বিবিধ

শেষ বিকালের বৃষ্টি

শেষ বিকালের বৃষ্টি
  মে মাসের শেষ দিকটা সবসময়ই দৌড়ের উপরে থাকতে হয় সেমিস্টার সিস্টেম এ পড়ুয়া ছাত্রদের। আম্মু যখন হসপিটালে ভর্তি হয় সেটা মে মাসের প্রথম দিন।   এই assignment ঐ class test করতে করতে , আর ছোট ভাইটা সহ সংসার সামলাতে সামলাতে জীবনের বাস্তবতায় আমি দিশেহারা । আম্মু কতবার ফোন করেছে যেতে কিন্তু শত চেষ্টায় ও সময় করতে পারছিলামনা ।   অবশেষে ৭ তারিখ management assignment জমা দিয়ে ভার্সিটি থেকে যাওয়ার চিন্তা করলাম। আম্মুকে ফোন করলাম কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতে ।   তার একটাই আবদার ছিল, ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে যেতে। বরফ নিলেই কি হসপিটালে যেতে যেতে থাকবে? আম্মু খুব চাচ্ছিল, পরে আবার না করলো আমার কষ্টের কথা ভেবে। আমি জানতাম বরফ নিতে নিতে গলে যাবে তবুও  অনেক গুলো কাপড় পেঁচিয়ে বরফ নিয়ে নিলাম। ৮ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত ক্লাস শেষ করে কলাভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম শুভর জন্য, একটা assignment এর গ্রুপ discussion হওয়ার কথা।   আমার মন ওসব কিছুতেই ছিলনা। মন পরে ছিল হসপিটালে, তাই তো বারবার গ্রুপের বাকি মেম্বারদের তারা দিচ্ছিলাম। কিন্তু শুভ আসছিলই না। ওদিকে যত সময় যায় সাথে আনা  বরফটাও গলে যাচ্ছে আশংকা হচ্ছিল।   এমন সময় হসপিটাল থেকে ফোন আসলো -আমাকে ছোট বোন বলল হল থেকে তরকারি কিনে নিয়ে যেতে। দৌড়ে রোকেয়া হল এ গেলাম। কিন্তু তরকারি নেওয়ার বাটি কৈ ? এদিক ওদিক ছুটছিলাম । পরে এক বড় আপুকে কল করলাম। উনি ওনার রোকেয়া হলের এক বন্ধুকে বললেন বাটি দিতে। বাটি পেলাম, আর ক্যান্টিন থেকে আম্মুর পছন্দের খাবারগুলো কিনলাম।   যাওয়ার সময় হাকিম চত্বর থেকে আম্মুর পছন্দের মাশরুম চপ কিনলাম। ভার্সিটির বাস এ করে কল্যাণপুর ইবনে সিনায় গেলাম।   ৬০৩ নম্বর রুমে যেয়ে দেখি আম্মু একা বসে আছে। আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল- এতদিনে সময় হলে মাকে দেখতে আসার? আমি আম্মুকে বরফটা বের করে দিলাম । ততক্ষণে একগ্লাস বরফ গলে ১ আঙ্গুল পরিমান ছিল।সেটা পেয়ে আম্মু এমন খুশি হোল তা দেখার মতো ছিল। খুব তৃপ্তি সহকারে বরফটা এক নিমিষেই শেষ করলো।   আমাকে বলল- হসপিটাল যে এতো কষ্টের জানলে কোনদিন আসতাম না। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? আম্মু বলল- ৪জন intern কে doctor আমার উপর practical করিয়েছে। এক বারের জায়গায় ৫বার injection পুশ করেও যখন কাজ হয়নি পরে সিনিয়র ডাক্তার এসে করলো। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, আম্মুর পেট থেকে রক্ত বের হচ্ছে অল্প অল্প সেই রক্ত floor এও পরেছে।   আম্মু আমাকে কত কিছু খেতে যে সাধল! আমি আম্মুকে আমার আনা খাবার বেড়ে দিলাম।   খেয়ে খুব মজা পাচ্ছিলো । জিজ্ঞেস করলাম তোমার ভালো লেগেছে আম্মু? আম্মু বলল- আমি বাসায় গেলে তুই মাঝে মাঝে নিয়ে আসিস হলের খাবার, সেদিন রান্না করবনা। আমি বললাম- ঠিক আছে।   এভাবে কথায় কথায় দুপুর পেরিয়ে বিকাল শেষ হয়ে গেলো ।   আম্মু বারবার বলছিল আজ তুই থেকে যা। এখান থেকে অনেক সুন্দর চাঁদ দেখা যায় , ঐ জানালার সামনে দাঁড়ালে কি সুন্দর বাতাস!   আমি বললাম- আম্মু থাকা যে যাবেনা! আমার tuitiony আছে যে, যেতেই হবে। তবুও বারবার অনুরধ করছিল। আমার ও মন চাইছিল না যেতে। তবুও যেতে তো হবেই। যাওয়ার সময় আম্মু ঘুমিয়ে ছিল। আমি আম্মুকে ডেকে বললাম- আম্মু আমি যাই , আম্মু করুণ চোখে তাকাল- এতো তাড়াতাড়ি মাকে দেখা শেষ হয়ে গেলো মা? আমি আর থাকতে পারলাম্না। যেতে যেতে বাসে অজান্তেই চোখ ভেসে যাচ্ছিলো । কেন যেন মনে হচ্ছিল খুব খারাপ কিছু হবে আমার মায়ের। আমি চলে আসার পরে আম্মু আদিবাকে বারবার বলছিল- আমি শুধু সাফওায়ানাকে দেখছি আমার কেবিনে হাঁটছে, কথা বলছে। কত বললাম মেয়েটাকে থেকে যেতে থাকল না। এই দিন টাই ছিল এই জনমে মায়ের সাথে আমার শেষ দেখা। মায়ের গলা জড়িয়ে শেষ একটি রাত কাটানো আর হয়নি। পরদিন আমার মা লাশ হয়ে ফিরে এসেছিল। তবুও তুমি আছো জীবনের প্রতিটি দিনপঞ্জি জুড়ে । তোমাকে অনেক ভালবাসি।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