মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ

চব্বিশের বাংলার জুলাই বিপ্লবের রক্তাভ সময়েরা: সুমাইয়্যা সিদ্দিকা

চব্বিশের বাংলার জুলাই বিপ্লবের রক্তাভ সময়েরা: সুমাইয়্যা সিদ্দিকা

 

“তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!
কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!”

৫ জুন’ ২০২৪ । শ্লোগানে শ্লোগানে উত্তাল বাংলাদেশ। এ দিনে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। প্রতিবাদী শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে অলিগলি, রাজপথ।

৭ জুলাই ছাত্ররা “বাংলা ব্লকেড” এর ডাক দেয়ায় ঢাকা শহর স্থবির হয়ে যায়। ঢাকার সাথে সাথে দেশের সর্বত্রই ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করে।
১৬ জুলাই সরকার ছাত্রদের দমাতে সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল খালি করতে বলে।
পাশাপাশি ছয়টি জেলায় বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) মোতায়েন করে। এদিন পুলিশ রংপুরে দু’হাত শূণ্যে ছড়িয়ে বুক টান করে প্রতিবাদরত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বুকে গুলি চালায়। তাজা রক্তে ভেসে যায় রাজপথ।
এ অন্যায় হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা। প্রাণের মায়া ছেড়ে দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণা দেয় তারা।
শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী মনোভাবে দিশেহারা সরকার। আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশের পাশাপাশি সরকার তার রাজনৈতিক গুন্ডা বাহিনীকে লেলিয়ে দেয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর।
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের আদেশে নির্বিচারে নিরীহ ছাত্রদের উপর চলে গুলি বর্ষণ। এমনকি আন্দোলনকারীদের পানি খাওয়াতে গিয়ে গুলি বিদ্ধ হয়ে রাজপথে ঢলে পড়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুগ্ধ।

স্বৈরাচারী সরকারের পেটোয়া বাহিনী যাকে যেখানেই পায় নির্বিচারে গুলি করে। ফলে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী নির্বিচারে গুলি বর্ষণে আন্দোলনকারী ছাড়াও মসজিদের নামাজ থেকে বের হতে গিয়ে, বাসার নিচে নামতে গিয়ে, রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করতে গিয়ে, বাসার ছাদে খেলতে গিয়ে, আইসক্রিম কিনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়।
ফলে আন্দোলনে অংশ নেয়নি এমন ছেলে, মেয়ে, শিশু এবং বৃদ্ধও মৃত্যুবরণ করেন। এমনকি ছাদ থেকে ও হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণের ফলে নিজ ঘরে, বেলকনিতে, ছাদে থেকেও গুলিতে শহীদ ও আহত হয় নারী ও শিশুরা।
সরকারের সহিংস আচরণের কারণে জুলাইয়ের তিন সপ্তাহের মাঝেই শত শত নিরস্ত্র নাগরিক শহীদ হয়ে যায়। যাদের মাঝে শিশু, নারী, শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য সাধারণ জনতা রয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত বিক্ষোভ ও পরবর্তী সহিংসতায় কমপক্ষে ৬৫০ জন নিহত হয়েছেন।
যদিও বেসরকারী পরিসংখ্যানে এ সংখ্যাকে হাজারের ওপরে বলে দাবী করা হয়েছে। এমনকি অনেক লাশের প্রকৃত পরিচয়ও উদঘাটন নিহতদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে শিশু, কিশোর এবং বাচ্চাদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি এবং হত্যাকাণ্ড বেশি ঘটানো হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ১১৩ জনই হলেন শিশু, শতকরা যা ৭৫ শতাংশ।
সরকারের এ বেপরোয়া গণহত্যার ফলে সময়ের ব্যবধানে কোটা আন্দোলন পরিণত হয় স্বৈরাচারী খেদাও আন্দোলনে।
সরকারী, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, হিফজখানাসহ সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দাবী আদায়ে মাথায় লাল কাপড় বেঁধে নেমে আসে রাজপথে। অফলাইন ও অনলাইন সর্বত্রই ওঠে তুমুল প্রতিবাদের ঝড়।
৪ আগস্ট শিক্ষার্থীরা এক দফা এক দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়ে সরকার আরেক কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। সরকারের নির্দেশে মোবাইল অপারেটররা দেশজুড়ে ফোর-জি নেটওয়ার্ক সেবা বন্ধ রাখে।
৫ আগস্ট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বেলা বন্ধ রাখা হয়। সারাদেশের ইন্টারনেট শাট ডাউন করে আন্দোলনকারীদের বিচ্ছিন্ন করার অপকৌশল চালায়। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়। সাথে কারফিউও জারী রাখে সরকার।
তবে ইন্টারেনেট বন্ধ করা সরকারের জন্য বুমেরাং হয়। আর আন্দোলনকারীদের জন্য শাপে বর হয়ে ধরা দেয়। ইন্টারনেট চালু হতেই আন্দোলনকারীদের প্রতি সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পরে সর্বত্র।
ফলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতা ব্যানারে একাত্ম হয়ে পথে নেমে আসেন অভিভাবকেরা। এমনকি শিক্ষার্থীদের প্রতি এমন স্বৈরাচারী মনোভাবের জন্য শিক্ষক সমাজ, রিকশাওয়ালা, চাকুরিজীবি, গ্যামেন্টস কর্মী খেটে খাওয়া সকল পেশার নারী-পুরুষ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে।
সময়ের পট পরিবর্তনে জুনে শুরু হওয়া কোটা বিরোধী আন্দোলন জুলাইয়ের শুরুতেই গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়।

