বিবিধ

মেরামত, পুনঃব্যবহার ও লেন্ডিং সেন্টার

মেরামত, পুনঃব্যবহার ও লেন্ডিং সেন্টার

মার্কিন মুল্লুকে কিছু রিপেয়ার করানো ব্যয়বহুল একটা কাজ। সেদিন আমার ফোনের চার্জিং পোর্ট রিপ্লেস করাতে খরচ নিলো ৯০ ডলার। অর্থাৎ প্রায় আট হাজার টাকা। বাজেট আরেকটু বাড়ালে আমি নতুন একটা ফোনই কিনে ফেলতে পারতাম। ফোন মেমোরিতে পারিবারিক স্মৃতিবিজড়িত ছবিগুলো না থাকলে হয়তো তাই করতাম। অথচ এই চার্জিং পোর্ট ঠিক করার স্কিলটা আমার নিজের থাকলে খরচ পড়তো কেবল ২৫ ডলার, শুধু পার্টসের দাম।

 
আমাদের বাসার (দেশে) ন্যাশনাল কোম্পানির ফ্রিজ প্রায় সাতাশ বছর ধরে প্রায় বিনা উপদ্রবে আমাদের বাসায় খাবার দাবার ঠান্ডা করার সার্ভিস দিয়ে আসছেন। অথচ এখনকার উন্নততর প্রযুক্তিতে বানানো ফ্রিজগুলো কয়েকবছরের মাঝেই ঝামেলা শুরু করে। অসাধু কলমিস্ত্রি যেমন ইচ্ছা করেই কিছু ডিফেক্ট রেখে যায়, যেন বার বার তাকে ডাকার দরকার পড়ে, এইটাই বড় লেভেলে করছে বড় কোম্পানিগুলো। প্রতিবছর ফিচার আপডেট করে যেমন মানুষকে নতুন ফোন সেট কিনতে প্রলুব্ধ করছে ফোন কোম্পানিগুলো, যেন নতুন এই ফিচারটি না হলেই নয়!
 
এইদেশে একবার আমাদের ফ্রিজ থেকে থেকে শব্দ করছিলো বলে ম্যানেজমেন্টকে কল করেছিলাম। ওরা পরেরদিন নতুন ফ্রিজ নিয়ে হাজির। পুরানটা নাকি বাদ। বলে রাখা ভালো এইখানে ফ্রিজ, চুলো, এসি, ফ্যান এগুলো সাধারণত ল্যান্ডলর্ড প্রোভাইড করেন, আর ফার্নিশড বাসা হলে অন্যান্য আসবাবও। তখন আমি সবে এইদেশে এসেছি, এরা সামান্য রিপেয়ার না করে আস্ত ফ্রিজটাই বাতিল করে নতুন ফ্রিজ কিনে পাঠালো কেন অবাক হচ্ছিলাম।
 
 
পরে বুঝলাম রিপেয়ারিংয়ের লেবার ও পার্টসের খরচ যত পড়বে তার চেয়ে কিস্তিতে আরেকটা কিনে ফেলা বা ইনস্যুরেন্স করা থাকলে নতুন একটা ক্লেইম করা সহজ পদ্ধতি। এভাবে সত্যিকার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চাহিদা তৈরি হয়েছে, ফলশ্রুতিতে অতিরিক্ত  উৎপাদন হচ্ছে, পুঁজিপতির পকেট ভরছে, আপনার আমার পকেট থেকে পয়সা যাচ্ছে। কার্বন এমিশন বাড়ছে, ধরিত্রী ঊষ্ণ হচ্ছে। 
 
 
বাংলাদেশে মেকানিক ও শ্রমিকের মজুরী কম হওয়াতে এখনো মেরামত জনপ্রিয়। এটা অবশ্যই ভালো দিক। মেরামত শ্রমিকের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। নিজেও কিছু টেকনিক্যাল স্কিল শিখে রাখা যায়।
 
