সাহিত্য

প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে আছে শিক্ষা...

প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে আছে শিক্ষা...
পুত্রকে নিয়ে একটা কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল কয়েকদিন আগে। যেখানে গিয়েছিলাম খুবই নোংরা ছিল এলাকাটা। নাক কুঁচকে বোরখা কিছুটা উঁচু করে ফেলছিলাম প্রতিটা কদম। হঠাৎ চোখ চলে গেলো ডাস্টবিনের পাশে খোলা জায়গাতে। দেখলাম সবুজ ঘাসে ছেয়ে আছে পুরো জায়গাটা। তার মাঝে উঁকি দিচ্ছে হলদে রঙের ফুল। তাকিয়ে ছিলাম মুগ্ধ চোখে অনেকটা ক্ষণ। খেয়াল না করলে দেখাই মিলতো না এই সৌন্দর্যের।  পরক্ষণেই মনে পড়লো কয়েকজন স্টুডেন্টের কথা। যারা সারাক্ষণ নিজেদের নানান দোষের কথা বলে আহাজারি করতে থাকে। তাদেরকে দিয়ে কিছুই হবে না এই আক্ষেপ করে। মনে পড়লো পরিচিত কয়েকজনের কথা। যাদের মুখে নিজেদের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা আর অপ্রাপ্তির ছাড়া আর কোন কথাই শোনা যায় না। মনেহলো শত দোষের ভিড়ে কিছু গুণও তো থাকে, দুঃখ-কষ্ট-বেদনার মাঝেও থাকে ছোট্ট ছোট সুখ ও আনন্দ। আসলে বেখেয়ালে আমরা অবমূল্যায়ন করি নিজের অনেক প্রাপ্তি আর অনেক গুণকে। চাই চাই আর নাই নাই করতে করতে নিজের কি আছে সেটাই তাকিয়ে দেখতে ভুলে যাই। অন্যের সুখের হিসাব রাখতে গিয়ে নিজের সুখগুলো গুণে দেখার কথা মনেই থাকে না। অথচ যদি সন্তোষ ভরা দৃষ্টিতে তাকানো যায় নিজের দিকে তাহলে এত নেয়ামতের দেখা মেলে যে অজান্তেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে আলহামদুলিল্লাহ। আরেকটা উপলব্ধি নিজেকে ঘিরেও হলো। ইউরোপের এই অনৈসলামিক পরিবেশ মুসলিমদের জন্য অনেকটা আবর্জনার মতোই তো। তাই এখানে যারা ইসলামকে আঁকড়ে ধরে আছে প্রাণপণে তারা কি অনেকটা আবর্জনার বুকে ফুটে থাকা ঘাসফুলের মতো না?! হ্যা তারা হয়তো এমন আবর্জনার মধ্যে ফুটে থাকা ঘাসফুলের মতই পথ চলতে থাকা কারো মনে মুগ্ধতায় ছেয়ে দিয়ে পারে যদি নিজেদেরকে ইসলামের আলোকে আলোকিত করতে পারে প্রকৃত অর্থে।  পুত্রকে কথাটা বলতেই চোখ বড় বড় করে একবার আমার দিকে আরেকবার ঘাসফুলের দিকে তাকালো। নয় বছর বয়সি একটি বাচ্চার জন্য বিষয়টা একটু কঠিন জানি কিন্তু এমন চমৎকার ও বাস্তব একটি শিক্ষা থেকে ওকে বঞ্চিত করতে চাইনি। তাই সাধ্যমতো বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করলাম। কতটুকু বুঝলো জানি না তবে কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো চারপাশের পরিবেশ। অতঃপর ঘোষণা দিলো সেও এই ঘাসফুলের মত হতে চায়।  আবর্জনার বুকে ফুটে থাকা ঘাসফুল সূরা রা’দ এর তাফসীরে পড়েছিলাম-“ আল্লাহর বাণী প্রকৃতির মাঝে লেখা আছে। ফুল, নদী, আকাশ, তারা, এদের মধ্যে দিয়ে আল্লাহর হাতের পরশ অনুভুত হয়।প্রকৃতিকে তাই ভালবাসতে হবে অনুভবের মাধ্যমে। প্রকৃতিকে ভালবেসে সেই প্রকৃতিরই সাহায্যে প্রকৃতির স্রষ্টা সেই মহান শক্তির কাছে পৌছানোর চেষ্টা করতে হবে। চোখ খুলে তাঁকে দেখতে হবে,মন দিয়ে তাঁকে অনুভব করতে হবে। স্রষ্টাকে দেখা যায় না, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করে নিরাকার স্রষ্টাকে হৃদয়ের মাঝে অনুধাবন করা যায়। আকাশে বাতাসে বিশ্বভুবনে তাঁর সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার হাতের পরশ বিদ্যমান।”  আল্লাহ বলেছেন চিন্তাশীলদের জন্য প্রকৃতির মাঝে নিদর্শন নিহিত রয়েছে। তাই নিজে যেমন প্রকৃতিকে ভালোবেসে অনুধাবন করার চেষ্টা করি, তেমনি আমাদের বাচ্চাদেরকেও উৎসাহিত করি। আপ্রাণ চেষ্টা করি ছোট থেকে ছোট বিষয়ের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। শুধু বিস্ময় আর শিক্ষাই নয় প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে আছে আনন্দের নানা উপকরণ। যা উৎস হতে পারে নির্মল বিনোদনের। তাই বাচ্চাদের সামনে পথ তৈরি করে দেবার চেষ্টা করি যাতে প্রকৃতির ভেতর থেকে শিক্ষা ও আনন্দ খুঁজে নিতে পারে। এবং সেই সাথে চিন্তা ও অনুধাবনের মাধ্যমে মনকে সমৃদ্ধ করতে পারে।  