সাহিত্য

এক টুকরো সুখের আবাস......

এক টুকরো সুখের আবাস......
দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে বাগানে একাকী বসে থাকা বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলো আরিফী। নিজের অজান্তেই একসময় চোখ বেয়ে নেমে এলো অশ্রুধারা। কি অদ্ভুত মানুষের জীবন। যে কোন মুহুর্তের যে কোন ঝড়ে বদলে যেতে পারে জীবন। ঘুরে যেতে পারে জীবনের মোড়, চলার গতিপথ। অথচ অনিশ্চিত এই জীবন নিয়ে কত পরিকল্পনাই না মানুষ করে। এই তো তিন মাস আগে ঠিক ঐখানটাতেই বাবার সাথে মাও বসা ছিলেন। শাবাব ও আরিফীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন কবে তাকে নাতী-নাত্নী উপহার দেবে! সেদিন নিজের মনের স্বপ্নের কথাও বলেছিলেন মা। একহাতে শাবাব ও অন্যহাতে আরিফীর হাত ধরে বলেছিলেন, জানিস তোদের বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই আমি স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি চাঁদের মতো ফুটফুটে একটা নাতী আসবে আমার ঘরে। সারাক্ষণ ওর ওয়া ওয়া ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হবে বাড়ির আকাশে বাতাসে। সারা বাড়ি ভরে ঘুরঘুর করবে, এটা ফেলবে, ওটা ধরবে, সেটা ভাঙবে। তোরা দুজন কিন্তু কিছুই বলতে পারবি না আমার নাতীকে এখনি সাবধান করে দিচ্ছি। তারপর একটু বড় হলে ওকে নিয়ে আমরা পার্কে ঘুরতে যাবো। আরেকটু বড় হলে ওকে স্কুলে নিয়ে যাবো। অন্যায় করে তোদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার কাছে এসে লুকাবে। আরো কত শত স্বপ্ন ছিল মা’র মনে। সেই সব স্বপ্ন অপুর্ণ রেখে মা চলে গেলেন কভু না ফেরার দেশে। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো আরিফী। শাবাব এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। আরিফীর চোখে অশ্রু দেখে ছলছল করে উঠলো শাবাবের চোখও। যাদেরকে ছেড়ে মানুষ এক মুহুর্ত থাকার কথা চিন্তা করতে পারে না, কত সহজেই না জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় তারা। অথচ জীবন ঠিকই চলতে থাকে আপন গতিতে। শাবাবের হাত নিজের হাতে টেনে নিলো আরিফী। বাবার জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছে শাবাব। মাকে ছাড়া কিছুই বুঝতেন না বাবা। এক মুহুর্ত চলতো না বাবার। দেখো তিন মাসেই কতটা ভেঙ্গে পড়েছেন বাবা। যেভাবে অনিয়ম করছেন জানি না কখন কি হয়ে যায়। কিছুক্ষণ নীরবতার পর শাবাব বলল, সকালে একটা রুটি খেয়েছিলেন চাচ্চু। সারাদিন আর কিছুই খাননি। মাহামকে আসতে বলেছি আমি। মাহামকে চাচ্চু সবচেয়ে বেশি আদর করেন। মাহামই হয়তো পারবে কিছুটা হলেও সান্ত্বনা দিতে। তুমিও তো সারাদিন বাইরে ছিলে। যাও ফ্রেশ হয়ে নাও আমি খাবার দিচ্ছি। Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck ছোট চাচ্চুর সাথে সবসময়ই মাহামের খুব ভাব। ঠিকই এই কথা সেই কথা বলতে বলতে চাচ্চুকে খাইয়ে দিলো মাহাম। তারপর চাচ্চুকে বিছানাতে দিয়ে এসে শাবাব ও মাহাম বাগানে এসে বসলো। শাবাব বলল, তুই কয়েকদিনের জন্য এই বাড়িতে চলে আয়। তুই ছাড়া আর কারো কথাই শুনতে চান না চাচ্চু। যে হারে অনিয়ম করছেন খুব ভয় লাগে। আরিফীও সারাক্ষণ বাবার চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকে। মানুষের জীবনের কষ্টগুলো যদি পেন্সিলে আঁকা কিছু হতো তাহলে খুব ভালো হতো তাই না শাবাব? যে যে কষ্টগুলো ব্যহত করতে চেষ্টা করতো জীবনের স্বাভাবিকতা, সে সে কষ্টগুলোকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলা যেত। তবে আমার মনেহয় জানো? ঘষে ঘষে তুলে ফেলতে না পারি, কিন্তু জীবনের ভাঁজে ভাজে ছড়িয়ে থাকা সুখের ছোঁয়ায় সেসবকে ঢেকে ফেলার চেষ্টা মনেহয় করতে পারি। তোর কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি। বোনের দিকে তাকিয়ে বলল শাবাব। মাহাম হেসে বলল, কয়েকদিন আগে একটা প্রসঙ্গে আয়ান বলেছিলেন, আমরা যারা ঈমানদার তাদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে জীবনের দুঃখ-কষ্ট-ব্যথা-বেদনাগুলোকে পরীক্ষা মনে করে নিতে পারি। এটাই নিয়তির লিখন আর এতেই আছে কল্যাণ এই ভরসা করতে পারি। আর বিশ্বাসী হৃদয় হচ্ছে সেটা যখন সে যে অবস্থানে থাকবে সেটাকেই মেনে নিয়ে সেই পরিস্থিতির আলোকে জীবনকে সুখী ও সুন্দর করতে চেষ্টা করবে। শাবাব আমি কয়েকদিন থেকে একটা কথা ভাবছিলাম। কি কথা? জানতে চাইলো শাবাব। পরিবারের আমরা সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কারো পক্ষেই সম্ভব না অন্যকারো দিকে সর্বক্ষন খেয়াল রাখা। চাচীমা মারা গিয়েছেন খুব বেশিদিন হয়নি তাই আমরা সবাই চাচ্চুকে কম বেশি সঙ্গ দিতে চেষ্টা করছি কিন্তু আর কয়েক মাস গেলে আমাদের কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু চাচ্চুর কাছে কি হবে? চাচ্চু তার জীবনের চলার পথের সাথীকে হারিয়েছেন। জীবনের শেষ বেলায় দাঁড়িয়ে এই অভাব পূরণ হওয়াটা খুব কঠিন। যতই দিন পেরোবে চাচীর অভাববোধ আরো বেশি বেশি অনুভব করবে চাচ্চু। আমি তাই ভাবছিলাম কেমন হয় যদি চাচ্চুকে আবার বিয়ে দেয়া যায়? বিয়ে? এই বয়সে? বিস্ময় ফুটে উঠলো শাবাবের কণ্ঠে। এই বয়সেই একটি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়ের বেশি প্রয়োজন হয় একজন মানুষের। তুমি তো তোমার পড়াশোনা ও সংসার নিয়েই হিমশিম খাও। আল্লাহ চাইলে যদি ছোট্ট কোন বাবু আসে তোমার জীবনে তখন কি ব্যস্ততা আরো বেড়ে যাবে না? আরিফী ভাইয়াও প্রচণ্ড ব্যস্ত। তোমার দুই ননদও নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সবার ভিড়ে চাচ্চুকে তো একাকীত্বের জীবনই যাপন করতে হবে তাই না? তারচেয়ে কি এটা ভালো নয় যে উনার জন্যও একজন সাথী খুঁজে বের করা? কিন্তু আরিফী কি রাজী হবে? কেন রাজী হবে না? অবশ্যই হবে। শাবাব ভেবে দেখো বাবা-মা পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই আমাদের জন্য ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করতে শুরু করেন। আর জন্মের পর থেকে নিয়ে কত কিছুই না করেন