
শারমিন আকতারঃ পহেলা বৈশাখ; বাঙ্গালীর প্রাণের মিলন মেলা । আমরা বাঙ্গালীরা খুব গর্বের সাথে পহেলা বৈশাখ উৎযাপন করি । পান্তা ইলিশের ঢল নামে সারা বাংলায় । যে পান্তা অন্য দিন বাসায় থাকলে আমাদের সেই বেলার অন্ন না খেয়ে ভুখা থাকাকে আমরা বাঙ্গালী গর্বের বিষয় বলে মনে করি সে বাঙ্গালী একদিন পান্তা খেয়ে কিভাবে যেন গর্বিত হয়ে উঠি !!!
যে বাঙ্গালী গ্রামের মেঠো পথে কাঁদা মাখা পিচ্ছিল পথে বাবার হাত ধরে স্কুলে গিয়ে আস্তে আস্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে রাজধানীতে মাল্টি ন্যাশনাল কোন কোম্পানিতে বা বিশাল কোন ব্যাংকে নিজের একটা বড় অবস্থান তৈরি করে নেয় তখন সে এই পহেলা বৈশাখের দিন ছাড়া আর ৩৬৪ দিন ভুলে থাকে তার দেশ, মাটি, সংস্কৃতি, শেকড়কে... ।
যে কাঁদা মাখা পিচ্ছিল পথে হাঁটতে গিয়ে পড়ে কতবার ছেড়া লুঙ্গি । পরা বাবার হাত ধরে শক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সামনে এগিয়ে জাবার প্রত্যয়ে সে বাঙ্গালী তার সন্তানকে সেই গ্রামে আর নিয়ে যায় না । তার সন্তান তার বাবা-মার শেকড়ের দুর্বলতা দেখতে পাবে বলে । সে কেমন অজো পাড়া গাঁ থেকে উঠে এসেছে, তারা চাচা-দাদারা তার মতো করে সুন্দরভাবে ভদ্র ভাষায় কথা বলতে পারে না । ভাল পোশাক তাঁদের নেই, তাঁদের বাসায় গেলে ভাল কোন ফার্নিচারে তারা তাকে বসতে দিতে পারে না সনের মাদুর বা কাঠের পিঁড়ি পেতে দেয় । তাই নিজের ছেলে-মেয়েকে তার পূর্ব পুরুষের এমন হতো দরিদ্র দৈন্য দশার চিত্র অবলোকন করাবে না বলে এতো আয়োজন । গ্রীষ্মের ছুটিতে দাদা বা নানা বাড়ির না নিয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয় অন্য কোন জায়গায় বেড়াতে ।
আমরা যারা আজ একদিনের নববর্ষ নিয়ে মেতে আছি আমি তাঁদের প্রশ্ন করবো আপনি কি এই বছরের সাল কতো তা কোথাও না দেখে বা কারও থেকে না শুনে এমনি মনে রেখেছেন? আপনি কি বুকে হাত রেখে বলতে পারেন যে এবার ১৪২২ সাল তা আমি এমনি এমনি জানি যেমনটা জানি ২০১৪, ২০১৫ সামনে ২০১৬ সাল...?
লেখক ও প্রচ্ছদ শিল্পী আফসার নিজাম একদিন পহেলা বৈশাখ কতো তারিখে ! এই প্রশ্ন নিয়ে মনের কষ্ট প্রকাশ করে বলেন-
“আজ একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো পহেলা বৈশাখ কতো তারিখে। আমি বললাম ১ তারিখে। সে আবার প্রশ্ন করলো পহেলা বৈশাখ কতো তারিখে। আমি আবারও বললাম ১ তারিখে। তিনি খুব বিরক্ত হলেন। আমার হাসি পেলো। আমি বিষয়টি নিয়ে বেশ কৌতুহলী হলে ওঠলাম। আমি বেশ কয়েকজনে প্রশ্ন করলাম পহেলা বৈশাখ কতো তারিখে। কেউ কেউ জবাব দিলো ১৪ তারিখে! আমি বিস্ময়ে হতবাক। আর ভাবলাম আমরা বাংলাভাষাভাষি মানুষ কতোটা ইংরেজ হয়ে ওঠেছি। বাংলা মাসের তারিখ ইংরেজিতে বুঝি। আজ একটি প্রশ্ন মনের ভেতর ক্ষোভের সৃষ্টি করছে। ভাষা আন্দোলন কি ভুল ছিল!”
