বিবিধ

ছেলেরা কেন পতিতার কাছে যায়?

ছেলেরা কেন পতিতার কাছে যায়?
prone শারমিন আকতারঃ নারীদের পতিতা বা যৌনকর্মী হওয়ার পিছনে যেমন নানা কারণ লুকিয়ে আছে সেইরকম পুরুষদেরও পতিতাদের কাছে যাওয়ার পেছেন রয়েছে মারাত্মক কিছু কারণ । যেগুলো আমাদের দেশের পরিবার এবং সমাজে নানা ধরণের অবক্ষয় সৃষ্টি করছে। মানুষ কেন যৌনকর্মের জন্য পতিতালয়ে যায় সেইটার কারণ বের করার জন্য ২০০৫ সালে একটি ইন্টারন্যাশনাল প্রোজেক্ট রিসার্স চালানো হয় । এই রিসার্সে ৭০০ জন পুরুষের সাক্ষাৎকার নেয়া হয় । সেই গবেষণায় যেসব গবেষক কাজ করেছেন নারী গবেষক এবং লেখক জুলি বিনডেল তাদের একজন । এই ৭০০ জন পুরুষের মধ্য থেকে ১২ জন পুরুষের সাক্ষাৎকার নেন জুলি বিনডেল নিজেই । প্রায় ৬ টি দেশে এই গবেষণা চালানো হয় । এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা ও ফলাফলের ভিত্তিতে নারী গবেষক জুলি বিনডেল ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত পুরুষদেরদের পতিতা ব্যবহারের কারণ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেন । “দ্যা গার্ডিয়ান” প্রকাশিত প্রবন্ধ “Why men use prostitutes”; সেখানে তিনি পুরুষদের পতিতা বা যৌনকর্মী ব্যবহারের কারণ উল্লেখ করেন । ২০০৫ সালে জুলি বিনডেলদের দ্বারা পরিচালিত গবেষণায় উল্লেখ রয়েছে যে প্রতি দশকে পতিতার কাছে যাওয়া পুরুষের সংখ্যা দিগুন হচ্ছে । এসব কাজ করে যে সবাই অনেক তৃপ্ত তা না; এসব কাজ করার পর তাদের অনেকেই অপরাধপ্রবণতায় ভুগছেন এবং মানসিক ভাবে অতৃপ্ত থাকেন । কারণ কেউ মনে করেন “ টাকা দিয়ে সে... করে অযথায় টাকা নষ্ট”, কেউ বলেন “ এরপরও একাকীত্ব রয়েই যায় ।” আবার কেউ বলেন “ এতে স্ত্রীর সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হয় ।” “’I don’t get anything out of sex with prostitutes except for a bad feeling,” অর্থাৎ “একটি খারাপ অনুভুতি ছাড়া আমি পতিতার সাথে যৌনকার্য চরিতার্থ করে আর তেমন কিছু পাইনা ।” গবেষণায় ডাটা কালেকশনের সময় বেন নামক সাক্ষাৎকার দেয়া এক পুরুষ বলেন এ কথা ।অনেকের এমন অতৃপ্তি অপরাধ প্রবণতা থাকার পরেও তাহলে কেন পতিতাদের কাছে যাচ্ছে পুরুষরা ? জুলি বিনডেল এসবের উপর একটি সংক্ষিপ্ত ফাইনডিং তুলে ধরেছেন  দ্যা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত তাঁর আর্টিকেলে । তাঁর আর্টিকেলের আলোকে আমরা আলোচনার সুবিধার্থে কয়েকটা পয়েন্টরের অধীনে পুরুষদের পতিতা ব্যবহারের কারণ উল্লেখ করা হল- ১) শৈশব থেকে অবহেলা এবং নিঃসঙ্গতা শৈশবের নিঃসঙ্গতা এবং আত্মীয় স্বজন বিশেষ করে মহিলাদের সাথে সেভাবে মিশতে না পারার কৌশল না জানার কারণেও ভেতরে ভেতরে বহুদিনের জিইয়ে রাখা কষ্ট থেকে অনেকেই পতিতাদের কাছে যায় । এ ব্যাপারে লেখক বলেন “One told me about his experience of childhood cruelty and neglect and linked this to his inability to form close ¬relationships with anyone, particularly women.” অর্থাৎ “ একজন আমাকে তাঁর শৈশবের নির্মমতা, অবহেলা এবং অন্যদের সাথে বিশেষ করে মহিলাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করার ব্যাপারে অক্ষমতার অভিজ্ঞতার কথা বলেন ।” তিনি সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করা অ্যালেক্সের কথা উল্লেখ করে বলেন তিনি একজন পতিতার সাথে সহবাস করে তেমন কিছুই পান না তাঁর শুধু শূন্যতায় অনুভুত হয় । কিন্তু তিনি জানেন আন কিভাবে একজন মেয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে হয় তাঁর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে হয় । ২) সঠিক আইনের অভাব এটা রোধে আইন না থাকা বা থাকলেও তাঁর সঠিক বাস্তবায়ন না থাকা টাকার বিনিময়ে সে...