এই উদ্দেশ্যে প্রায়ই বাচ্চাদেরকে নিয়ে প্রকৃতি ভ্রমণে বের হয়ে যাই। গত পরশু যেখানে গিয়েছিলাম পুরোটা জায়গাটা ছিল ফূলে ফুলে ফুলারন্য। এক কথায় ঘাসফুলের রাজ্যে। সবুজ ঘাসের বুকে লাল, হলুদ, সাদা, বেগুনী রঙের ফুল চারিদিকে ভালোলাগার বীজ বুনে দিয়েছে যেন। আর ভালোলাগা গুলো স্বভাবে একদম লজ্জাবতী লতার উল্টো। মানে হচ্ছে লজ্জাবতী লতা যেমন স্পর্শ পেলেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়, এর ঠিক উল্টো। অর্থাৎ দৃষ্টির স্পর্শ পেলেই ভালোলাগার আবেশ মনের মাঝে নিজেকে ছড়িয়ে দেয়। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম প্রকৃতির এই বর্ণিল সৌন্দর্য। হঠাৎ চোখে পড়লো বেগুনি ফুলে ছেয়ে যাওয়া একটি গাছ। এত সুন্দর ফুলগুলো যে কাছ থেকে দেখার জন্য এগিয়ে গেলাম। তখন চোখে পড়লো গাছটি গোঁড়া থেকে ভেঙ্গে একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। মনেহলো নিজের সৌন্দর্যে সবার মনে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে যে ফুল কাছে না এলে তো জানাই হতো না যে সে তার মূল থেকে ভেঙ্গে পড়েছে। মুগ্ধতা কেমন যেন এক নিমিষেই কমে গেলো। সেখানে জায়গা করে নিলো একরাশ দয়া ও মায়া।  মূল থেকে ভেঙ্গে পড়া গাছটি  একটা ভাবনা জায়গা করে নিলো মনে। জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথেই তো পরিচয় হয়েছে। ক’জনকেই বা আর কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে! বেশির ভাগ মানুষকেই তো দূর থেকেই চিনি, জানি এবং সেই আলোকেই তাদের একটা করে ছবি এঁকে নিয়েছি মনের ক্যানভাসে। প্রশ্ন জাগলো সেই ছবিগুলো সঠিক হবার সম্ভাবনা কতটুকু? নিজের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো মুখে। কত মন কত রূপে এঁকেছে আমার ছবি, নইতো আমি তার সবই...!দূর থেকে আসলেই বোঝা সম্ভব না কে মূলের সাথে সংযুক্ত আর কে বিচ্ছিন্ন!  আরেকটা উপলব্ধি হলো, এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের মনে নানান কষ্ট থাকার পরেও অন্যের মনে বিলিয়ে দিতে চেষ্টা করেন আনন্দধারা। আসলে যারা নিজ জীবনে কষ্ট পেয়েছে তারা জানে কষ্টের প্রচণ্ডতা। তাই অন্যেকে সাহায্য করতে চেষ্টা করেন কষ্টকে মোকাবেলা করতে। হতাশ না হয়ে আশা ধরে রাখতে। ঠিক এই ভেঙ্গে পড়া ফুল গাছটির মত। চলে যেতে যেতেও মানুষের মনে ছড়িয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্যের আবেশ জড়ানো মুগ্ধতা। আর এমনটাই তো আসলে উচিত। নিজের কষ্টগুলোকে অন্যেকের জন্য ফুলের রূপে বিকশিত করা... প্রকৃতির মাঝে লুকিয়ে আছে এমন হাজারো শিক্ষা। যা অনেককিছু বুঝতে, জানতে ও অনুধাবন করতে সহায়তা করে। তাই উচিত শিশুদেরকে প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাওয়া। প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে থাকা শিক্ষাগুলোকে খুঁজে নিজের মাঝে যাতে ধারণ করতে পারে সে ব্যাপারে সাহায্য করা। এরজন্য সবসময়ই যে দূরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে এমন কিন্তু না। কিছুটা সময় যদি আকাশও দেখা হয় শিশুদেরকে নিয়ে তাতেও বোঝানো যায় অনেককিছু। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, মেঘ, বৃষ্টি, রংধনু, চাঁদ, তারা, বিজলী চমক, ঝরে পড়া তারা, আকাশের রঙ আর মেঘেদের রূপ বদলের খেলা। এই প্রতিটির মাঝেই লুকিয়ে আছে কোন না কোন শিক্ষা।  বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে প্রকৃতির মাঝে ঘুরতে গিয়ে তোলা কিছু ছবি।  এই পথ ধরে হাঁটার সময় মনেহয় দেশের মেঠোপথে হাঁটছি...  রাস্তার পাশে শুকনো মাটির বুকে ফুটে থাকা ফুল।  কিভাবে এখানে ফুল ফুটলো সেটা নিয়ে বাচ্চাদের চলেছিল অনেক গবেষণা।  ঘাসফুল এই ফুলটির ঘ্রাণ অনেকটা হাসনাহেনার মত  ঘাসফুল কিছুদিন আগে আমাদের এখানে উঠেছিল আকাশ জোড়া রঙধনু । ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিলো। আকাশের একপাশ নীলে নীলে নীলাভ হয়ে ছিল। আরেকপাশ জুড়ে সাত রঙা আভা ছড়াচ্ছিল রঙধনু। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ভরে উঠেছিল মন! সুবহানআল্লাহ। 

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)