অথচ গ্রামে গিয়ে দেখেন ৭০ বছরের বয়স্ক দাদী-নানী বা পঞ্চাশ বছরের মা-চাচি যারা তারিখ জানার জন্য কখনও পঞ্জিকা দেখে না তারা জানে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ থেকে শুরু করে চৈত্রের দাবদাহ পর্যন্ত কখন বাংলাদেশ কি রূপে সাঁজে। আপনি যে কোন সময় তাঁদের জিজ্ঞাসা করে দেখেন তারা ঠিকই আপনাকে বলে দিতে পারবে সেদিন বাংলা সনের কোন মাসের কতো তারিখ ?
বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে আমাদের চেয়ে গ্রামের অশিক্ষিত মানুষ যাদের আমরা শহরে দামি ফ্ল্যাটে থাকি বলে ছোট করে দেখি তারাই বেশী লালন করে। বাংলার নিদারুণ ঐতিহ্যকে ধারণ করেই তারা বেঁচে আছে । তাঁদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মিশে আছে বাংলা, বাংলা বর্ষ, বাংলার ভাটিয়ালী গান, বাংলার মাটির গন্ধ । আর আপনি, আমি? একদিন পান্তা-ইলিশ, একদিন উদোম গায়ে বেদম পায়ে রাস্তায় মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে নিজেকে বিশাল মাপের বাঙ্গালী ভাবা শুরু করি... !!!
পান্তা বিলাসের সংস্কৃতি আমাদের কখনও বাঙ্গালিয়ানা এনে দিতে পারে না, আমাদের শুদ্ধ করতে পারে না । আমাদের শুদ্ধ হতে হলে শুধুমাত্র রাজপথে শোভাযাত্রায় নৃত্য না করে কর্দমাক্ত মাটিতে নেমে আসতে হবে । অসহায় হাজার বাঙ্গালীর বেদনা বুঝে তাঁদের পাশে দাড়াতে হবে । মোকাম্মেল হক নয়ন রাস্তায় পড়ে থাকা হত দরিদ্র মানুষের হাহাকারের কথা তুলে ধরেন তার কবিতায় এভাবে-
“হে সভ্যজন,
আমি কুকুর-বিড়ালের বাচ্চা নই;আমি মানুষের বাচ্চা। তোমরা যারা আজ আমার মোটা চাল চুরির টাকায় মিনিকেট-বাসমতি চালের গরম ভাতে পানি ঢেলে শত টাকায়, হাজার টাকায় পান্তা ইলিশের বিলাসের কৃষ্টি সাজাও।আমার মোটা কাপড় চুরির টাকায় যারা রাজপথ আলপনায়
রাঙাও আমি লাথি মারি তোমার সভ্যতায়..লাথি মারি তোমার কৃষ্টি সংস্কৃতির ভুয়া
ফানুসে। আমার ভুকা উদরে লাথি মেরে যারা স্বাধীনতার হাওয়াই বুলি আউড়াও আমার
ক্ষয়ে যাওয়া বুকের মিছিল শুনে যাও-আমি ৪৭ এ যা ছিলাম,৭১ এও তাই ছিলাম; ২০১৫ তেও
তাই আছি। কালে কালে শুধুই মানচিত্র আর পতাকাই বদলেছে। আমি ভুকা ভুকাই আছি। মিছিল শোন মিছিল...এ আজাদী ঝুটা হায়..এ আজাদী ঝুটা হায়..এ স্বাধীনতা মিথ্যে...।"
একদিনের পহেলা বৈশাখে মেতে নিজের সংস্কৃতি লালন করার লৌকিকতা ছেড়ে নিজের ঐতিহ্য ও শেকড়কে লালন করি নিজেদের জীবনে; মিথ্যে বাঙ্গালিয়ানার খোলস ছেড়ে হয়ে উঠি সত্যিকারের কোন মানবিক গুণাবলীর গর্বিত বাঙ্গালী ।নিজেদের জীবন, আচার-আচরণে এমন উজ্জ্বল আভা তৈরি করি যাতে সারা পৃথিবীর সামনে মাথা লুকিয়ে নয় মাথা উঁচু করে বুক চাপড়ে বলতে পারি “আমি বাঙ্গালী, আমি গর্বিত বাঙ্গালী ।”
লেখকঃ প্রকাশক ও সম্পাদক, মহীয়সী
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)