উইমেন (সামাজিক,মানসিক,সুবিধা বঞ্চিত নারী)
"আজকের সভ্যতায় নারীর ভূমিকা”-পর্ব এক

উপমহাদেশেরইতিহাসঃ
“জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান মাতা, ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান’’ এ আলোচনাটি হওয়ার সময়টিতে উপমহাদেশের তিনটি দেশেই আছেন মহিলা স্পীকার। আসুন তাঁদের সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাকঃ
বাংলাদেশ-ড শিরীন শারমিন(৫০)-পিএইচডি-রাজনৈতিক পরিবার, পিতা সচিব
ভার-সুমিত্রা মহাজন(৭২)-মাস্টার্স, দেবী অহিল্যা বিশ্ববিদ্যালয়-তৃণমূল নেত্রী
পাকিস্তান-ড ফাহমিদা মির্জা(৬০)-এমবিবিএস-রাজনৈতিক পরিবার
একটি বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরি, এ তিনজনের মধ্যে দুইজনই রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে, রাজনীতিতে এসেছেন পিতার হাত ধরে। সুতরাং নারী স্পীকার দেখেই আত্নপ্রসাদে না ভুগে অন্য একটি চিন্তা মাথায় রাখা যেতে পারে, নারীর এ অবস্থানে আসা কি তাহলে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে নয়?
প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে চলে যাই আরও চার নারীর কথায়ঃ
১। ঝাঁসির রাণী লক্ষ্ণীবাঈ
২। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
৩। বেগম রোকেয়া
৪। নবাব ফয়জুন্নেসা
কলেজে পড়েছে এমন মেয়ে এ দেশে পাওয়া যাবে না এ চারজনের নাম শুনেন নি। মাঝে মাঝে বিদ্যাসচেতন পরিবারের অমনযোগী মেয়েটি পড়ার চাপ সইতে না পেরে বলেই ফেলেছেন হয়ত, “বেগম রোকেয়া আমার কী যে সব্বোনাশ করলেন! এদ্দিনে দিব্বী চার বাচ্চার মা হয়ে যেতাম…!’’
এ চারজনই যার যার সময়ে সময়ের মাইলফলক ছিলেন। লক্ষ্যণীয়, বেগম রোকেয়া ছাড়া বাকি তিনজন শুধু নারী সমাজের নেত্রী ছিলেন না। সহযোদ্ধা বা সমসাময়িক পুরুষদের চেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন নিজের মত প্রতিষ্ঠায়। আর বেগম রোকেয়া, এক বিষ্ময় নারী! যিনি আপন মনে বল্গাহীন যুক্তিবাদী মননের চর্চা করেছেন। কুমারী কন্যারা যখন শক্তিমত্ত স্বামীর আশায় শিবপূজা করছে, এই মহীয়সী তখন ইংরেজী ভাষা শিখছেন, কবিতা লিখছেন। সমাজ যখন ভ্রুকুটি হানছে আর উঁকি দিচ্ছে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের কাপড়ঘেরা ছাত্রীবাহী গাড়িতে, তিনি তখন সুলতার স্বপ্নে বিভোর, স্বপ্ন দেখছেন ‘নারীস্থান’এর। আশচর্য কল্পনাবিলাসী, অথচ বিজ্ঞানমনষ্ক, যুক্তিবাদী, তীর্যক এই যাদুকরীর দৃষ্টি। তাঁর নারীস্থানে ঘর-বাহির দুইই সামলাচ্ছে নারী। কিভাবে? অফিসে পুরুষ চা-পত্রিকা-রাজনীতির আড্ডায় যা সময় নষ্ট করছে, নারী সেসময়ে কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে আশ্চর্য সব যন্ত্র বানাচ্ছে ঘরদোরের কাজ সামলাতে। সৌরশক্তি, বিদ্যূতশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে জীবনযাপনকে স্বাস্থসম্মত করার জন্য।