এক মাসের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিণত হয়ে গণবিক্ষোভে। যার ফলে দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরাচার শাসকের যুলুমের প্রাসাদ তাসের ঘরের মত ধুলায় লুটিয়ে পড়ে।

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার দলের দুঃশাসনময় কালিগোলা অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলোর সমাপ্তি হয়। জালিম সরকারের কবল থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশে ১৭ কোটি মযলুম মানুষ।

আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ইয়ামিন, ফারহান, রাহাত, ইফতি, নাঈমা, ফারুক, ওয়াসিম, শান্ত, প্রিয়, রিয়াদ,জাফর, শাহজাহান, সিয়াম, দিপ্ত, দুলাল, সুমাইয়া, রিয়া সহ নাম জানা-অজানা আরো হাজারো তরুণ-জনতার রক্তের বিনিময়ে বাংলার জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। শহীদের তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন তৈরী করছে আর্কাইভ।
এই শহীদেরা আমাদের সম্পদ। যাদের রক্তের বিনিময়ে নিপাত হয়েছে স্বৈরাচারী।

এ বিজয় মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার! এ বিজয় মেধার! এ বিজয় আগামী দিনে দুঃসাহসী প্রজন্মের। আমাদের এখন একটাই চাওয়া, আমরা আর কোন আয়না ঘর চাই না। চাই না আর কোন স্বৈরশাসন।

আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছাত্র-জনতার হাত ধরে এদেশের খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে সকল পেশার ও সকল বয়সের মানুষ ফিরে পাবে তাদের বাঁচার অধিকার।
প্রতিষ্ঠিত্ব হবে একটি সামাজিক সুবিচারপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার। মেধাভিত্তিক উন্নত বাংলাদেশের।
আমাদের হৃদয় জুড়ে এখন এই একটাই চাওয়া। আর পেছন ফিরে তাকানোর সময় নেই। নেই বসে থাকার সময়।
আমাদের হাতে এখন অনেক কাজ। আহতদের চিকিৎসা করা, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। শহীদ পরিবারগুলোকে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে সহযোগিতা করা।
তাইতো সকল মতপার্থক্য ভুলে নেমে আসতে হবে একটি সুন্দর স্বাভাবিক সামাজিক সুবিচারপূর্ণ দেশ গঠনে।
তবেই ইনশাল্লাহ আমাদের শহীদদের অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ হবে।

তথ্যসূত্র: সোশ্যাল মিডিয়া, জাতীয় ও দৈনিক পত্রিকাসমূহ


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)