
কন্যা দুহিতা মেয়ে, শব্দ গুলোর সাথে মায়া মমতার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন কাজ করে। কন্যা শব্দটা শুনলেই ভেসে ওঠে মায়াবতী কোন মেয়ের কথা, মায়া আর ভালোবাসা দিয়ে জগত সংসারকে বিনি সুতায় বেঁধে রাখাই যার কাজ। কিন্তু, অনেক সময় এই মায়াবতীরাই নানারকম লাঞ্ছনার শিকার হয়ে যায়। কারন, মায়ার জিনিষের নাকি অর্থনৈতিক উপযোগ একটু কমই। উপমহাদেশের সময় পরিক্রমায় দেখা যায়, উচ্চ বিত্ত থেকে নিম্ন বিত্ত যে কোন পরিবারেই কন্যা শিশুর জন্ম খুব বেশী স্বাগত জানানো হয়নি। এখানে অর্থনৈতিক সুত্র কিছুটা ভুল প্রমাণ হয়ে যায়। নিম্ন বিত্ত পিতা কন্যা দ্বায় গ্রস্থ হওার কথা চিন্তা করতে পারে, কিন্তু উচ্চবিত্তদেরও মুখ মলিন হয় কোন আশঙ্কায়? এই আশঙ্কাটা যতোটা আর্থিক তারচেয়ে বেশী মানসিক বলেই আমার মনেহয়। পৃথিবীতে অস্তিত্ব লাভের প্রথম প্রহর থেকে কন্যা শিশুর জীবনটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। আলট্রাসনোগ্রাম নামক চিকিৎসা শাস্ত্রের বহুল প্রচলিত উপাদান দিয়েই শুরু হয় অত্যাচার। এই উপাদান সাধারনত টিউমার বা অবাঞ্চিত কোন কিছু সনাক্তকরণের জন্য আবিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অবাঞ্চিত অনাকাঙ্ক্ষিত কন্যা শিশুর আগমন বন্ধে লিঙ্গ নির্ধারণে এর ব্যবহার এখন আশংকাজনক বৈকি! অনেকটা মাথা ব্যাথা হলে মাথা কেটে ফেলে দেওয়ার মতই নির্বিচারে কন্যা শিশুদের মাতৃ গর্ভেই হ... করা হচ্ছে। এ যেন অজ্ঞতার জুগ থেকেও ভয়াবহ, কারন অজ্ঞতার যুগে জন্মের পরে হ... করা হতো, আর এখন জন্মের আগেই পৃথিবীর আল থেকে বঞ্চিত কন্যা, ভবিষ্যতের জায়া ও জননীরা। ভারতের মুম্বাইয়ে বেড়েই চলেছে ভ্রূণ হ...র সংখ্যা। আগের তুলনায় গত তিন বছরে প্রায় ৬১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ভ্রুণ হ...র হার। যা চমকে দেয়ার মতো। বিএমসি'-র করা সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা থেকে এই তথ্য জানতে পেরেছে মহারাষ্ট্র রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। ওই তথ্য থেকে জানা গিয়েছে, ২০১০-১১ সালে বাণিজ্য নগরীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ১৬,৯৭৭টি ভ্রণ হ...র ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। ২০১২-১৩ সালে এই পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ২৭,২৫৬টি। সাধারণভাবে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ করার পর তা মেয়ে হলে ভ্রূণ হ...র প্রবণতা দেখা যায়। ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী মুম্বাইয়ে প্রতি এক হাজার জন ছেলে পিছু ৮৭৪ জন কন্যা সন্তান জন্মানোর রেকর্ড নথিভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থা এতো ভয়ানক না হলেও আশংকাজনক। বাংলাদেশে কন্যা সন্তান জন্মের পর মায়ের উপর নেমে আসে সামাজিক উপেক্ষা ও পারিবারিক অবহেলা। কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়া মানেই তার মাথা নিচু হয়ে যাওয়া। যে কেউ জা খুশি তাকে বলতে পারবে। আর ছেলে শিশু মানেই ত সূর্য সন্তান। জন্ম দেওয়ার পর ছেলের গর্বে মায়ের মাথা উঁচুই হয়। সংসারে পাকাপাকি অবস্থান নিশ্চিত হয়। কিন্তু , মজার এবং সেই সাথে দুঃখের বিশয় হল, বেশীরভাগ মানুষই জানেনা, কন্যা সন্তান জন্মানোর এক্স ক্রোমোজোম পিতারই থাকে। ছেলে সন্তান জন্মানোর জন্য প্রয়োজনীয় y ক্রোমোজোম পুরুষেরই থাকতে পারে, সৃষ্টি গত ভাবে নারীকে তা দেওয়া হয়নি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আমাদের কন্যাশিশুরা ঘরে-বাইরে সর্বত্র আজও নানামুখী সহিংসতা আর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের কোনো কিছুই ছেলেশিশুদের মতো অতটা সহজ ও সাবলীল নয়। শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী শিশুদের জন্য মৌলিক অধিকার হলো- জীবনধারণ, বেঁচে থাকা ও বিকাশের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, সুস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার অধিকার। এ অধিকারগুলো সব শিশুর জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জন্ম থেকেই বেশির ভাগ কন্যাশিশু এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বাল্যবিবাহ নিরোধ (খসড়া) আইন-২০১৪ এ কন্যাশিশুর বিয়ের বয়সসীমা ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করা প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারের এ পদক্ষেপ নানামহলে সমালোচিত হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনিসেফ পরিচালিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে কন্যাশিশু বিবাহের হার ৬৬ শতাংশ। বাল্যবিবাহের এ হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। আবার প্রতিবেদন অনুযায়ী এর মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছরেই গর্ভবতী বা মা হয় তিন-চতুর্থাংশ কন্যাশিশু। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা যায়, ২০ বছর বা এর বেশি বয়সের নারীদের তুলনায় ১৮ বছরের নিচের প্রসূতিদের মৃত্যুর আশংকা প্রায় ২ থেকে ৫ গুন বেশি এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক মায়েরা ৫০ শতাংশ মৃত শিশুর জন্ম দেয়। শিশুবিবাহের কারণে প্রতিনিয়ত বঞ্চনা ও সহিংস আচরণ কন্যাশিশুদের জীবন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। সর্বোপরি সমাজে নারী নির্যাতনের হার বাড়িয়ে দেয়। আজকের শিশু আগামী দিনে ভবিষ্যৎ। দেশের উন্নতি-অগ্রগতি মূলত শিশুদের ওপর নির্ভর করে আছে। তাই কন্যাশিশুকে আলাদা করে দেখার সময় আর নেই।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)