
ছেলে তার বউকে রেখে কাজে গেছে, ওদিকে শ্বশুর একা পেয়ে ছেলের বউয়ের সতীত্ব নষ্ট করেছে জোরপূর্বক! এই যে সতীত্ব নষ্ট এই বাক্যটি অবচেতন মনেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই বলেই ফেলেন!সেদিন একজন ছেলে মানুষের লেখা এমন একটি লেখা পড়লাম । তিনি একটি ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। তারমানে দাড়ায় মেয়েটি অসতী হয়ে গেছে, তার যাবতীয় ভালো কাজগুলো, চারিত্রিক মাধুর্য একজন বুড়া যে কিনা শ্বশুর তার জোর পূর্বক ধ...ে এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে। সে পরিণত হয়েছে অসতীতে! আর শ্বশুর, যে কিনা এমন গর্হিত কাজ করেছে তার একটা চুল বাঁকা হওয়ার মতো অপবাদ ও গায়ে লাগলো না! সতী অসতী তো অনেক দূরের বিষয়। সতী একটি নিত্য স্ত্রী বাচক শব্দ। অর্থাৎ পুরুষদের জন্য এই শব্দটির কোন ভিত্তি নেই। শুধু ব্যাকরণ বা ভাষাগত দিক বাদ দিলেও এই শব্দটি যেমন শব্দগত দিক দিয়ে অর্থ বহন করে, ঠিক তেমনি সমাজে নারীর প্রতি হওয়া অনেক আচরণের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়। শুধু তাই নয়। বাংলা সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যে বিভিন্ন সময় নায়িকা বা নায়কের বউকে ধ...ের শিকার হতে দেখা যায়। এরপর ঘরে ফেরার পরে তার আর সে ঘরে যায়গা হয়না। তাকে ছুড়ে ফেলা হয় ডাস্টবিনে, ঠিক যেন একটা ময়লা ছেড়া কাপড়, যার গায়ে এমন অপবিত্র কিছুই লেগেছে যে তাকে আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না কিছুতেই। আমার মনে হয়, কাপড়ের অবস্থা ও এমন মেয়েদের চেয়ে অনেক ভালো। কারন, কাপড়ে কোন ময়লা লাগলে, কিংবা কোন ধারালো কিছুর আঘাতে ছিঁড়ে গেলে সেই কাপড়কে ধুয়ে কিংবা সেলাই করেও পড়া হয়, ঠিক ততদিন, যতদিন তার ব্যবহার পূর্ণমাত্রায় শেষ না হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কথিত অসতী মেয়েদের অবস্থা এই কাপড়ের চেয়েও করুণ। আমরা জানি, মানুষ মারা গেলে মুসলিম হলে তার দেহকে দাফন করা হয়, হিন্দু হলে চিতায় জ্বালানো হয়। কবরে হাড় মাংস সব এক হয়ে যায়, আর চিতার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় মানুষের সাধের দেহ। তাহলে, সতী অসতী কিংবা মানুষের ভালো মন্দ কাজগুলো কোথায় যায়? আসলে মানুষের সব কাজ ধারন করে রাখে মহাকাল। রবি ঠাকুর তাই হয়তো সোনার তরী কবিতাটি লিখেছিলেন। তাহলে , সতী অসতী এই ধারণা কেন শুধু নারী দেহের সাথেই সম্পর্কিত হবে, যেখানে নারী দেহ নিয়ে খেলা করে পুরুষই , ইচ্ছায় অনিচ্ছায় বিবাহিত অবিবাহিত ইত্যাদি বিভাজনে! আসলে , সতীত্ব বলতে বোঝায় বিবাহপূর্ব শারীরিক পবিত্রতা।