এখন অনেক কাজ নিজে নিজে করতে পারো। যেটা কায়সার পারে না, তাই না? সেজন্য আগে হয়তো আম্মু তোমাকে খাইয়ে দিতাম, এখন কায়সারকে খাইয়ে দি-ই আর তুমি নিজে নিজে খাও। আগে তোমাকে জামা পরিয়ে দিতাম, গোসল করিয়ে দিতাম। এখন এগুলো তুমি করো। আর কায়সারকে আম্মু করিয়ে দি-ই। কেন বলো তো? -কারণ, বড় হওয়ার সাথে সাথে মানুষকে অনেক কাজ নিজে নিজে করতে হতে হয়, অনেক কিছু শিখতে হয়। -ঠিক বলেছো মা! তারমানে কি আম্মু এখন তোমাকে কম ভালোবাসি? ভাবো তো মা? আসলে, আম্মু তো তোমাকে সবসময়ই খুব ভালোবাসি, যেমন তোমার আব্বু তোমাকে ভালোবাসে। কায়সারের প্রতি একটু বেশি খেয়াল রাখতে হয়, কারণ ও যে একদম ছোট্ট! অনেকসময়, তা-ই তোমার যত্ন নিতে একটু একটু ভুল হয়ে যায় আব্বু আম্মুর। বুঝেছো? আচ্ছা, বারান্দায় তোমার কতগুলো গাছ আছে না? সেগুলোর মধ্যে তুমি সবচেয়ে বেশি যত্ন নাও চারাগাছ গুলোর। তাই বলে কি বড় গাছগুলোকে তুমি কম ভালোবাসো? কনক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, -আমি স্যরি আম্মু রাগ করার জন্য। আমি বুঝেছি। গাছের বাচ্চার মতো মানুষের বাচ্চারও বেশি যত্ন নিতে হয়। আমি আর কখনো তোমাদের উপর রাগ করবো না । বাবা বললো, “মাশা আল্লাহ! আর কনক তুমি আগে ছিলে শুধু একটা বাচ্চা। আর এখন তুমি কিন্তু একজনের বড় আপু। ছোট্ট শিশুরা বড়দের কাছ থেকেই সব শিখে। বাসার সব বড়দের কাজ হলো ছোট শিশুদের ভালো মানুষ করে গড়ে তোলা। বড়দের অনেক দায়িত্ব, তাই না? আব্বু আম্মুর পাশাপাশি তোমাকেও তাই কায়সারকে বড় করে তুলতে হবে।” -জ্বি বাবা, আমি বুঝেছি। আমরা সবাই মিলে কায়সারকে বড় করবো। -আচ্ছা, এখন আমরা যাই। তুমি হোমওয়ার্ক শেষ করো। ওরা চলে যাওয়ার পর কনক ডায়েরিতে লিখলো, “আমি কায়সারের বড় আপু। আমাকে দেখতে হবে কায়সার ভালো মানুষ হচ্ছে কী না, কায়সার সুন্দরভাবে বড় হচ্ছে কী না। আমি কায়সারকে খুব ভালোবাসি, কায়সারও আমাকে ভালোবাসে।” কখন যেন কায়সার এঘরে ফিরে এসেছে, “কলোক সুনো কলোক সুনো…” কায়সার সব কথা দু’বার বলে। কনক হেসে কায়সারকে কোলে নিলো। কনক তো এখন জেনে গেছে বড় আপু হওয়া কত বড় দায়িত্বের ব্যাপার! সে কি দায়িত্বে অবহেলা করতে পারে, বলো তো? [এটা একটা শিশুতোষ গল্প। সাত + বয়েসী শিশুদের জন্য লেখা] Capture

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)