মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন : ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন : ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ৩৬ দিনব্যাপী আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেছেন ইতিহাসের অন্যতম স্বৈরাচারী শাসক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল নয়,সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের এবারের আন্দোলন ছিল দ্বিতীয় দফা আন্দোলন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা প্রথার প্রবর্তন করা হয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মোট কোটা ছিল ৫৬%।
এর মধ্যে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা -৩০%, নারী কোটা -১০%, জেলা কোটা -১০%, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা -৫% ছিল। বেশিরভাগ চাকরি প্রত্যাশীদের প্রতিযোগিতা করা লাগতো মাত্র ৪৪% সিটের জন্য।

এই কোটা বৈষম্যের দরুণ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে রাস্তায় নামেন। তাদের দাবি ছিল মেধার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগের সুযোগ দেয়া। সরকারের প্রতি অভিযোগ ওঠে এই কোটার ব্যবহার করে সরকার তার অনুগত লোকদের সব সেক্টরে বসাচ্ছেন, যেন সর্কলক্ষেত্র আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ অবরোধ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করলেও তাদের দাবির জবাবে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন “মুক্তিযোদ্ধারা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের বাচ্চারা কোটা পাবে?”


তার এহেন পীড়াদায়ক বক্তব্য ছাত্রসমাজকে দারুণভাবে আহত করে, জোরদার হয় ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলন ঠেকাতে সরকার পুলিশ ও ছাত্রলীগকে দায়িত্ব দেন। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। ফলস্বরূপ বহু শিক্ষার্থীরা গুরুতর আহত হন। উক্ত হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায় দেশ ও বিদেশে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া লিমিটেড উক্ত সংবাদ কভারেজ করে। অনেকটা চাপে পড়েই কোটা প্রথা বাতিল করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের ৪ই অক্টোবর কোটা প্রথা বাতিল প্রসঙ্গে পরিপত্র জারি করেন সরকার। শেষ হয় আন্দোলন।

এরপর অতিবাহিত হয় ছয় বছর। ২০২৪ সালে ৪র্থ বারের মতো অবৈধভাবে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। শপথের মাত্র ৬ মাসের মাথায় ৫ই জুন ২০২৪ তাং এ ২০১৮ তে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দিয়ে কোটা পূনর্বহাল করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন। পুনরায় ফুঁসে ওঠে ছাত্র সমাজ, শুরু হয় কোটা কেন্দ্রীক দ্বিতীয় দফা আন্দোলন। আন্দোলনের নাম দেয়া হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন।যার নেতৃত্বে কোটা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে নামেন।
সরকারের বেশ কিছু মন্ত্রীরা বলেন, তাদের দাবির পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট আপিল করা হয়েছে এবং বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাঁরা শিক্ষার্থীদের ধৈর্য্য ধরার আহ্বান করেন। শুনানির দিন ধার্য করা হয় ৭ই আগস্ট।
পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আন্দোলনরত ছাত্রসমাজ বুঝতে পারেন, এটা কোটা পদ্ধতির পুনর্বহাল করার সরকারের একটি কৌশল মাত্র।কারণ বিচার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রেই আছেন আওয়ামী মদদ পুষ্ট অনুগত ব্যক্তিরা।

আন্দোলন চলাকালীন ১৪ই জুলাই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা, নাতি-পুতি বলে অভিহিত করেন। দ্বিতীয়বারের মতো এই ধরনের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সেদিন রাতেই উত্তাল হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকেন—

তুমি কে? আমি কে?
রাজাকার, রাজাকার,
কে বলেছে?কে বলেছে?
স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।

শিক্ষার্থীদের এই শ্লোগানকে কেন্দ্র করে একে একে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতে থাকেন পরিষদে থাকা বিভিন্ন মন্ত্রীরা। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন “এসব রাজাকারদের প্রতিহত করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট”।
তাঁর এই আস্কারামূলক বক্তব্যের পর ছাত্রলীগ অস্ত্র ও দলবল নিয়ে পূর্বের মতো এবারও নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপরে হামলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে,লাঞ্ছিত করা হয় নারী শিক্ষার্থীদেরও।

তবে এবারে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হামলায় চুপ থাকেনি, তারা এহেন অযাচিত হামলার পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের তীব্র সাহসী মূলক প্রতিরোধের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে পালাতে শুরু করে ছাত্রলীগরা। প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ মুক্ত ঘোষণা করে সাধারণ ছাত্রসমাজ।
ছাত্রলীগের বেকায়দা অবস্থায় মাঠে নামে পুলিশ। লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল, ছররা গুলি চালানো হয় শিক্ষার্থীদের উপর। ফলস্বরূপ সকল বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। এই অবস্থায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে নিরস্ত্র অবস্থায় কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। মুহূর্তের মধ্যে গণমাধ্যমে ভাইরাল হয় দৃশ্যটি। একে একে নেমে পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা,যোগদান করে স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীরাও। নানারকম স্লোগানে মুখরিত হয় রাজপথ। সবাই যেন এই কথা নিয়েই প্রশ্নাতীত সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সশস্ত্র পুলিশী হামলার মুখে—
“বুকের ভেতর দারুন ঝড়,
বুক পেতেছি গুলি কর।”

