সাহিত্য

মুকু

মুকু
nnn   ছাতাটার লোহার শিকগুলো আছে শুধু এখন। উত্তরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা। বাবা-র ছাতা ছিল এটা,সিলেট থেকে আনা। সারা দেয়াল জুড়ে ধূসর তুলি বুলিয়ে গেছে কোনো চিত্রকর। এক দুই তিন ...চারটা টিনের পট। কালো হয়ে আছে, নিশ্চিহ্ন হয় নি তবু তার অন্য প্রতিবেশীদের মত। একটি মসৃন হাতের পরম যত্নে সাজানো ছিল এই ছোট্ট ঘর। একটা ধূসর রান্নাঘর। আমি দাঁড়িয়ে আছি। মধ্য দুপুর। সেদিনও মধ্য দুপুর বাইরে, ভেতরে আধো আধো আলো। –বাহ! তুমি বেশ সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করো সাইফ! 'প্রকৃতি' শব্দটার সঠিক উচ্চারণ অনেকদিন পর শুনলাম , সবাই বলে প্রক্রিতি, তাই না? তারপর বাংলা উচ্চরণ নিয়ে আরো কি কি যেন বলছিলো পাশে দাঁড়ানো কয়েকজনকে। এই প্রথম আমার সাথে কথা বললো মেয়েটা। কোনমতে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে পালিয়ে এলাম বারান্দায়। আশ্চর্য! ওর সামান্য এটুকু কথাতেই আমার এমন লাগলো! কে যেন একজন কবিতায় লিখেছিলেন, একরাশ কাঁচের চুড়ি ভেঙে পড়লো যেন! তিনি কি এই মেয়েটার কন্ঠ শুনেছিলেন? আর সি মজুমদার অডিটোরিয়ামের আলো-ছায়া। আমাদের অনুষ্ঠান ছিলো সেদিন। বাসার পথে রওনা হয়েছি বন্ধুদের কিছু না বলেই, সারাটা পথ কানে বাজছিলো শুধু কাঁচ ভাঙার শব্দ… রিনঝিন রিনঝিন…রিনিঝিনি। এক ক্লাসে পড়লেও কথা হত না আমাদের তেমন। মুকু চুপচাপ ধরণের মেয়ে, সাদা সুতোর কাজ করা একটা স্কার্ফ ছিলো ওর সবচেয়ে প্রিয়। ভোরে ক্লাস খোলার আগেই চলে আসতাম আমরা কেউ কেউ। সাদার ওপর রোদের আলো এসে পড়লে কেমন পবিত্র লাগতো চারিধার,একটা আলোকিত আভা ছড়িয়ে যেত বারান্দায়। এত সুন্দর লাগতো তখন তাকে।  ওটা ওর ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য, খালি চোখে একটা সাদামাটা মেয়ে ছাড়া আর কিছুই না! একবারের বেশি তাকাতাম-ই না,যদি মুকু দেখে ফেলে! প্রথম দিন থেকেই এত ভালো লাগত কেন ওকে, জানি না। আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যাফেটেরিয়াতে আলাপও করি নি কোনদিন বরং সামনা সামনি দেখা হলে চোখ নামিয়ে চলে গেছি দু’দিকে দুজনই। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে মুকু বললো, –জানো? আমার পুরোনো বাড়ী খুব ভালো লাগে,প্রাচীন স্থাপত্য। লাল ইটে বাঁধানো বারান্দা। পাহাড়ী ঝরণার ধারে কিংবা টলমল পুকুর পাড়ে একটা বাড়ী থাকলে ভালো হয় না? কাঠের সিঁড়ি থাকবে…ছায়া ছায়া আঙিণা। অনেক গাছ। বারান্দায় দু’টা বেতের চেয়ার থাকবে। সেখানে বিকালে বসবো আমরা। