পরিবার ও আমি (বিয়ে ,দাম্পত্য,শিশু লালন পালন )

স্বামীর দোষে স্ত্রী দোষী; স্ত্রীর দোষে কে দোষী?

স্বামীর দোষে স্ত্রী দোষী; স্ত্রীর দোষে কে দোষী?
শারমিন আকতারঃ স্বামীর দোষে স্ত্রী দোষী কোন পরিবারে একটা ছেলে যদি বিয়ের পর তথা স্বামী হিসাবে নিজের নাম লেখানোর পর বাবা-মার কাছে ভাল ছেলে না হতে পারে, বসের কাছে একজন ভাল ইমপ্লয়ি না হতে পারে তবে তার সমস্ত দায়ভার গিয়ে পড়ে স্ত্রীর উপর । স্ত্রীর কারণে উচ্ছন্নে গেছে ছেলেটা ।বিয়ের পরই ছেলেটা একদম পরিবর্তন হয়ে গেছে । বাবা-মার খোঁজ খবর রাখেনা! ক্যারিয়ার ভালভাবে ডেভেলোপ করতে পারছে না !  ভালভাবে উঠে দাড়াতেই পারছে না ছেলেটা । এবার কোন এক পরিবারের কোন এক ছেলের বিয়ের আগের জীবনে একবার ফিরে আসা যাক । ধরুন এক পরিবারে এক ছেলে এবং এক মেয়ে । এদের দু’জুনই বাইরে পড়ালেখা করে । ধরা যাক দুজনেই দুইটা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ।এখন এই দুই ছেলে-মেয়ের মধ্যে বাসায় বাবা-মার খোঁজ খবর কে বেশী রাখে? ছেলে না মেয়ে? বাবা-মার সাথে কথা বলে মোবাইলে কে বেশী সময় কাঁটায়? ছেলে না মেয়ে?ছুটির ফাঁকে বাসায় এসে বাবা-মার সাথে কে বেশী সময় কাঁটায়? মাসের টাকা বাঁচিয়ে বাবা-মা, আত্মীয় স্বজনের জন্য যে ছোট- খাটো উপহার নিয়ে আসে? সবাই এক শব্দে নিশ্চয়ই উত্তর দিবেন মেয়ে? তাহলে উত্তর যদি মেয়ে হয় বিয়ের পর বাবা-মার সেই ছেলেই যদি খোঁজ- খবর বেশী না রাখে, তাহলে তার দায়ভার কেন তার স্ত্রীর । তবে হা স্ত্রীর যে এ ব্যাপারে একেবারে প্রভাব  থাকে না তা অস্বীকার করব না। সে তার স্বামীর কাছ থেকে নিজের বাবা-মার জন্য সেরকম শ্রদ্ধাবোধ না পাওয়ায় হয়তো কিছুটা নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ দেখাতে পারে । এটা অস্বাভাবিক কিছু না ।কারণ সেও তো দোষে-গুনে ভরা মানুষ । কোন ফেরেশতা বা দেবতা না । তারও তো ভুল-ভ্রান্তি থাকে, তার মধ্যেও মাঝে মাঝে প্রতিশোধপরায়ণতা কাজ করে! তাই বলে স্বামীর বাবা-মার সাথে খারাপ আচরণের দায়ভার স্ত্রীর উপর বর্তায় না ।এর দায়ভার একান্ত স্বামীর ।স্ত্রীর বাবা-মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পাশাপাশি নিজের বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করা উচিৎ নিজের দায়িত্বে স্ত্রীর কথায় নয় । কোনটা নিজেদের দায়িত্ব সেটা কি ছেলেরা বুঝে না ? পরিবারের ডিসিশন ম্যাকিং বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তো বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারে স্ত্রীদের ততো পাত্তা দেয়া হয় না; তাহলে বাবা-মার সাথে খারাপ আচরণের ব্যাপারে যদি স্ত্রীর সম্মতি থেকেই থাকে তাতেই উঠে কীর্তন নাঁচ শুরু করে দিতে হবে ? হায়রে পুরুষ জাতি ! যদি স্ত্রীর কারণে বাবা-মার সাথে ছেলেদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েও থাকে তবে সেটা কেন হবে ? যে বাবা-মা তাকে এতো কষ্ট করে মানুষ করলো । তাদেরকে ভুলতে বসেছে  কয় দিন আগে বিয়ে করা স্ত্রীর কথায়! কেন এমনটা হবে ? স্বামী কি স্ত্রীকে তার নিজের বাবা-মাকে ভুলাতে পেরেছে? স্ত্রীর হৃদয় থেকে কি স্বামী নিশ্চিহ্ন করে দিতে পেরেছে তার বাবা-মার অস্তিত্ব? বছরের পর বছর বাবা-মার সাথে দেখা করার সুযোগ না হলেও তাদেরকে দেবতার আসনে বসিয়ে রাখে মেয়েরা ।