সাহিত্য

আলোকিত বাতায়ন....

আলোকিত বাতায়ন....
Image Not Found প্রতিটা সূর্যোদয় জীবনে নিয়ে আসে আশার নতুন কিরণ, জানান দেয় আঁধারের সাথেই করে আলো বিচরণ। মেঘ দেখে তাই ভয় পাবার নেই কারণ, দু'হাত প্রসারিত করে জীবনের সব রুপকে করতে হবে বরণ।’ মেঘে মেঘে ছেয়ে থাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এই শব্দগুলোই ভেসে এলো রিদার মনে। সূর্যোদয় দেখাটা একদম ছোটবেলার অভ্যাস রিদার। বাবার কাছ থেকে পেয়েছে এই অভ্যাসটা। অসুস্থতা বা খুব জরুরি কোন কারণ ছাড়া বাবা সূর্যোদয় দেখননি এমন কখনই হয়নি। রিদার অভ্যাসটাও ঠিক এমনটিই। কোন কারণে সূর্যোদয় দেখা না হলে দিনের শুরুটাকেই অসম্পূর্ণ মনেহয়। আজ যেমন ঘন কালো মেঘে ঢাকা পড়ে আছে আকাশপট। মেঘের এই পুরু চাদরের কারণে মনেহয় না সূর্যকিরণকে পৃথিবীর বুকে কদম ফেলতে দেখতে পাবে সে! দেখতে দেখতে পেড়িয়ে গেলো সূর্যোদয়ের সময় কিন্তু আকাশে বেদনার ভিড়ে নিজের স্থান করে নিতে পারলো না সূর্যকিরন। মনের বনভূমিতে সূর্যের কিরণ না পড়াতে কফিটা কেমন যেন বিস্বাদ লাগতে লাগলো রিদার কাছে। জোড় করে কফি শেষ করে রান্নাঘরে রওনা করলো ।  মাকে রান্নাঘরে না দেখে হাসি ফুটে উঠলো রিদার চেহারাতে। রুটিনে মেন্যু দেখে দ্রুত হাতে নাস্তা বানানোতে মন দিলো। নাস্তা বানাতে এসে মামণি যখন দেখবে নাস্তা বানানো হয়ে গিয়েছে অবাক হবার সাথে সাথে অনেক খুশিও হবেন। মাঝে মাঝে মামণিকে এমন আনন্দ দিতে ভীষণ ভালো লাগে রিদার। এটা মনোজগতে এক ধরণের আনন্দোদয়। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এমন কাজগুলো করলে আনন্দের ভান্ডারের সাথে সাথে দোয়ার ভান্ডারও সমৃদ্ধ হয়। বাবা সবসময় বলেন, দুনিয়াতে আমরা কেন এসেছি? পরীক্ষা দিয়ে সওয়াব অর্জন করতে। সুতরাং সারাক্ষণ সেই লক্ষ্য মনে রেখেই ফেলতে হবে চলার পথের প্রতিটি কদম। আর ইসলাম তো এত চমৎকার একটি জীবন ব্যবস্থা যেখানে কারো দিকে হাসি মুখে তাকানোও সাদাকা। সওয়াব অর্জনের কোন একটি সুযোগও যেন হেলায় না হারিয়ে যায় সে ব্যাপারে বাবাকে দেখেই সচেষ্ট হতে শিখেছে রিদা। আপ্রাণ চেষ্টা করে পরিবার, আত্নীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদেরকে ছোট ছোট নির্মল আনন্দ দিতে। সবার ভালোবাসা ও দোয়া কুড়িয়ে নিতে। সবার জন্য নাস্তা বানানো শেষ করে চা বানিয়ে বাবার সন্ধানে রওনা করলো রিদা। জানা আছে তার এই সময় বাবা লাইব্রেরিতে বসে জ্ঞান নামক আলোকে স্নাত হচ্ছেন।  রিদাকে দেখে বিশাল হাসি দিয়ে নেয়াজ সাহেব বললেন, রিদা মা আমি তোর অপেক্ষাই করছিলাম। আয় আয় আমার কাছে এসে বোস। শোন একটা পরিকল্পনা নিয়েছি।  রিদা বাবার পাশে গিয়ে বসে বলল, আবার কি পরিকল্পনা নিয়েছো বাবা?  নেয়াজ সাহেব বললেন, হিসাব করে দেখলাম আমার কাছে যে পরিমাণ বই আছে তা দিয়ে বিশাল এক লাইব্রেরি করা সম্ভব।  