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। এটা তো অনেক পরের কথা! তখন তো সবকিছু বদলে গিয়েছে! তারও আগে অনেক গল্প আছে। সেমিনারের দিকে যাচ্ছিলো সে। –মুকু,একটু দাঁড়াও। আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই, তোমার সময় হবে? –হুঁ, বলো। একটু হেসে ও তাকালো আমার দিকে। আমি যত কথা সারারাত ধরে গুছিয়ে নিয়েছি, সব এলোমেলো হয়ে গেল মুহূর্তেই। বলার কথা ছিলো প্রথমে, "চলো কোথাও গিয়ে বসি।" হড়বড় করে বলে ফেললাম, -তুমি অনন্তকাল আমার সাথে থাকতে পারবে মুকু, আমার পাশে? সাথে সাথে এক তীব্র লজ্জা ঘিরে ধরলো আমাকে। চোখ তুলে তাকাতেও পারছিলাম না। অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলাম আমরা। - তুমি আমাকে কতটুকু চেনো সাইফ? - একজন ক্লাসমেটকে যতটুকু চেনা যায়। - তাহলে? - আমার মনে হয় মুকু আমার তোমাকে খুব দরকার! - দেখো, তোমাকে যদ্দুর জানি তুমি বোকা কিংবা বাজে ছেলে নও! ঝোঁকের বশে কোনো ইমম্যাচিওর কাজ করে বোসো না। - না, ঝোঁকের বশে না। আমি অনেকদিন ভেবেছি। একা আমি খুব অপূর্ণ। তুমি পাশে থাকলে সংকুল পথেও আমি হেঁটে যেতে পারবো নির্ভয়ে। বলেছি আরো অনেক কথা। অমন একটা সময়ে শান্ত স্বরে কীভাবে অত কথা বলেছিলাম এটাই আশ্চর্য। সব শুনে  মুকু খুব মৃদুস্বরে বললো, "আমার আব্বুর সাথে কথা বলো সাইফ। আমাকে আর কিছু বলো না।" মুকু সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। বাসায় বাবা-মাকে বলেছি মুকুর কথা। সাথে সাথে প্রবল আপত্তির সুনামী আমাকে ঘিরে ধরলো। "ফাজলামী নাকি? সমবয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে?" কোনভাবেই মানতে চাইলো না মা। তাছাড়া আমার পড়াশুনা শেষ হয় নি, এখনই বিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে, তাঁদের ধারণায়। চিরকালের মুখচোরা আমিও চুপ থাকতে পারি নি সেদিন। বলেছি, "আমি ত চাই নি স্রোতের তোড়ে ভেসে যেতে, আমি ত চেয়েছি কেবল জীবনসাথী করেই ভালোবাসতে।" মুকুর বাসায়ও বিরাট ঝড় উঠেছিলো যেদিন আব্বুআম্মু ওদের বাসায় গেলো।  দুইজোড়া আব্বু আম্মু চা খান নাশতা খান আর চশমা চোখে পরিকল্পণা করেন 'কান্ডজ্ঞানহীন' 'ইমোশনাল' 'অদূরদর্শী' পাগল দুইটাকে বোঝাতে হবে। শেষপর্যন্ত যুক্তির কাছে হার মানলেন ওঁরা। আমরা বিয়ে করি। চার বছর আগেকার কথা সেসব। আমার জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেল তারপর। বন্ধু-বান্ধবরা খুব অবাক হয়েছিলো প্রথমে! হঠাৎ করে ছেলে-মেয়ে দুটা কী কান্ড ঘটিয়ে বসলো, আরে তোরা প্রেম করতে পারতি, কথা নেই বার্তা নেই বিয়ে করে বসলি! ইয়াব্বড় একটা গিফট দিয়েছিলো ওরা "টোনাটুনির সুখী জীবনের কামনায়"।  আমি আর মুকু খুব স্বাভাবিক ভাব নিয়ে ক্যাম্পাসে যেতাম। ফাইনাল পরীক্ষার পর ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান করে ক'ণেকে বাড়ি নিয়ে আসা হলো।  পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা অবিরাম ঝরণাধারার কুল কুল শব্দের মত বয়ে যেতে লাগলো। আব্বুম্মুর সাথে খুব ভাব হয়ে গেল মুকুর। মা-র আদরের ভাগ নিয়ে টক-ঝাল ঝগড়াও কম হত না আমাদের। দু’মাস আগে চলে এলো পরম আকাঙ্ক্ষিত আরেক অতিথি। আমাদের ছোট্ট আমায়া। গতকাল শুক্রবার। ভোরবেলা। ফজরের সালাত পড়ে একটু ঘুমুতে ইচ্ছে করছিলো। বাবা গ্রামের বাড়ী গেছেন। মা তাঁর ঘরে কুরআন পড়ছেন।  আমায়া ঘুমুচ্ছিলো। গোলাপি কম্বল গায়ে। –আসসালামু আলাইকুম জনাব! আপনার ঘুম কি রাতে ভালো হয় নি? –উঁহুঁ। লেপের নিচ থেকে জবাব দিলাম আমি, “শুক্রবার ভোরবেলাটাও ঘুমাতে দিবা না?” –অ্যাই! ওঠো এক্ষুণি! লেপ সরিয়ে কপট রাগের ভঙ্গি করে বলল ও। “পাঁচ মিনিট সময় দিলাম! এর মধ্যে না উঠলে চা পাবা না। আমি গেলাম!” তারপর মুকু কী কী করেছিলো কল্পণা করতে পারি। ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। জানালা তখনো বন্ধ। ছোট পাতিলটা ধুয়ে নিলো ও, পানি ঢেলে বসিয়ে দিল চুলায়। ম্যাচের কাঠিটা জ্বালালো। আর… গ্যাসের পাইপটা ফেটে গিয়েছিলো। নীল রঙা তীব্র আগুন এসে জড়িয়ে ধরেছে মুকুকে, এক মুহূর্তও সময় দিল না। এক লহমায় পুরো রান্নাঘরে ছড়িয়ে পড়লো আগুন। মুকু চিৎকার করে দৌড়ে- আমি আর কল্পণা করতে পারি না। আজ দ্বিতীয় দিন। হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে মুকু। নিষ্ঠুর চিত্রকর আমার মুকুকে রেহাই দেয় নি কিছুতেই। এঁকে রেখে গেছে দেয়ালে দেয়ালে, মেঝেতে তার বিজয়ের গল্প,আমার হৃদয়ের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েও ক্যানভাস বানিয়েছে সে। গলার ভেতর যেন কিছু একটা আটকে আছে মনে হচ্ছে। ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে সাদা পাঞ্জাবী। অসহায় লাগছে আমার, বিন্দুমাত্র শক্তি নেই আর দাঁড়িয়ে থাকার। সমস্ত কিছু কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। সুররিয়ালিস্টিক জগতে আছি যেন মনে হচ্ছে সবকিছু। আমি হাঁটু মুড়ে বসি। সাদা পোশাকে লেগে যাচ্ছে কালো কালো ছোপ। ওরা আমাকে দেখতে দেবে না শেষবারের মত মুকুর মুখটা, বলেছে আমি আর সহ্য করতে পারবো না। ওরা এখন প্রতীক্ষায়…কখন শেষ সংবাদটি পাবে… স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে সবাই, অন্তত অমানুষিক কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে আমার মুকু। আমি কীসের অপেক্ষায়? আমি কী বলবো, কষ্ট থেকে মুক্তি দাও তুমি মুকুকে হে করুণাময়! মুকুকে তুমি তোমার শান্তির উদ্যানে আশ্রয় দাও। এটা হতে পারে একটা স্বপ্ন।  হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখতে পাবো আমাদের ছোট্ট মা-টা চুপচাপ ঘুমিয়ে। ওঘর থেকে আম্মুর তিলাওয়াত ভেসে আসছে। মুকু চা বানাচ্ছে রান্নাঘরে, মুকু্র কাছে যাবো, হাতটা স্পর্শ করে বলবো, "একটা স্বপ্ন দেখেছি মুকু, দুঃস্বপ্ন!"

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)