আর ছেলেরা নিজের বাবা-মাকে কাছে পেয়েও তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করে না, বাবা-মার প্রতি তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করে না ।আর এর দায়ভার এসে পড়ে স্ত্রীর উপর! অথচ কোরআনে আছে- “ প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে ?” তাহলে স্বামীর দোষে কেন স্ত্রী দায়ী হবে ? ছেলেদের থেকে সেরকম সমাদর না পাওয়া মেয়ে সন্তানহীন এক বাবা নিজের বেদনা থেকে বলেছিলেন- “পৃথিবীতে যেন এমন কোন বাবা না থাকে যার মেয়ে সন্তান নেই ।” স্ত্রীর দোষে কে দোষী? সমাজে অহরহ স্বামীর দোষ এবং অসফলতার দায়ভার স্ত্রীর উপর বর্তালেও স্ত্রীর দোষের এবং অসফলতার দায়ভার কিন্তু কারও উপর বর্তায় না । সেটা স্ত্রীকে একা নিরবে বুকে দহন জ্বালা নিয়ে বয়ে বেড়াতে হয় । যে মেয়েটি বিয়ের আগে সবার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল মেয়ে হিসাবে থাকে বিয়ের পর কিন্তু সেই মেয়েটিকেই শশুর বাড়ীতে সবচেয়ে খারাপ বলতেও কেউ কেউ দ্বিধা করেন না । সত্যিই কি মেয়েটা এতো খারাপ? তাহেল সেই খারাপভাবটা বিয়ের আগে ১৮-২৫ বছর ধরে  কেন  একবারও প্রকাশ পেল না ?যদি সত্যিই সে খারাপ হয়ে থাকে তাহলে সেটা তো এতোদিনে একবার হলেও প্রকাশ হওয়ার কথা ।সত্য তো এতদিন লুকিয়ে থাকে না । আর যদি খারাপ নাই হয়ে থাকে বিয়ের আগে তাহলে বিয়ের পর কয়েক দিনের মাথায় সে এতো পরিবর্তন হয়ে গেল? কিভাবে? অথচ হাদিসে আছে রাসুল সাঃ বলেছেন- “কেউ যদি আমাকে বলে তুর পাহাড় একদিনে ধ্বংস হয়ে গেছে তাহলে আমি বিশ্বাস করবো, কিন্তু মানুষের প্রকৃতি বা স্বভাব একদিনে বদলে গেছে তা আমি বিশ্বাস করবো না।” তাহলে বিয়ের পর একটি অবলা, নিরীহ মেয়ে কিভাবে বদলে যায়? এমনটা কেন হয়? কেন হচ্ছে? যে মেয়ে হিসাবে, বোন হিসাবে ভাতিজি হিসাবে সবচেয়ে ভাল হতে পারলো; সে বউ মা হিসাবে, ভাবী হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে কেন ভাল হতে পারলো না । তার কারণ হয়তো খুঁজে দেখার সময় কারও নেই । কোন স্ত্রী যদি ক্যারিয়ার গঠন করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে থাকে তবে দোষের কোথায় ? ডাক্তার হবার পথে কোন মেয়ে যদি বিয়ের পর বড় কোন ডাক্তার হতে না পারে তাহলে কেউ বলে না স্বামীর কারণে সে ডাক্তার হয় নি । তখন বলে সে সংসারী হয়ে গেছে । যে মেয়েটি ক্লাসে কখনও সেকেন্ড হয় নি; বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি ফার্স্ট হয়েও সে মা ছাড়া তেমন কিছু হতে পারে নি জীবনে ।  হয়তো ভাল মাও হতে পারে নি নিজের চাপা কষ্টের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে । কেউ তো তখন বলে না সে তার স্বামীর জন্য হতে পারে নি  ।বলে সে তো পাক্কা গৃহিণী হয়ে গেছে । বাচ্চা মানুষ করছে, স্বামীর সংসার দেখছে । আরে ভাই মেয়েদের ওইটাই বড় দায়িত্ব । হা আমিও অস্বীকার করছি না যে মেয়েদের মূল দায়িত্বই সেটা । কিন্তু এর পাশাপাশি সে কি পারতো না নিজের মতো করে সফল হতে ।  অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এমন ক্যারিয়ার সচেতন মেয়েরা হবু স্বামী ও তার পরিবারের সাথে বিয়ের আগেই কথা বলে রাখে তার স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা নিয়ে । তার স্বপ্ন পুরনে কোন বাঁধা দিবেনা বলে কথা দিয়েও বিয়ের পর কিন্তু কথা রাখে না স্বামী । বরং ইচ্ছেকৃতভাবে তাকিয়ে দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালিয় রাখে সন্তান লালনের কথা বলে । বাবা হিসাবে ছেলেরা সন্তানকে বেশী ভালবাসেন না মা হিসাবে মেয়েরা সন্তানকে বেশী ভালবাসেন ? এই বিষয়টা সবার পর্যালোচনা করে দেখা দরকার । তবে হা এটা আমি ১০০% নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারব, যে একজন মানুষ হিসাবে মানুষের যে আত্মমর্যাদা, আকাঙ্ক্ষা, ভাললাগা, প্রত্যাশা থাকে সেগুলো যদি স্বামীরা স্ত্রীদের ক্ষেত্রে খেয়াল করতো নিজের ক্ষেত্রে যেভাবে খেয়াল করে তাহলে স্ত্রীরা কষ্ট করে আর চাকুরীর জন্য বাইরে এসে নিজেদের কাজের চাপ ও বোঝা বাড়াতো না বলে আমার বিশ্বাস । সন্তানের পাশে তো বেশী সময় থাকতে চায় মেয়েরাই ।চাকুরীজীবী মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যাদের বাসায় ছোট বাচ্চা আছে তারা কখন বাসায় ফিরে সন্তানের মুখ দেখতে পারবে, তাকে বুকে জড়ায় কপালে গালে আদরের চুম্বন বসাতে পারবে সেজন্য অস্থির থাকে । অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষরা কিন্তু সন্ধ্যায় অফিস শেষে বাসায় ফিরতে নারাজ । কেন? কারণ বাসায় ফিরলে ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সময় কাটাতে হতে পারে! পুরুষরা  সাধারণত বিবাদ-বিসংবাদের সময়  নারীদের চেয়ে কম কথা বলে থাকে । তাই  যখন তারা কথা বলে সবাই তাদের কথায় বেশী শোনে এবং বিশ্বাস করে ।আর এই সুবাদে তারা তথা স্বামীরা নিজেদের অক্ষমতা ও ত্রুটিগুলো ঢাকার জন্য ফলাও করে নিজের অজান্তেই স্ত্রীর ত্রুটিগুলো বাবা-মা বা আত্মীয় স্বজনের কাছে পরিবেশন করে যখন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দ্বন্দ্ব চলে । আর স্বামীর সংসারেও স্বামীর আত্মীয় স্বজনের কাছে সেভাবে আপনজন হয়ে উঠতে পারে না স্ত্রীরা । তাই তার কথা কেউ চিন্তায় করে না । সবার নজর থাকে নিজের জনের উপর ।কিন্তু সেও যে স্বামীর বাবা-মার কাছে তাদের মেয়ের মতোই দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়ার দাবীদার, তা সে পায় না । ফলে তার প্রতি অন্যদের নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গির ফলে হয়তো স্ত্রীর মাঝেও নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয় ।সেক্ষেত্রে স্বামীর উচিৎ স্ত্রীর অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে তার পাশে থেকে  স্ত্রীকে নিজের পরিবারের কাছে আপনজনে পরিণত করার ব্যবস্থা করা । কিন্তু কয়জন তা করে? বরং স্ত্রীর দোষ ফলাও করে সবার সামনে পরিবেশন করে নিজের দিকে সবাইকে ভেড়ানোর জন্য । তাই স্ত্রীর অসফলতার, দোষের দায়ভার কারও উপর বর্তায় না আমাদের এই সমাজে। স্ত্রীকে একাই সে দায়ভার বহন করতে হয় নিরবে, নিভৃতে ।স্বামীর দোষে যদি স্ত্রী দোষী হয়ে থাকে তাহলে স্ত্রীর দোষে কেন স্বামী দোষী হবে না? লেখকঃ প্রকাশক ও সম্পাদক, মহীয়সী ডটকম (বাংলাদেশের নারী বিষয়ক প্রথম নিউজ পোর্টাল)

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ
আমার ডিভাইস ভাবনা

আমার ডিভাইস ভাবনা

২২ জানুয়ারী ২০২৪

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

২৮ ডিসেম্বার ২০২৩

আমার বাচ্চা খায় না!!????

আমার বাচ্চা খায় না!!????

২৪ ডিসেম্বার ২০২৩

আক্রমনাত্মক দাওয়াহ!!!

আক্রমনাত্মক দাওয়াহ!!!

১৩ ডিসেম্বার ২০২৩