মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ

কত রক্তের আঁখরে লেখা নতুন স্বাধীনতা!: তাহনিয়া তরিক

কত রক্তের আঁখরে লেখা নতুন স্বাধীনতা!: তাহনিয়া তরিক

 

আলহামদুলিল্লাহ !!! আমরা এখন প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি। মুক্ত বাতাসে স্বাধীনভাবে শ্বাস টেনে নিতে পারি। আয়নাঘরের দুর্বিষহ কালো কাপড়ে ঢাকা দিনগুলো থেকে মুক্তি পেয়েছে কতশত মজলুম। মিথ্যা মামলার ঘানি টানতে টানতে অস্থির মানুষ আজ হাঁপ ছেড়ে বেচেছে। কারাগারের নিঠুর প্রাচীর থেকে বেড়িয়ে আপনজনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কত বনী আদম! এখানে ওখানে পালিয়ে থাকার দিন শেষ। মাথা উচু করে আজ সত্য বলবার দিন এসেছে। বাংলার আকাশ থেকে আজ কতটা বছর পরে ঘোর তমসার অবসান ঘটলো! একটি স্বৈরাচার মুক্ত স্বদেশ দেখলো আজ বাংলাদেশীরা। বাংলার ইতিহাসের এই নতুন প্রভাতের পিছনে লুকানো রয়েছে কতনা ত্যাগ আর তিতিক্ষার মহাকাব্য ! এই নতুন ইতহাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় লেখা হয়ে রইলো কত না রক্তঝরার বেদনাগাঁথা!
একটি প্রজন্ম । জন্ম থেকে যার মুখ চেপে ধরে রাখা হয়েছে। যার নাগরিক হিসাবে সামান্য ভোটাধিকারটুকু হরণ করা হয়েছে। যাকে একের পর এক শিক্ষার নামে মিথ্যা ইতিহাসের গরল গিলানো হয়েছে। আর কেড়ে নেয়া হয়েছে ন্যায্য অধিকারটুকু। জন্মের পরেই যাকে মনে মগজে প্রতিবেশী দেশের দাসত্বে বাধ্য করা হয়েছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সেই প্রজন্ম, অবাক করা সাহসে, মাথা ঝাড়া দিয়ে এক দীপ্ত শপথ নিল। যেভাবেই হোক নিজের অধিকারটুকু আদায় করে নিতে হবে। সরকারী চাকুরীতে কোটার বদলে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবী নিয়ে রাজপথে নামে বাংলার তরুণ-যুবকরা। একটি ছোট দাবী আদায়ে তারা তৎপর ছিল। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের নির্দেশে তাদের এ আন্দোলন দমনের জন্য তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আইন শৃংখলা বাহিনী , সরকার দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী। একের পর মায়ের বুক খালি হতে থাকে। পরবর্তীতে নিহতদের হত্যার বিচার দাবি এবং গুলির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন জোরদার হয় এবং ক্রমান্বয়ে সরকারের জুলুমের মাত্রা বাড়তে থাকলে আন্দোলন এক দফা তে গিয়ে পৌঁছে। কি নির্মম দমন নীতি চালিয়ে এ আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল জালিম শাসকগোষ্ঠী! সরাসরি কাছ থেকে গুলি করে মারা হয় আবু সাঈদকে। নির্বিচারে গুলি করে একের পর এক শেষ করা হয় শান্ত, ওয়াসিম, মুগ্ধ ,ফাইয়াজ ,আহনাফ , তাহমিদ,সাকিব,তানভীন,দীপ্ত, রুদ্র, মেহেদী, শাকিল ফাহমিন, শাহ নেওয়াজ, ইমন,সাব্বির,খালিদ,রাহাত,হৃদয়, সজীবসহ শত শত তরতাজা প্রাণ। ট্যাংকের উপর থেকে গুলিবিদ্ধ রোজাদার আসহাবুল ইয়ামিন কে ছুঁড়ে ফেলার দৃশ্য মিডিয়ার বদৌলতে দেখেছে বিশ্ববাসী। তখনো প্রাণ ছিল তার দেহে। রিক্সার হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে থাকা ১৭ বছরের রক্তাক্ত নাফিজকে এতোটুকু চিকিৎসার সুযোগ দেয়নি সরকার দলীয় নরপশুরা। কোন হাসপাতালেই নিয়ে যেতে দেয়নি তাকে । এভাবেই সে একসময় ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। হেলিকপ্টারে করে আকাশ থেকে গুলি বর্ষন করা হয় আন্দোলনকারীদের ওপর। ঘরের ছাদে, বারান্দায়, অথবা জানালা দাঁড়ানো শিশু রিয়া গোপ ,আব্দুল আহাদ,নাইমা কিংবা সাফকাতও রেহাই পায়নি এলোপাথাড়ি গুলির আঘাত থেকে। জুলুমের প্রচণ্ডতায় ছাত্রদের সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে আসা সাধারণ জনতা, বিভিন্ন পেশাজীবীরাও একে একে সামিল হতে থাকেন আত্মদানকারীর সারিতে। ব্যবসায়ী,চিকিৎসক,শিক্ষক, সাংবাদিক , কর্মকর্তা,কর্মচারী, শ্রমিক, রিকশা চালক প্রত্যেকেই নেমে আসেন রাজপথে। এমনকি মহিলারা পর্যন্ত যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য নিয়ে নেমে আসে রাজপথে। সরকারী নির্দেশে বাড়তে থাকে দমন-পীড়ন। ভারী হতে থাকে মৃত্যুর মিছিল । দেশকে স্বৈরাচার থেকে মুক্ত করার শপথে নির্দ্বিধায় গুলির মুখে বুক পেতে দিতে থাকে ছাত্র জনতা। জাতিসংঘের হিসাব মতে ১১ই জুলাই থেকে ১১ই আগস্টের আন্দোলনে ৬ শতাধিক এবং বেসরকারি হিসেবে সহস্রাধিক তরতাজা প্রাণ ঝরে গিয়েছে। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার রিপোর্টে এই আন্দোলনে শুধুমাত্র শিশু কিশোরই নিহত হয়েছে ৬৭ জন। ঘরে ঘরে আজ স্বজন হারানোর মর্মান্তিক আহাজারি। সন্তান হারানোর বিভীষিকা। বিধবাদের আর্তচিৎকার। এতীম শিশুদের ‘বাবা’ ‘বাবা’ আর্তনাদ । এখনো মর্গে পড়ে আছে প্রায় দুই ডজন বেওয়ারিশ লাশ। নিখোঁজ রয়েছে হাজার হাজার। এখন পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহতদের মৃত্যুর খবর আসছে। আর আহত অবস্থায় হাসপাতালে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে হাজার হাজার গুলি বিদ্ধ আন্দোলনকারী । কেউ বরণ করেছে পঙ্গুত্ব ,কেউ চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে, কেউ আই সি ইউ তে লাইফ সাপোর্টে দিন কাটাচ্ছে। শুধুমাত্র দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে ৫ শতাধিক ব্যক্তি। টাকার অভাবে চিকিৎসা ব্যবহার বহন করতে পারছি না এমন সংখ্যাও অজস্র। আবার আন্দোলনের শুরু থেকেই নির্বিচারে গ্রেফতার, মামলা রিমান্ড, অমানবিক নির্যাতন সবই চলছিল সমানতালে। একটি জুলুম মুক্ত স্বাধীন দেশের জন্য ছাত্র জনতা সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়েছেন তাদের জীবনের সমস্ত হাসি আনন্দ। ৫ ই আগস্ট হাসপাতালের বেডে শুয়ে আহত সজীব ভাইয়ের কাছে জানতে চাচ্ছিল দেশের কি অবস্থা? স্বাধীন মুক্ত স্বদেশের খবর পেয়ে হাসিমুখে ৬ই আগস্ট রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান তিনি।
বাংলার এই ছাত্র জনতার সম্মিলিত ত্যাগী ও দুঃসাহসী অগ্রযাত্রার ফলেই আজকের মহান রবের দেওয়া এই স্বাধীন, মুক্ত স্বদেশ। তারা যেভাবে নিজেদের আরাম আয়েশ বিসর্জন দিয়ে, প্রচন্ড গরম সহ্য করে, ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে গিয়ে, রাতের ঘুমকে হারাম করে , স্বজনের মায়াকে তুচ্ছ করে শুধু মাত্র স্বদেশ থেকে জুলুম নির্মূলের জন্য রাজপথে অবিচল দাঁড়িয়েছিল এটা সত্যি অবিশ্বাস্য ইতিহাস হয়ে লেখা থাকবে! রাস্তায় নামলেই একের পর এক শহীদ হয়ে যাচ্ছে সহপাঠীরা , নয়তো গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে যাচ্ছে- এটা দেখার পরেও এতটুকু আন্দোলন থেকে পিছিয়ে পড়েনি তারা। যেন এক কাতার খালি হলে, পিছনের কাতার এসে ভরে দিচ্ছিল সামনের কাতার। স্বয়ং পুলিশের ভাষায়ও প্রকাশ পেয়েছে - “স্যার একটা মারলে, একটাই মরে ,বাকিগুলো সরে না।”