এইমুহুর্তেরচারপাশঃ
কেমন আছেন উপমহাদেশের নারীরা? এই ২০১৪তে? বিশেষণ করতে দু’টি প্যারামিটার ব্যবহার করা যায়, ধর্ম এবং ভৌগলিক বা দেশীয় পরিচয়।
উপমহাদেশের তিনটি দেশে দুইটি ধর্মাবলম্বীদের প্রাধান্য লক্ষ্যণীয়। মুসলিম এবং হিন্দু ছাড়াও আছে খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ প্রভৃতি ধর্মের মানুষ। হিন্দু ধর্মের সামাজিক আচরণে, সত্যি কথা বলতে জন্ম,মৃত্যূ এবং বিবাহকেন্দ্রীক কিছু আনুষ্ঠানিকতা এবং বাধ্যবাধকতা ছাড়া ধর্মের অস্তিত্ব বিরল। একই কথা খ্রিষ্টানদের জন্যও প্রযোজ্য। বৌদ্ধরা এক্ষেত্রে অনেকটাই রক্ষণশীল। মঠ ছেড়ে পথে নামা বৌদ্ধের সংখ্যা এখন কম নয়, কিন্তু তারা প্রায় সবাই মূল অভিমুখী। মুসলিম সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য তাদেরকে অনেকখানিই স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, বিশেষ করে হিমালয়ের পাদদেশের এই ব-দ্বীপে। মুসলমানরা উদার, এজন্য তাদের জীবনাচরণে সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ বেশী। পোশাক আশাকের ধরণ ধারণ, আদব-সালাম এ সব পালটে যাচ্ছে, এমনকি জন্ম-মৃত্যূ-বিবাহের অনুষ্ঠানগুলোতেও আজকের দিনে স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পারছে না মুসলিম পরিবারগুলো।
পরিবর্তনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়েছে, বৃহত্তম শপিং সেন্টারেও গড়ে উঠেছে মহিলাদের আলাদা নামাজের জায়গা। কর্পোরেট লেভেলেও উচ্চপদে উঠে আসছেন যোগ্যতাসম্পন্না নারীরা। আগে ‘চাকুরে মহিলা’ মানেই যে ঋণাত্নক ইমেজ তুলে ধরা হত, আত্নসমানবোধসম্পন্না নারীরা সে তীর্যক দৃষ্টিকে ঋজু করতে পেরেছেন অনেকখানি। তবে, এখনও, এই আধুনিকতার যুগেও একজন নারী চিকিতসক নাইট ডিউটিতে প্রাণ হারাচ্ছেন তাঁরই এক অধস্তনের পাশবিক ক্ষুধার কাছে।
বাংলাদেশ এবং ভারত এইসব ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের ল্যাগ বজায় রেখে একই দিকে ধাবমান। অর্থাৎ, ভারতে হয়ত বহুজাতিক কোম্পানীতে এক্সিকিউটিভ পর্যায়ে নারীর আগমণ যে সময়ে, বাংলাদেশে সেটা সম্ভব হচ্ছে আরও দশ বছর পর। আবার, ভারতে চলন্ত বাসে নারী ধর্ষিতা হচ্ছেন যে বছর, বাংলাদেশের কিছু বিকৃতমনা পুরুষ সে স্বাদ নিচ্ছেন পরের মাসেই! সে হিসেবে পাকিস্তান একটু অন্যগতিতে চলমান। প্রবল ভারতবিমুখী মনোভাবের কারণে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এখনও সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি সেখানে, তবে রাজনীতিতে নারীর সাহসী এবং স্বতন্ত্র ভূমিকা প্রশংসনীয়।
‘নারীরভূমিকা’- এটি নিয়েআলোচনাকেন?