তারা আমাদের জন্য। বাবা-মার জন্য কিছু ত্যাগ করার সুযোগ খুব কম আসে সন্তানদের কাছে। তাই যখন সে সুযোগ আসে সন্তানদের উচিৎ সেটা লুফে নেয়া এবং সেটাকে কাজে লাগানো। আয়ানকে আমি বলেছি কথা বলতে আরিফী ভাইয়ার সাথে। এরপর পরিবারের বাকি সবার সাথে কথা বলবো আমরা। সবাই রাজী হবার পর চাচ্চুর সাথে কথা বলবো আমরা। হাসি ফুটলো শাবাবের চেহারাতে। সত্যি অনেক ভালো হবে তাহলে। কিন্তু পাত্রী কোথায় পাবো আমরা চাচ্চুর জন্য? হাসলো মাহাম। পাত্রী তো ঘরেই আছে। ছোট খালামণি। ছোট খালামণি মানে? চোখ বড় বড় করে মাহামের দিকে তাকালো শাবাব। মাহাম হেসে বলল, ছোট খালুজান মারা গিয়েছেন প্রায় এক বছর হয়ে গিয়েছে। রেহান ভাইয়া ছাড়া খালামণিও বাকি সব ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ জীবনে। রেহান ভাইয়াও বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে থাকেন। বিয়ের পরও নিশ্চয়ই তাই করবেন। খালামণিও একা চাচ্চুও একা। উনাদের দুজনকে একাকার করে দিতে পারলে কত চমৎকার হবে ভেবে দেখো? উঠে দাঁড়িয়ে বোনের হাত ধরে টেনে শাবাব বলল, ওঠ চল কথা বলি আরিফী আর রেহান ভাইয়ার সাথে। উনাদের বাবা-মা তাই উনাদের ইচ্ছে জানতে হবে সবার আগে। Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck এক মাস পর বিয়ের কথা শোনার পর চাচ্চু ও খালামণি দুজনই ভয়াবহ রকমের রেগে গেলেও, শেষপর্যন্ত দুজনকেই হার মেনে নিতে হয়েছে ছেলেমেয়েদের ইচ্ছের কাছে। বাড়ি জুড়ে বইছিল অন্যরকম এক বিয়ের আমেজ। ছেলেমেয়েরা ছুটোছুটি করছিলো বাবা-মার বিয়ের আয়োজনে। আয়ান, আরিফী ও রেহান মিলে সিদ্ধান্ত নিলো বাবা-মায়েরা যেমন ধুমধাম করে ছেলেমেয়ে বিয়ে দেয়, তারা তেমনি ধুমধাম করে বাবা-মার বিয়ে দেবে। মাহাম ও শাবাবও কম যায় না দুষ্টুমিতে। শাবাব গলা থেকে নেকলেস আর মাহাম হাত থেকে চুড়ি খুলে পড়িয়ে দিলো খালামণিকে। শ্বাশুড়িরা যেভাবে পুত্রবধূদের বরণ করে এই বিয়েতে পুত্রবধূরা তেমনি বরণ করতে চায় শ্বাশুড়িকে। সবার সম্মিলিত সহযোগিতা ও আনন্দের মধ্যে দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে শুরু হলো জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা নিজ নিজ সঙ্গী হারা দুজন মানুষের। দুজনই একই রকম অভিজ্ঞতা পেরিয়ে এসেছে তাই সবার প্রত্যাশা ও শুভকামনা এটাই একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে আনন্দেই কেটে যাবে তাদের বাকি জীবন। মনের মাধুরী মিশিয়ে বাবা-মার জন্য বাসর ঘর সাজিয়েছিল সবাই মিলে। বাবা-মাকে তাদের ঘরে দিয়ে এসে আয়ান, আরিফী, রেহান, শাবাব ও মাহাম বাগানে এসে বসলো। সবার মন জুড়েই বইছিলো প্রশান্তিময় আনন্দধারা। এই আনন্দ বাবা-মার জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ। সন্তানদের সুখের সন্ধানে যারা নিরবধি ছুটে চলেন ক্লান্তিহীন, তাদেরকে এক টুকরো সুখের আবাস সন্ধান করে দিয়ে পারার প্রশান্তি। আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)