সম্ভব মানে? তোমার তো লাইব্রেরি আছেই। এটা তো লাইব্রেরি’ই নাকি?  তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস না। আমি বাড়ির ভেতর না বাড়ির বাইরে লাইব্রেরি করার কথা বলছি। দেখ আমাদের পাশের কটেজটা তো খালিই পড়ে আছে। সেখানে যদি একটা লাইব্রেরি করে দেই সবার জন্য তাহলে কত ভালো ভেবে দেখ!  রিদা বলল, সবাই জন্য বলতে তুমি ঠিক কি বোঝাতে চাইছো বাবা?  নেয়াজ সাহেব মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বললেন, ইয়ে মানে জনসাধারণের জন্য।  রিদা হেসে বলল, ও আচ্ছা জনকল্যাণে লাইব্রেরি! মাকে বলেছো?  নেয়াজ হেসে সাহেব বললেন, সেজন্য তুই আসিস না! এইটুকু তো তুই করবিই আমার জন্য তাই না?  রিদা হেসে বলল, মা কখনোই রাজি হবে না বাড়ির ভেতর জনকল্যাণ মূলক লাইব্রেরি খুলতে। মা পারলে কালো কাপড় দিয়ে পুরো বাড়ি ঢেকে রাখে যাতে কাক পক্ষীও আমাদেরকে দেখতে না পারে। আর তুমি জলজ্যান্ত মানুষদের আনাগোনার পথ উন্মুক্ত করতে চাইছো?  তোর মাকে কোন না কোন ভাবে রাজি করিয়ে ফেলবো তুই আর আমি মিলে ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া কটেজ তো বাড়ি কিছুটা দূরে। যাওয়া আসার পথও ভিন্ন। কিন্তু তুই ভেবে দেখ মা লাইব্রেরিটা করলে কত মানুষের উপকার হবে! তোকে আমি বলি যে আইডয়াটা কিভাবে এলো আমার মাথায়। গত জুম্মার পর এক বাঙ্গালি বাসায় গিয়েছিলাম। দশ-বারোজন ব্যাচেলর ছেলে থাকে। বাসার সেলফ ভর্তি দেখলাম শুধু নাটক, সিনেমা এসবের সিডি, ডিভিডি। আর স্যাটালাইট চ্যানেল তো আছেই। কাজ শেষের পর বাকি সময়টা এসব দেখেই কাটে সবার। কথায় কথায় বইপড়ার কথা তুললাম আমি। কয়েকজন বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো যদি মনের খোঁড়াক যোগানোর মত বই পেতো তাহলে সবাই পড়তো। সেদিন থেকেই মনেহচ্ছে যে, আমার কাছে তো বইয়ের অভাব নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার বই সংগ্রহ করেছি আমি আমার লাইব্রেরির জন্য। বিশাল এক জ্ঞানভান্ডার গড়ে তুলেছি আল্লাহর অশেষ রহমতে। কিন্তু জ্ঞান তো কুক্ষিগত করে বসে থাকার জন্য নয়। জ্ঞান ছড়িয়ে দেবার জন্য। তাই আমরা যদি লাইব্রেরিটা করি তাহলে এই বিদেশের মাটিতে অনেকেরই উপকার হবে। আমার ভাবনা ঠিকআছে কিনা বল?  অবশ্যই ঠিক আছে বাবা। মাশাআল্লাহ তোমার ভাবনারা সবসময়ই তোমার মতই অসাধারণ।  নেয়সজ সাহেব হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। এতে আরেকটাও সুফল আছে। আমি তো সারাদিন বাড়িতে বসেই থাকি। লোকজন এলে আমার সময়টাও ভালো কাটবে। কেউ কিছু শিখতে চাইলে সাহায্য করতে পারবো। তাছাড়া একথা তো তুইও জানিস দাওয়াহ থেকে কোন মুসলিম বিরত থাকতে পারে না। এটা সকল মুসলিমের জন্য অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব। বাড়িতে লাইব্রেরি হলে ঘরে বসে দাওয়াহর দায়িত্বটিও আদায় করতে পারবো আমি। রিদা হেসে বলল, হুমম…আমাকে পটানোর সব আয়োজন রেডি করেই রেখেছো তুমি। ঠিকআছে আমি রাজি মাকে বুঝিয়ে বলার জন্য।  