আজকের দুনিয়ায় নারীকে বাহারী এক আচ্ছাদন দিয়ে বঞ্চনা ঢাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন আমাদের নেতা নেত্রী কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সেই শতচ্ছিদ্রময় বাহারী পোশাকের নাম ‘নারী অধিকার’। মজার কথা হল, এই অধিকারবাদীরা, নারী পুরুষ নির্বিশেষে, নারীকে বারংবার মনে করিয়ে দেন তার অধিকারের কথা। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ইহলৌকিক, এমনকি পারলৌকিক এবং পাশাপাশি অফিস-আদালত-রান্নাঘর-বিছানা সবক্ষেত্রে নারীর কি কি অধিকার পাওনা আছে সেসব দ্বিধাহীন কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু নারী এই এতোসব অধিকার ভোগ করার পর সমাজকে কী দিবে বা সমাজ তার কাছে কি চায় সে কথাটি কেউ ভুলেও উচ্চারণ করেন না। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টিকর্তা নারীকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তাকেই তার একমাত্র করণীয় দেখিয়েই ক্ষান্ত নন এই অধিকারবাদীরা, ক্ষেত্রবিশেষে সে দায়িত্বেও বাধ সাধতে চান অধিকারের ধুয়া তুলে।
প্রশ্ন হল, নারী তো তাহলে বেঁচেই যাওয়ার কথা। নারীর তবে কোন কর্তব্য নেই। একটিমাত্র সন্তান জন্ম দিয়ে অধিকার আদায়ে নিমগ্ন হতে পারেন। আর সে সন্তানটিকেও মিসট্রেস-আয়া-চৌকশ শিক্ষকের হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে পতিত উদ্ধারে মন দিতে পারেন। আর পুরুষকে হতে হবে অত্যন্ত সচেতন। চাকুরী, বাজার সেরে ঘরে ফিরেও নারীকে দিতে হবে সাহচর্য্য, বাড়াতে হবে সাহায্যের হাত। গেরস্থালী কাজ কি নারীর একার কাজ? অবশ্যই নয়! কিন্তু বাস্তবতা কি?
উপরের প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে আপনি দেখবেন প্রায়ান্ধকার শেষবেলায় কর্মজীবি নারী ঘরে ফিরছেন, হাতে বাজারের থলে। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে বাসায় এসে রান্না, বাচ্চাদের দেখাশুনা, সব সেরে আরও উচ্চাকাংক্ষী স্বামীর আসার প্রহর গুণছেন। ওদিকে বাচ্চাদের গৃহশিক্ষকের তান্ডবে বাচ্চার ত্রাহি মধুসূদন দশা মায়ের নজরে আসার সুযোগ নেই। হালের ফ্যশন জানতে বা দিনের কর্মক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে মা’টি তখন টিভিতে নজর দিয়েছেন। বাচ্চাদের জন্য ফ্ল্যটের বুকিং দিয়েছেন হয়ত আজই। পঁচিশ বছর পর সন্তানের মাঁথা গোঁজার ঠাঁই হচ্ছে, কিন্তু আজকের শিশুটির মাথার ভেতরের মগজে যত প্রশ্ন তার জবাব দেয়ার সময় কারও নাই, এক বেতনভোগী গৃহশিক্ষকটি ছাড়া।
তাহলে? শুধুই অধিকারের গালভরা বুলি দিয়ে প্রতিদিনের জীবন চলছে না। প্রয়োজন অধিকার ও কর্তব্যের সমন্বয়ে একটি সুষম পরিকল্পনা। কয়েক দশক ধরেও এ অধিকার ও কর্তব্যের ফাঁকা জায়গাটুকু আমাদের নারীনেত্রীরা চিহ্নিত করতে পারেন নি। কেন করেন নি সে আলোচনায় যাবো না। সময় যখন এখনই শুরু করার, তাহলে ‘কেন এতোদিন হয়নি’ সে আলোচনা অবান্তর।
(চলবে)
পুনশ্চঃ পূর্বনির্ধারিত বিষয়ে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে প্রবন্ধ তৈরী করা হয়েছে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)