কিন্তু আমাদের দেশে সতীত্বের আরও অনেক ব্যাখ্যা আছে। এখানে একবার তালাক প্রাপ্তা নারীকেও অনেকে সতী বলে স্বীকার যেতে নারাজ। কেননা, তার শরীরে সমাজসম্মত ভাবেই পূর্বে আরেকজন পুরুষ বিচরণ করেছে, কিংবা ধর্মীয় বিধি মেনেই। এরপর কোন এক ভাগ্য দোষে তালাক হলে, সেই নারী আর ধর্ষিতা নারীর সামাজিক মূল্যায়নে তেমন কোন পার্থক্য দেখা যায় না। একবার যে নারীকে সে নারীকে অন্য পুরুষ ছুঁয়েছে জেনে পুরুষ সমাজের গাল ঝুলে যায়। অসতী অসতী রব উঠে। অথচ, এই দেহই যে মুখ্য নয়, দেহের ভেতরে যে রয়েছে একটি আত্মা, যার মন হয়তো সংসারের ছায়া হারানোর ব্যাথায় ব্যাকুল, নতুন ছায়াকে আপন করে নিতে প্রস্তুত, সেই নারী বা তার মানসিকতার কোন দাম নেই আমাদের কাছে। ঠিক যেন এই নারী মানুষ নয়, ওয়াননটাইম ইউজ কোন টিস্যু , যা একবার ব্যবহার হয়েছে বলেই ছুড়ে ফেলা যায়! এখানে মন নয় , টিস্যুর মতো শরীরে শুস্কতার দামই যেন বেশী। অনেক সময় আমরা বলি, ধর্মে নারীকে এমন টিস্যুর সাথেই তুলনা করা হয়েছে। পকেটের টাকা দিয়ে কিনো, এরপর তাকে ব্যবহারের সর্বচ্চ চেষ্টা করো, এবং ভালো না লাগলে ফেলে দাও! ধর্ম , বিশেষ করে যা জীবন ব্যবস্থার চালিকা শক্তি, একটা বিশেষ শ্রেণীর প্রতি শুধুমাত্র সৃষ্টিগত পার্থক্যের কারনে এতো বড় গুরু দণ্ড দিবে ভাবতে অবাক লাগে না? রোড টু মক্কা মুহাম্মদ আসাদের বিখ্যাত গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তার সর্বক্ষনিক সঙ্গী জায়েদ। যে বহু আরব গোত্রে পূর্ণ মোহর দিয়ে বিয়ে করেছে একটার পর একটা আবার ছেড়ে ও দিয়েছে। কিন্তু সেইসব মেয়েদের সমাজে অচ্ছুত ঘোষণা করা হয়েছে , বা জায়েদের কারনে বিশাল দুঃখে পতিত হয়েছে নারীরা এমন কিছু লেখকের লেখায় পাইনি। এমন কিছু হয়ে থাকলে একটা হালকা আভাস হয়তো থাকতো লেখায়। কারন কি? কারন আরবরা আসলে এই ব্যাপারটিকে খুব বড় করে দেখেনা। ওদের কাছে একজন নারী একজন মা, একজন মেয়ে একজন স্ত্রী রুপে সম্মানিত। এবং একটা তালাকের পরে অনেকে সাচ্ছন্দে সেই নারীকে বিয়ে করে নেয়। এবং এটাই নারীর প্রকৃত মর্যাদা। যেটা শুধু শরীরের কৌমার্য মাপে না, মাপে মানসিকতা আর মর্যাদা ও । সমাজে সতী বা সতীত্ব নামক এই কথিত শব্দের শিকার হয় সাধারণত তিন ধরণের নারী। ১- ধর্ষিতা ২- তালাকপ্রাপ্তা ৩- বিধবা কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে নারী হর হামেশা শরীর প্রদর্শন করে বেড়াচ্ছে, সারাক্ষণ মনে কুচিন্তা নিয়ে ঘুরছে, এবং যার চারিত্রিক ব্যাপারগুলো হয়তো সমাজের দাপটে এভাবে কখনোই প্রশ্নবিদ্ধ হয়না, যার আত্মাই হয়তো অসৎ আর অসততার বাড়িঘর, তাকে কি কোন সতীত্বের সংজ্ঞা আটকে রাখতে পারে খারাপ কাজ থেকে? আর যেসব মেয়েরা সমাজের নিয়মে বা সমাজের অসঙ্গতিতে পুরুষের ভোগ্য হয় , হয়তো বিয়ে হয়েই, সে তো বিয়ের পরে আর সতী থাকছে না কথিত এই সংজ্ঞায়। তাহলে কি বলবো সতীত্ব নারীর চরিত্রকে হীন রুপে সংজ্ঞায়িত আর বর্ণিত করার এক সনাতন উপায়?
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)