কর্ম করা অনেক দেশেই আইনের চোখে দোষনীয় । এটাকে খারাপ চোখে দেখা হয় বিভিন্ন দেশে । গবেষণার মাধ্যমে জানা যায় যে মাত্র ৬ % পুরুষ টাকার বিনিময়ে যৌনকর্মী ব্যবহারের কারণে গ্রেপ্তার হয় । এই কাজ না করার ব্যাপারে সে ধরণের আইন এবং আইন থাকলেও তা বাস্তবায়নের সুষ্ঠু পদক্ষেপ না থাকার কারণেই অধিকাংশ পুরুষ এসব কাজ করছে বলে গবেষণার মাধ্যমে জানা যায় । এই গবেষণা চলা কালে সাক্ষাৎকার দেয়া একজন বলেন- “Any negative would make you reconsider. The law’s not enforced now, but if any negative thing happened as a consequence it would deter me.” অর্থাৎ “যদি কোন নেগেটিভ কিছু ঘটতো তাহলে তাহলে আপনাকে পুনরায় বিবেচনা করতে শেখাত । আইনটি এখন বাস্তবায়ন হয়নি । এর ফলাফল হিসাবে যদি নেগেটিভ কিছু ঘটতে থাকে তাহলে তা অবশ্যই আমাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখবে ।” গবেষণায় সাক্ষাৎকার দেয়া অন্য আর একজন বলেন- “If I’d get in trouble for doing it, I wouldn’t do it. In this country, the police are fine with men visiting prostitutes.”” অর্থাৎ “ যদি এই কাজ করার জন্য আমাকে কোন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হত তাহলে আমি কখনই এ কাজ করতাম না । এই দেশে পুলিশরা পুরুষদের সাথে সুন্দর আচরণই করে যৌনকর্মীদের সাথে মিলিত হবার পরও ।” ৩) স্ত্রী বা গার্লফ্রেন্ডের সাথে বোঝাপড়ার অভাব অনেক পুরুষই মহিলাদের সাথে একটি সত্যিকারের সম্পর্ক তৈরি করতে চায় এবং ব্যর্থ হয়ে প্রায় সময়ই হতাশ হয়ে পড়ে । আর সে সম্পর্কের বিকাশ সাধন করতে পারে না । এ ব্যাপারে গবেষণায় সাক্ষাৎকার দেয়া একজন বলেন- “It’s just a sex act, no emotion. Be prepared to accept this or don’t go at all. It’s not a wife or girlfriend.” ¬ অর্থাৎ“ ইহা শুধুমাত্র একটা যৌনকর্ম কোন আবেগ-প্রেম নয় । ইহা গ্রহণ করতে হয় প্রস্তুত থাকতে হবে না হলে একেবারে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে । তারা স্ত্রী বা গার্লফ্রেন্ডের মতো নয় ।” এই গবেষণায় বব নামক একজন আরও পরিষ্কারভাবে বলেন যে তারা টাকার বিনিময়ে যৌনকর্মীর সাথে সহবাস করে যাতে তারা নিজেকে এনকাউনটার থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে । বব বলেন- “Look, men pay for women because he can have whatever and whoever he wants. Lots of men go to prostitutes so they can do things to them that real women would not put up with.” অর্থাৎ “দেখু..., পুরুষরা নারীকে ( পতিতা)টাকা দিয়ে তাঁর সাথে সহবাস করে কারণ এক্ষেত্রে সে যা খুশি তাই করতে পারে বা যাকে খুশি তাকে ব্যবহার করতে পারে । অধিকাংশ পুরুষই যৌনকর্মীদের কাছে এজন্য যায় যে তারা তাদের সাথে এমন আচরণও করতে পারে বা পেতে পারে যা সত্যিকারের ভাল মহিলারা পছন্দ বা সহ্য করতে পারবে না ।” ৪) অন্য নারীদের ধর্ষিতা হওয়া থেকে বাঁচাতে গবেষক জুলি বিনডেল বলেন এই গবেষণার পর একটা আশ্চর্যজনক ফলাফল পাই যে অধিকাংশ পুরুষই মনে করেন যে তারা যদি টাকার বিনিময়ে পতিতার কাছে না যেত তাহলে তাদের দেহের প্রয়োজনে তাদেরকে অন্য নারীদের রেপ করতে হতো । এমনকি একজন আমাকে বলেই ফেলেন যে- “Sometimes you might rape someone: you can go to a prostitute instead.” “কখনও তুমি কাউকে ধ... করতে পারঃ কাজেই তাঁর পরিবর্তে পতিতার কাছে যাওয়া ভাল ।” “A desperate man who wants sex so bad, he needs sex to be relieved. He might rape.” অর্থাৎ “সে...ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠা একজন পুরুষ যে এই খারাপ ভাবেও যৌনকর্ম সাধন করতে চায়; তাঁর যৌনকর্ম করার ব্যবস্থা থাকা উচিৎ, তা না হলে সে কাউকে রেপ করতে পারে ।” গবেষক জুলি বিনডেল তাঁর আর্টিকেলে এই বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেন “এই মজার অভিজ্ঞতা থেকে আমার একটা বিষয় মনে হয়েছে যে “all men are potential rapists” – অর্থাৎ“ প্রত্যেক পুরুষই একজন পটেনশিয়াল ধর্ষক ।” বাংলাদেশী বিশিষ্ট গবেষক এবং লেখক আখতার হামিদ খান ২৩ ডিসেম্বরে একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত পতিতাদের পতিতালয়ে  আসার কারণ নিয়ে লেখা “কেন এরা এ পথে আসে” শিরোনামের একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশী পুরুষদের পতিতাদের কাছে যাওয়ার তিনটি কারণ উল্লেখ করেন । কারণ তিনটি হচ্ছে- ১. ব্লু-ফিল্ম ও পর্নোসাহিত্যঃ ব্লু-ফিল্ম, পর্নোসাহিত্য ও অশ্লীল ম্যাগাজিন পুরুষদের যৌন উত্তেজনার অন্যতম কারণ। ব্লু-ফিল্ম, অশ্লীল ম্যাগাজিন ও তথাকথিত যৌন উত্তেজক গল্প-উপন্যাস এবং বিদেশী যৌন উত্তেজক ছায়াছবির ব্যাপক ছড়াছড়ি যুবকদের দেহমনে কামনার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তখনই তারা অবৈধ নারী সংসর্গ কামনায় পাগলপারা হয়ে ওঠে। যে কোনো উপায়ে নারী ধ...ের চেষ্টা করে, না পারলে ছোটে পতিতালয়ের উদ্দেশ্য। প্রশ্ন উঠতে পারে, বহু আগে যখন ব্লু-ফিল্ম আবিষ্কার হয়নি তখনও তো পতিতালয় ছিল। প্রথমত তখন ব্লু-ফিল্ম না থাকলে পর্নোসাহিত্য, যৌন উত্তেজক পেইটিং ও চারুশিল্পের অস্তিত্ব ছিল। শত শত বছর আগের উলঙ্গ ভাস্কর্য, নগ্ন নারী চিত্র ও নারী-পুরুষের যৌন মিলনের বহু চিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। দ্বিতীয়, পর্নোছবি ছাড়াও তখন যৌন উত্তেজক অন্যান্য কারণগুলো তখনো ছিল। কেন না জৈবিক তাড়না তো প্রকৃতিগত। ২. দেরিতে বিয়েঃ দেরিতে বিয়ে করাও একটি কারণ। যৌবনের তাড়না স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতিগত। এ জন্যই বিয়ের ব্যবস্থা। কিন্তু যে কোনো কারণে হোক বিয়ে করতে দেরি হলে বয়সের দাবি তো তার অধিকার ছাড়বে না। তাই যৌবনের স্বাভাবিক তাড়নায় যুবকরা বাধ্য হয় পতিতালয়ের অন্ধগলিতে যায়। ছাত্র ও স্ত্রী সঙ্গহীন পুরুষরাই অধিকহারে বেশ্যাগমন করে থাকে। ৩. ধর্মীয় ও নৈতিক অবক্ষয়ঃ যত কারণই থাক ধর্মহীনতা ও নৈতিকতার অবক্ষয় সকল অপকর্মের মূল কারণ। তা যেমন যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। সূরা নুরের ৩৫নং আয়াতে জিনা ও ব্যাভিচারের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে ও চরম শাস্তির কথা বলা হয়েছে। ধর্মেল কথা বাদ দিলেও সভ্যতা ও মানবতার দৃষ্টিতে বেশ্যাগমন জঘন্যতম কাজ। সবচেয়ে নোংরা ও নৈতিকতাহীন কাজ এটি। মজার ব্যাপার হল, অনেকে আছেন, যারা পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়ান আবার তারাই রাতের আঁধারে খদ্দের হয়ে ভেজা বেড়ালের মতো মাথা গুঁজে ঢোকেন বেশ্যাপল্লীতে অথবা হোটেলে বা অন্য কোনোখানে। সামগ্রিকভাবে এ আমাদের নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের নজির। সামগ্রিক অর্থে উপরোক্ত গবেষণার আলোকে বলা যায় যে- পুরুষদের পতিতাদের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে সামাজিক এবং পারিবারিক অবক্ষয় দায়ী । পুরুষের নৈতিক স্খলন তাদেরকে পতিতাদের কাছে নিয়ে যায় ।  পুরুষদের এই নৈতিকতার স্খলনের কারণে অনেক পরিবারে অশান্তি বিরাজ করছে ।এছাড়াও এইডস সহ নানা ধরণের মারাত্মক যৌন রোগের বিস্তার ঘটছে সমাজ ও পরিবারে ।  তাই এই জঘন্য সামাজিক অবক্ষয় রোধ করার জন্য সবার সচেতন হওয়া দরকার ।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