দেশের প্রায় সকল জায়গায় শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ,রাজপথ পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। ১৭ ও ১৮ তারিখে ব্যাপক সংখ্যক ছাত্র ও জনতা হত্যা করা হয়।১৮ তারিখ রামপুরায় বিটিভি ভবনে আগুন দেয়া হয়,হেলিকপ্টারের সাহায্যে উপর থেকে ছোঁড়া হয় গুলি। একের পর এক ছাত্র ও জনতা হত্যার খবর আসতে থাকে। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে নির্মমতার এই ভিডিও। পরিস্থিতি ক্রমেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়। ১৮ জুলাই রাত থেকেই বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট।পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া বাংলাদেশকে। জারি করা কারফিউ,মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী।

নেট বিচ্ছিন্ন হওয়ার পেছনে ছিল ভয়াবহ এক পরিকল্পনা।সারা দেশকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে শুরু হয় ক্রাক ডাউন। বিভিন্ন বাহিনীতে থাকা সরকারের অনুগত লোকদের নামিয়ে দেয়া হয় রাস্তায়। চাইনিজ রাইফেল, অ্যাসল্ট রাইফেল, পিস্তল দিয়ে শিক্ষার্থীদের বুক ও মাথা টার্গেট করে চালাতে থাকে গুলি। ১৯,২০ ও ২১ জুলাই চলে ইতিহাসের বর্বরচিত গণহত্যা।

মনে পড়ে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের কথা। নাখালপাড়া গ্রামে অগ্নিবর্ষক অস্ত্র দিয়ে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় পাকিস্তানি সৈনিকরা। সব ঘরবাড়িতে দারুণভাবে আগুন জ্বলে উঠে। তখন তারা ঘর থেকে বের হয়ে যান বাঁচার জন্য। যখন তারা ঘর থেকে দৌড়ে বের হওয়া শুরু করে, তখন পাকিস্তানের সৈন্যরা নির্মমভাবে গুলি বর্ষণ করতে শুরু করে। এ কে খন্দকার তাঁর বইতে লিখেছেন "পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর কয়েকজন অফিসার দাঁড়িয়ে আমার সামনে বলে উঠলেন, "দিস ইজ দ্যা ওয়ে টু ডি ল উইথ দ্যা বাস্টার্ডস"।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় গণহত্যার খবর ছড়ায়নি তখন।বিদেশে থাকা রেমিটেন্স যোদ্ধারা উদগ্রিব হয়ে থাকেন দেশের খবর শোনার জন্য।

২৩শে জুলাই ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপে পড়ে স্বল্প পরিসরে ইন্টারনেট চালু করতে বাধ্য হয় সরকার। কিন্তু ভিপিএন এর কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেতে শুরু করে একে একে নৃশংস গণহত্যার ভিডিও ও ছবি। প্রতিরাতে বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার লাইট বন্ধ করে ব্লক রেইড চালিয়ে আন্দোলনের সাথে জড়িত শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। শুরু হয় গণ গ্রেপ্তার। ২৭ জুলাই পর্যন্ত ১১ দিনে গ্রেপ্তার হয় ৯ হাজার ১২১ জন।নিরাপত্তার অজুহাতে তৎকালীন ডিবি কার্যালয়ে আটক করা হয় পর্যায়ক্রমে প্রধান ছয় সমন্বয়ককে।
সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে জোরপূর্বক তাদের দিয়ে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করানো হয়।বলানো হয় তারা সব আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বুঝে ফেলে এ বক্তব্য জিম্মি করে আদায় করা, তাই তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। শেখ হাসিনার পদত্যাগ সহ ৯ দফা দাবি পেশ করে তারা।

এরমধ্যে ২৫ শে জুলাই প্রধানমন্ত্রী বিটিভি ,মেট্রো ষ্টেশন পরিদর্শনে এসে কেঁদে ফেলে বলেন ‘আমি জনগণের কাছে বিচার চাইছি’। এত পরিমাণে ছাত্র ও জনতা হত্যায় শেখ হাসিনার কোন ধরনের দুঃখবোধ না দেখে মর্মাহত হন গোটা দেশবাসী। তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সম্ভবত এটি ছিল শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের মারাত্মক ভুলের একটি। চরম ক্ষোভে ছাত্রসমাজের সাথে রাজপথে নেমে পড়েন অভিভাবকগণ, শিক্ষকগণ, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা, অভিনয় শিল্পীরা, ব্যান্ড তারকাদল, রিকশা চালক সহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। তারা তাদের করণীয় ঠিক করে নেন। সাহস যোগাতে থাকেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
চতুর্মূখী চাপে পড়ে সরকার আশ্বাস দেয় যে সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করা হবে এবং ১লা আগষ্ট ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