মেয়েকে কাছে টেনে আদর করে নেয়াজ সাহেব বললেন, এবার তাহলে আমার লাইব্রেরির একটা ভাবুক কিন্তু অর্থবোধক নাম ঠিক করে দে।  কপট অভিমানী কণ্ঠে রিদা বলল, তুমি কিন্তু আমাকে খোঁচা দিচ্ছো বাবা।  নেয়াজ সাহেব হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা যা আর দুষ্টুমি করবো না। তুই আমাকে নাম খুঁজে দে।  তোমার লাইব্রেরির থীম কি হবে বাবা? জ্ঞানার্জন নাকি দাওয়াহ?  দুটোই। দুনিয়াবী চিন্তা-ভাবনা সবার মনের যে আলোকময়তাকে ধীরে ধীরে হ্রাস করে দিয়েছে, দিচ্ছে। যারফলে রুদ্ধ হবার পথে মনের দ্বার। তার উন্মোচনের জন্য সবার আগে দরকার জ্ঞানার্জন।  কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিদা বলল, ‘আলোর ঝর্ণাধারা’ ‘আলোকরশ্নি’ ‘গন্তব্য পানে’ ‘আত্মিক শুভ্রতা’ ‘পরিশুদ্ধি’। এই নামগুলো কেমন হয় বাবা?  উহু...আরেকটু অন্যরকম কিছু।  জ্ঞানার্জন নিজ সত্ত্বাকে বিকশিত হতে সহায়তা করে। ‘অন্তরও মম বিকশিত কর’ এই নামটা কেমন বাবা? কিংবা ‘মনের আয়না’? কেননা জ্ঞানার্জন দ্বারাই নিজের প্রতিচ্ছবিকে দেখে নিজকে যাচাই করতে শেখে মানুষ।  সুন্দর কিন্তু একটু বেশি ভাবুক হয়ে যাচ্ছে। অন্যকিছু বল।  জ্ঞান যেহেতু সঠিক পথ দেখায় মানুষকে। ‘বাতিঘর’ কেমন হবে?  উহু...আলোকিত বাতায়ন।  রিদা বলল, আলোকিত বাতায়ন?  নেয়াজ সাহেব হেসে বললেন, হুমম...আলোকিত বাতায়ন। বদ্ধ ঘরে আলোকরশ্নি আর বাতাস প্রবেশের জন্য যেমন একটা জানালার খুব প্রয়োজন। মনের গুমোট আর অন্ধাকাচ্ছন্ন পরিবেশ দূর করার জন্যও একটা জানালা প্রয়োজন। যা দিয়ে আলো প্রবেশ করবে, বিশুদ্ধ বাতাস ঢুকে পরিশুদ্ধ করে দেবে আটকে থাকা বাতাসকে। আর জ্ঞান এই কাজটিই করে।  রিদা হেসে বলল, একদম ঠিক বলেছো বাবা। লাইব্রেরির নাম ‘আলোকিত বাতায়ন’ রাখাটাই সবচেয়ে সুন্দর হবে। জ্ঞানের রাজ্যে সবাইকে তুমি নিমন্ত্রণ জানাতে চাইছো। সবার মনের অন্ধকারাচ্ছন্ন ম্লানতা দূর করে দেবার স্বপ্ন দেখছো। বাবা তুমি নিজেও একজন ‘আলোকিত বাতায়ন’ রুপী মানুষ।  আলহামদুলিল্লাহ। ভেবে দেখ মা প্রতিটি মানুষ যদি অন্তত একজন মানুষের অন্তরে হতে পারতো আলোকিত বাতায়ন। তাহলে আলোকিত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারতো অনেক গুণ।  ইনশাআল্লাহ বাবা আমরা নিজেরা হতে চেষ্টা করবো বদ্ধ মনের জানালা। আর অন্যেদেরকেও শেখাবো কি করে হতে হয় অন্যের তরে আলোকিত বাতায়ন।  নেয়াজ সাহেব বললেন, তাহলে চল এখান থেকেই কাজ শুরু করি। সর্বপ্রথম কাজ তোর মাকে রাজি করানো।  বাবার হাত ধরে টেনে উঠিয়েরিদা হেসে বলল, চলো আমার সাথে এক্ষুনি রাজি করিয়ে দিচ্ছি মাকে ইনশাআল্লাহ। 

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)