এখন আমরা থাকি একটা ইউনিভার্সিটির মালিকানাধীন হাউজিংয়ে। এখানে এসে কিছুদিন পর আমি খুব সুন্দর একটা আইডিয়ার সন্ধান পেলাম। সেটা হলো 'লেন্ডিং সেন্টার'। এটা কিছু ভলান্টিয়ার দাদুনানু চালায়। আইডিয়াটা সিম্পল, এই হাউজিং কমপ্লেক্স থেকে চলে যাওয়ার সময় মানুষ তাদের গৃহস্থালি নানা জিনিস (রান্নাঘরের জিনিস, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, কম্বল বালিশ পর্দা, খেলনা ইত্যাদি)  ধুয়ে মুছে এখানে ডোনেট করে যাবে । বর্তমান বাসিন্দারা লেন্ডিং সেন্টার থেকে সেগুলো ধার নিয়ে ব্যবহার করতে থাকবে। আবার তারা চলে যাওয়ার সময় এগুলো ফেরত দিয়ে যাবে। আবার নতুন কেউ ধার নিবে এভাবে একই জিনিস বারবার ব্যবহার হতে থাকবে। বর্তমান শহরে আসার পর আমি ঘরের কিছু দরকারি জিনিস লেন্ডিং সেন্টার থেকে ধার করে এনেছি। আবার আমার বাসার অতিরিক্ত জিনিস ওখানে ডোনেট করে এসেছি। গৃহস্থালি অধিকাংশ জিনিস এখানে ধার পাওয়া যায়। সব দরকারী জিনিস একই দিনে একই সাথে পাবেন এমন ভরসা নাই। আপনাকে বারবার গিয়ে যেদিন যেগুলো থাকবে তার মধ্য থেকে বেছে আনতে হবে। কোনো কারণে কিছু নষ্ট হলেও কোনো পেনাল্টি নাই, সাধারণত কেউ ইচ্ছা নষ্ট করেও না। অন্য অনেকে এসেও জিনিস ডোনেট করে যায়। বলা বাহুল্য, এখানকার বাসিন্দাদের প্রচুর ডলার সেইভ হচ্ছে এভাবে।
 
 
এধরণের শেয়ারিং ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মানবকল্যানমূলক। লাভজনক খাতে এর উদাহরণ এয়ারবিএনবি, উবার, পাঠাও ইত্যাদি। অলাভজনক খাতে উদাহরণ- গুডউইল, সালভেশন আর্মির থ্রিফট শপ, MSUর লেন্ডিং সেন্টার ইত্যাদি।
 
দেশেও যেসমস্ত জায়গায় মানুষ স্বল্পমেয়াদে থাকে (যেমন ছাত্রছাত্রীদের মেস) সেসব হাউজিং গুলো নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক করে লেন্ডিং সেন্টার চালু করতে পারে।
 
 
আমি কিছুর দরকার হলে প্রথমেই থ্রিফট শপগুলোতে খুঁজি। বা ফেসবুকের মার্কেটপ্লেসে খুঁজি। এসবজায়গায় না পেলে অন্যখানে দেখি। আমার সংসার হওয়ার পর হাতেগোনা অল্পকিছু নতুন জিনিস কিনেছি (খাবার, ক্লিনিং সাপ্লাই ইত্যাদি বাদে) । বাংলাদেশে সেকেন্ড হ্যান্ড শপ আছে অনেক, কিন্তু থ্রিফট শপ ধারণাকে জনপ্রিয় করার স্কোপ আছে বলে মনে করি, বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতাগুলো মাথায় রেখে অবশ্যই।
 