এদিকে, ২৯শে জুলাই জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয় ১৪ দলের বৈঠকে। ছাত্র আন্দোলনকে জামায়াত শিবিরের জঙ্গি আন্দোলন বলে পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে নেয়ার অপচেষ্টা চালায় সরকার। ১লা আগষ্ট বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির কে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
--অপরাধ
আর তারা তাঁদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধুমাত্র এ কারণে যে, তারা মহাপরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল।
---(সূরা বুরুজ:৮)

৩১শে জুলাই নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে সরকারিভাবে শোক দিবস ঘোষণা করা হয়। সারাদেশের ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণ এই শোককে মশকরা মনে করে প্রত্যাখ্যান করেন।তারা পালন করে “রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ” কর্মসূচি।কালোর বদলে ধারণ করেন লাল রং। ফেসবুক প্রোফাইল ছেয়ে যায় লাল পিকচারে।এ যেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের রক্তাক্ত এক বাংলাদেশ!

২রা আগস্ট,বিকালে আনুমানিক দুই লক্ষ লোক জড়ো হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে।সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে বয়ে যায় এক গণজোয়ার।ধারনা করা হয় দেশের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থান।

৩রা আগষ্ট,আলোচনার প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী।সমন্বয়করা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পেশ করেন “প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের এক দফা দাবি”। সরকার তখন পর্যন্ত এ আন্দোলন ও আন্দোলনকারীদের তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখেছেন। শত শত মৃত্যুর পরও তখনও বিষয়টি শুধু জঙ্গি হামলা হিসেবে বর্ণনা করছেন। এই যে তার ক্ষমতা ছাড়ার স্লোগান, দেয়ালে দেয়ালে স্বৈরাচারী লিখন কোন কিছুই যেন তার দৃষ্টির আওতায় আসেনি। বিবিসি বাংলা জানায় “বাংলাদেশের পুরনো রাজনৈতিক দলটি আক্ষরিক অর্থেই দেয়ালের লিখন পড়তে পারেনি।” ক্ষমতা এখানে শুধু তাঁদেরকে নীতিভ্রষ্টই করেনি, বাস্তবতা থেকে অন্ধ করে দিয়েছিল।

৪ঠা আগষ্ট থেকে ডাক দেন অসহযোগ আন্দোলনের। এদিকে ৩ তারিখ রাতে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগকে নির্দেশ দেন পরদিন থেকে প্রতি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ- জামান সেনা কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানান যে সেনাবাহিনী আর গুলি চালাবে না। এতে পরিস্থিতি ছাত্রদের পক্ষে পাল্টে যায়।
৪ঠা আগষ্ট ছিল কোটা আন্দোলনের সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন। সকাল থেকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয় শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। আন্দোলনকারীরা জড়ো হয় শাহবাগ ,সাইন্সল্যাব সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। ঐদিন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে পুলিশ।বেলা ১১ টার পর থেকে তাণ্ডব শুরু করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অস্ত্রধারীরা নেতাকর্মীরা। অসংখ্য মানুষের হতাহতের সংবাদ আসতে থাকে।
৬ই আগষ্ট ঘোষণা করা হয় লং মার্চ টু ঢাকা। তবে সারা দিনের তান্ডবের কথা বিবেচনা করে ছয় সমন্বয়ক লং মার্চ টু ঢাকা ঘোষণা দেন ৫ই আগস্ট।তারা সাধারণ মানুষদের সেদিন রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান।তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে রাতেই যে যেভাবে পেরেছেন ঢাকার বাইরে থেকে রওয়ানা দেন।
এদিকে অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলাতে সরকার তিন দিনের সাধারণ ছুটি,সেইসঙ্গে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশে কারফিউ জারি করেন।যা রোববার (৪ আগস্ট) সন্ধ্যা ছয়টা থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।

৫ই আগস্ট সকাল বেলা থেকে গোটা পরিবেশ থমথমে। শিক্ষার্থীরা কারফিউ ভেঙে শহীদ মিনারে জড়ো হওয়া শুরু করলে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। তবে ১১ টার পর থেকে শাহবাগে নামতে থাকে সাধারণ মানুষের ঢল, পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে। সেই জনসমুদ্র যাত্রা করে গণভবনের দিকে।