স্কুল পড়ুয়া ছোট ছোট ছাত্ররাও পর্যন্ত বাবা মার কাছে আবদার করে আন্দোলনে আসতে না দেওয়া পর্যন্ত ভাত খায়নি, এমনকি গোপনে চিঠি লিখে রেখেও বের হয়ে গিয়েছে অনেকে। জুলুম নির্মূলে তাদের এই প্রতিবাদী অনঢ় অবস্থানে সহায়তা করতে খাবার ,পানি , প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল সাধারণ মানুষ। রিকশা চালকরা আহত নিহতদেরকে বহন করতে যেয়ে অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছে । আন্দোলনকারীদেরকে পানি খাওয়াতে গিয়েও গুলিবিদ্ধ হয়েছে অনেকেই। অ্যাম্বুলেন্স চালক আহত ছাত্র তার গাড়ীতে উঠাতে গিয়ে দেখতে পান যে সেটা তারই ছেলের রক্তাক্ত দেহ। এমনই কতশত ত্যাগের ইতিহাসে মাখা আমাদের এই নব বিজয়! উত্তরায় রাজউক স্কুলের সামনে এক ভদ্রলোক ছাত্রদের জন্য তার বাসার গেট খুলে রাখতেন এবং রাস্তায় আন্দোলনকারী যে ছাত্রদেরকে পেতেন তাদেরকে নিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়াতেন , প্রয়োজনীয় খাবার সাথেও দিয়ে দিতেন। বাড্ডার এক দরিদ্র গৃহকর্ত্রী তার সামর্থ্য অনুযায়ী হাড়ি ভরে ছাত্রদের জন্য মোটা চালের ভাত আর করল্লা ভাজি রেঁধে রেখেছিলে। এক মাকে দেখেছি রাস্তায় পানি বিলি করতে । আরেক মাকে দেখেছি নিজ হাতে ছাত্রদেরকে কাঁঠাল খাওয়াতে। মুন্সীগঞ্জে দরিদ্র মহিলারা বালতিতে করে পানি নিয়ে ঘর্মাক্ত ছাত্রদের মাথা ধুয়ে দিচ্ছিলেন। আরেক জায়গায় চিত্র দেখলাম শরবত বানিয়ে ছাত্রদেরকে খাওয়াচ্ছে মায়েরা। অনেক ঘরে বেশি করে রান্না হতো শুধু আন্দোলনকারী ছাত্রদের প্রয়োজনে যেন দেয়া যায়। এছাড়া চোখের পানি ফেলে জায়নামাজে অবিরাম দোয়ায় থেকেছে অন্তঃপুরবাসী মা-বোনেরা।
সবার দোয়ায় মহান আল্লাহ যেন অসীম সাহস ঢেলে দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বুকে। পুলিশের প্রিজন ভ্যান কে তারা খালি হাতে ঠেকিয়েছে। সাঁজোয়া যান কে তারা পরাভূত করেছে।
রাজপথে ছাত্র জনতা নামাজ আদায় করেছে। কারো দেওয়া খাবার পেলে খেয়েছে, না পেলে না খেয়ে থেকেছে। প্রয়োজনে সারারাত রাস্তায় থেকেছে। গ্রেফতার অথবা নিহত বা আহত হবার সাক্ষাৎ সম্ভাবনা সত্ত্বেও রাজপথ থেকে সরেনি তারা। হাজারো প্রতিরোধ , দমন- পীড়ন, নির্যাতন সত্ত্বেও তারা পিছু হটে নি,
জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। ১৬ই জুলাই খোলা গুলীর সামনে হাসিমুখে বুক পেতে দিয়ে সাহসের দরজা উদ্বোধন করে যায় রংপুরের বীর সন্তান আবু সাঈদ। ভাইয়ের রক্তের প্রতিশোধে স্বৈরাচার উৎখাতের শপথের সারা দেশে পথে নাম লাখ লাখ আবু সাঈদ। হাজারে হাজারে গুলি করেও তাদের ঘরে ফেরাতে পারেনি আগ্রাসি বাহিনী। এমনকি গুলিবিদ্ধ আতিকুলের ডান হাত কেটে ফেলতে হয়; তবুও সে হাসি মুখে বলছিল- “লাগলে আবার যামু।”
আর তাই ৫ই আগস্ট তাদের এই অপ্রতিরোধ্য গণজোয়ার স্তম্ভিত করে দেয় স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীকে। সীসা ঢালা প্রাচীরের মত ছাত্র জনতার অবিচল অবস্থানে খর্ব হয় জুলুম শাহীর যাবতীয় দম্ভ। দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী শাসক। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫৩ বছর পরে বাংলাদেশ খুঁজে পায় তার প্রকৃত স্বাধীনতা!
এই মুক্তি যেন অনন্য! এই নতুন স্বাধীনতার মূল্য সীমাহীন ! অনেক ত্যাগ আর রক্তের বৃষ্টিতে ধোয়া এ স্বাধীনতা। জমিন থেকে এখনো মুছেনি রক্তের দাগ। এত সহস্র প্রাণের আত্মত্যাগে পাওয়া এ নতুন বিজয় ,নতুন স্বাধীনতা সত্যিকার ভাবে সংরক্ষণ করার আমাদের দায়িত্ব। সঠিক পথ নির্দেশনা ও সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তত্ত্বাবধান করতে হবে নতুন পাওয়া এ স্বাধীন দেশের। মহান আল্লাহ আমাদেরকে এই মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করার তৌফিক দান করুন এবং এই স্বাধীনতাকে ধরে রাখার মত শক্তি ও সাহস অটুট রাখুন। তিনি সঠিক পথ দেখান আমাদের সবুজ ভূখন্ডের নতুন কারিগরদের। আমীন।

 

 

 

 

 


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)