ছবি: একটি সেকেন্ডহ্যান্ড শপ/ থ্রিফট শপ
 
থ্রিফট শপে লোকে তাদের অতিরিক্ত ও ব্যবহার্য জিনিস দান করে। এদেশে পরিবহন ব্যয় বেশি হওয়ায় বেশি জিনিস নিয়ে মুভ করা কষ্টকর তাছাড়া ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময় ডোনেট করতে উৎসাহিত করে। কাপড়, গৃহস্থালি সব জিনিস, বই, ঘর সাজানোর উপকরণ, বাচ্চাদের খেলনা- মোটকথা খাবার ছাড়া একটা ঘরে যা লাগে প্রায় সবই পাওয়া যায়।  এখানকার সব আইটেম লোকের দান করা।  ভালো করে ক্লিন করে কর্মচারীরা এগুলো সাজিয়ে রাখে। বিক্রির আয় থেকে যাবতীয় খরচ মেটানো হয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ডোনেটও করা হয়। এখানে প্রচুর ভলান্টিয়ারও কাজ করেন। খুব অল্প মূল্যে পাওয়া যায় বলে লোয়ার ইনকাম সার্কেলে ও মিতব্যয়ী মানুষের কাছে জনপ্রিয়।
 
 
বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই দান করার ব্যবস্থা আছে (যেমনঃ ব্যবহার করা কাপড় গ্রামে দরিদ্রদের পাঠানো) তাছাড়া বড় ভাইবোনের কাপড় অনেকসময় ছোটরা পরে এভাবে রিইউজ করা হয়। বাঙলাদেশী গৃহিনীদের রিসাইকেল করার মেধা দারুণ। আমাদের গৃহিনীরা পুরোনো জিন্সের প্যান্ট কেটে গরম পাতিল ধরার লুছনি/নেকড়া বানাতেন, বিস্কুটের কৌটায় ডাল রাখতেন, অব্যবহৃত শাড়ি কেটে বাচ্চাদের নিমা/ ঘরের পর্দা, পুরোনো গেঞ্জি দিয়ে ঘর মুছার নেকড়া বানাতেন, স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেলে ফিতা কিনে জোড়া দিয়ে লাগাতেন ইত্যাদি নানা ভাবে পুরোনো জিনিসকে নতুন রূপে ব্যবহার করতেন। অধুনা ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়া বা আয় বাড়া যাই হোক না কেন, অনেক পরিবারেই এমন পুনঃব্যবহার কমে গেছে
 
স্বল্পআয়ের মানুষজন সাধারণত জিনিসপত্রের উপযোগিতা শেষ করে তবেই বাতিল করে। দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত বিশাল জনগোষ্ঠী কারো থেকে চেয়ে দান নিতে পারে না। উচ্চবিত্তদের ডোনেশনের ভিত্তিতে সাসটেইনেবল থ্রিফট শপ চালু করা গেলে এরা খুবই উপকার পাবে।
 
 
মেরামত, পুনঃব্যবহার ও লেন্ডিং সেন্টার -এগুলোকে কেন উৎসাহিত করবেন-
 
 
[১] পয়সা বাঁচানোর জন্য, ও বেঁচে যাওয়া পয়সা কল্যাণমূলক খাতে ব্যয় করার জন্য।
[২] আপনার কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর জন্য, পরিবেশের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা থেকে।
[৩] সামাজিক দায়িত্ব থেকে
[৪] মিনিমালিস্ট জীবন যাপন করার জন্য
[৫] পুঁজিবাদ প্রভাবিত ভোগবাদী সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য
[৬] একটা বস্তুর পরিপূর্ণ উপযোগিতা খরচ করার জন্য
 
কোনো কিছু মেরামত করে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা, সেকেন্ড হ্যান্ড শপ থেকে জিনিস কেনা, লেন্ডিং সেন্টার থেকে ধার নেয়া এগুলো কোনোটাই লজ্জার কাজ নয়। বরং নতুন উৎপাদনকে ত্বরান্বিত না করে পরিবেশের উপর এহসান করছেন ভেবে গর্বিত ও আনন্দিত হতে পারেন। 
 
 

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