এদিকে সকাল ১০ টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন বাহিনী প্রধান ও পুলিশের আইজিপি কে ডেকে আরও বেশি কঠোর হওয়া নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁরা পরামর্শ দেন শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ ও দেশ ত্যাগ করার। কারণ পরিস্থিতি তখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেনাপ্রধান ৪৫ মিনিট বেঁধে দেন শেখ হাসিনাকে লাগেজ গুছিয়ে দেশ ত্যাগ করার জন্য। যাওয়ার আগে তিনি একটি বক্তব্য রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন।কিন্তু সে সুযোগ পাননি। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দর থেকে সেনাবাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে পালিয়ে যান দেশ থেকে।
দুপুর ৩ টায় সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবর নিশ্চিত করেন।
১৬ বছর জেঁকে বসা এক ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন উল্লাসে রাস্তায় নেমে পড়েন সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। কেউ কেউ লুটিয়ে পড়েন সিজদায়। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় বের হয় আনন্দ মিছিল।

সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে জমে ছিল জনরোষ। জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ, রাজনৈতিক দলগুলোর উপর অত্যাচার-দমন নীতি ,দুর্নীতি, লুটপাট,দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি ,সরকারি দলের অত্যাচার- চাঁদাবাজি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সরকার ও সরকারি ব্যক্তিদের অহংকার ও দাম্ভিকতার ফলে জনমনে তৈরি হয়েছিল ক্ষোভের বারুদ। চলমান ছাত্র আন্দোলন সেই বারুদে লাগিয়ে দেয় আগুন।
★বিবিসির বিশ্লেষণেও এমনটি বলা হয়েছে,”ব্যাপক দুর্নীতি,ক্ষমতার অপব্যবহার, যেকোনো সমালোচককেই প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা—এসব কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সরকারের সেটি দেখতে না পারাটা শুধু দাম্ভিকতারই ইঙ্গিত দেয়।
কোনো রাষ্ট্র প্রধানকে তখনই ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগ করতে হয়, যখন তাঁর সেই ক্ষমতা শুধু ক্ষমতাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, এর পেছনে জনসমর্থন থাকে না।”
★আর ইতিহাস সাক্ষী ছাত্রদের বুকে যখন কোন স্বৈরশাসক গুলি চালায় তখন থেকে তার পতনের দিন গণনা শুরু হয়।এভাবে Gen-Z দের বুকের তাজা রক্ত ও আসমানী সাহায্যে পতন হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় স্বৈরশাসকের, উদিত হয় স্বাধীনতার নতুন সূর্য।

আবারো প্রমাণিত হয় কোরআন ও হাদিসের সেই বাণী---
★আল্লাহর হুকুমে কত ছোট দল বড় দলকে পরাজিত করেছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই রয়েছেন।
---( সূরা বাক্বারা - ২৪৯)
★আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব।
--- (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯৮)

আমরা সবাই জানি স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা বেশি কঠিন। বর্তমান পরিস্থিতিতে যে বিষয়টা মনে হচ্ছে তা হলো, যে প্রয়োজনে আমরা এক হয়েছি সেটা কিছুটা অর্জিত হলেও শেষ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি। এখনো অনেক বন্ধুর পথ বাকি।এত রক্তের মধ্য দিয়ে যে পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা এনেছেন, এখন মূল বিষয় খেয়াল রেখে বিভেদ দূর করা ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।

★আসলে শয়তান মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে শয়তান হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। ---( সূরা বনী ইসরাইল:৫৩)

★শত্রুরা শত্রুতা করতে কৌশলে ব্যর্থ হলে তারপর বন্ধুত্বের সুরত ধরে।
---(হযরত আলী রা:)

★একতা এত শক্তিশালী যে এর আলো দিয়ে পুরো পৃথিবী আলোকিত করা সম্ভব।
— (বাহাউল্লাহ)

★একতায় কঠোর থেকে কঠোরতর ভাংগন ও মোকাবেলা করা যায়।
— (মহাত্মা গান্ধী)

মনে রাখতে হবে,
★"শত্রু মরে গেলে আনন্দিত হবার কারন নেই। শত্রু সৃষ্টির কারণগুলো এখনও মরেনি।"(ওল পিয়ার্ট)

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকটে আকুল আবেদন, তিনি যেন গোটা দেশবাসীর উপরে রহম করেন, দেশ ও বিদেশের সকল ষড়যন্ত্র থেকে হেফাজত করেন, ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক এক সুন্দর সমাজ দান করেন। বর্তমানে যারা দেশের দায়িত্ব পালন করছেন তাঁদেরকে ইনসাফ ও সত্যের উপরে অটল থাকার তৌফিক দিন। নতুন স্বাধীনতা অর্জনে যারা যেভাবে ভূমিকা রেখেছেন সবাইকে তিনি দুনিয়া ও আখিরাতে যোগ্য মর্যাদা ও প্রতিদান দিন। আমীন।

★তথ্য সূত্র:
১)BV News 24
২)কালের কণ্ঠ ই পেপার।

১৮/০৮/২০২৪


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)