
সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত তিথির সারাটা ক্ষণ কাটে মেয়ের পেছনে পেছনে ছুটতে ছুটতে। না মোটেই চঞ্চল না তিথির সাড়ে ছয় বছর বয়সী মেয়ে পিহু, বরং অন্যান্য অনেক বাচ্চার চেয়ে শান্তই বলতে হবে। একমাত্র খাওয়া ছাড়া আর কোন কিছু নিয়েই ঝামেলা করেনা বলতে গেলে। পিহু যন্ত্রণা করে ওর উদ্ভট কর্মকান্ড আর কথাবার্তা দিয়ে। এই যেমন, ফুলের টবে পানি দিতে এসে গাছের নিচে সাদা সাদা দাগ দেখে ‘পিহু’ বলে চিৎকার করে ডাক দিলো তিথি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পিহু ছুটে এসে বলল, আমাকে ডেকেছো মামনি? মেয়ের কান ধরে ঝাঁকিয়ে, তুই আবার গাছের গোঁড়ায় দুধ ঢেলেছিস? পাগল হয়ে যাবো আমি তোর যন্ত্রণায়। কতবার বলেছি তোকে এই কাজ না করতে। আচ্ছা তুই কথা কেন শুনিস না বল তো?
-তুমি জানো মামনি আমরা কিভাবে বেঁচে থাকি?
-কিভাবে বেঁচে থাকি?
-অক্সিজেন নিয়ে। বাতাসে অক্সিজেন আছে। তুমি জানো বাতাসে অক্সিজেন কে দেয়?
-কে দেয়?
-গাছ দেয়। তাই আমাদের উচিত গাছদের যত্ন করা। ভালো ভালো খাবার খেতে দেয়া। যাতে গাছ বেশি বেশি করে অক্সিজেন দিতে পারে। নয়তো তো আমরা মারা যাবো।
-মেয়েকে কাছে টেনে হেসে, সব ঠিকআছে কিন্তু মা দুধ তো গাছের খাবার না। গাছের খাবার হচ্ছে পানি।
-শুধু পানি খেলে তো গাছ বড় হবে না মামনি। ভিটামিনও খেতে হবে তো। বাবা বলেছে দুধে সব ভিটামিন আছে। বাবা আরো বলেছে কোন কিছু খেতে ইচ্ছে না করলে সেটা কাউকে দিয়ে দিতে। কক্ষনো ফেলে না দিতে। ফেলে দিলে অপচয় করা হবে। আর যে অপচয় করে সে ইবলিশ আঙ্কেলের ভাই হয়ে যায়। আমার দুধ খেতে ইচ্ছে করছিলো না তাই আমি গাছকে দিয়ে দিয়েছি।
-ইবলিশ আবার তোর আঙ্কেল হল কবে?
-তুমিই তো বলেছো বড়দের নাম ধরে না ডাকতে। তুমি জানো ইবলিশ আঙ্কেল আমাদের চেয়ে কত বড়?
-হেসে ফেলে, আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাবো তোর এইসব কথাবার্তা শুনতে শুনতে। পাকনা বুড়ি। মাকে হাসতে দেখে তো পিহু মহা আনন্দিত হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো।
দুপুরে রান্নাঘরে ঢুকে তো চোখ থমকে দাঁড়ালো তিথি। হলুদের গুঁড়া একটা বাটিতে নিয়ে পানি তারমধ্যে পানি দিয়ে নাড়ছে পিহু। মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিহু হেসে বলল, মামনি আমি ছবি আঁকতে গিয়ে দেখি আমার হলুদ রং শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই হলুদ দিয়ে রং বানিয়ে নিচ্ছি। দেখেছো আমার কত বুদ্ধি? আদর দাও আমাকে। তিথি মেয়ের কাছে গিয়ে নাক টিপে হেসে বলল, কি অবস্থা করেছিস সারা শরীরে হলুদ মেখে। যা বাথরুমে যা আমি আসছি গোছল করিয়ে দেবো। বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের কথা মেনে নিয়ে বাথরুমে রওনা করলো পিহু। কিছুক্ষণ পর বাথরুমের দরজায় এসে তো দেখে বাথটাবে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে সে কাপড় ধোঁয়ার সাবান দিয়ে গোছলের সাবানকে ঘষছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, পিহু কি করছিস তুই?
-সাবান ধুচ্ছি মামনি।
-সাবান ধুচ্ছিস কেন?
-সাবান দিয়ে গোছল করবো তো তাই আগে পরিষ্কার করে নিচ্ছি। তুমিই না বলেছো সবসময় সবকিছু পরিষ্কার করে ব্যবহার করতে।
-হাসতে হাসতে তিথি বলল, তোকে উচিত সার্কাসে নিয়ে দিয়ে আসা। টিকিট কেটে দেখার মতো মানুষ তুই বুঝলি। আমি আল্লাহর কাছে এখন থেকেই দোয়া করা শুরু করবো তোর মতো পিকুলিয়ার একটা মেয়ে যেন আল্লাহ তোকে দেন।

হসপিটালের বেডে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকা পিহুর দিকে তাকিয়ে পনেরো বছর আগের সেই মিষ্টি মধুর দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলো তিথি। মেয়ে আর নাতনীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে আপন মনে বলল, মা-মেয়ের মিষ্টি ভুবনে আপনাদের দুজনকে স্বাগতম। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যেসব মিষ্টি জিনিসে একটু লবণের ছিটা দিলে স্বাদ আরো বেড়ে যায় মা-মেয়ের সম্পর্ক হচ্ছে তেমন ধরণের মিষ্টি বন্ধন। কখনো মা মেয়েকে বোঝে না তো কখনো মেয়ে মাকে, কখনো দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্যর কারণে মতের অমিল, রুচিবোধের ভিন্নতার কারণে পছন্দের অমিল। আরো কত কি লবণের ছিটা পড়ে মা-মেয়ের এই বন্ধনের উপর। কিন্তু তাতে কখনোই বন্ধন ছিড়ে যায় না। আর যাবেই না কিভাবে মেয়েরা তো মায়েরই অংশ। কোথায় যেন পড়েছিলো বা শুনেছিলো যে, সাম রিলেশনশীপ আর লাইক টম এন্ড জেরী। দে টিচ ইচ আদার, নক ডাউন ইচ আদার, ইরেটেট ইচ আদার, বাট কান্ট লিভ ইচ আদার। মা-মেয়ের সম্পর্কটাকেও তিথির কাছে এমন মনে হয়েছে অভিজ্ঞতা থেকে। পিহুর সাথে তার মতের মিল কখনোই হয়না। সারাক্ষণ দুজন খিটপিট করতেই থাকে। কিন্তু না পিহু তাকে ছাড়া থাকতে পারে, না সে পারে পিহুকে ছাড়া একমুহুর্ত কোথাও থাকার চিন্তা করতে। ‘মামনি’ ডাক শুনে তিথি বাস্তবে ফিরে এলেন। পিহু তাকিয়ে আছে। তিথি বলল, কিছু লাগবে মা? পানি পিপাসা পেয়েছে?
-না তুমি আমার কাছে এসে বোস।
-উঠে মেয়ের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তিথি বলল, শরীর এখন কেমন লাগছে মা তোর?
-হেসে, আলহামদুলিল্লাহ্! এখন অনেক ভালো ফিল করছি মামনি। কিন্তু খুব টেনশনে আছি।
-কেন মা কি হয়েছে?
-আল্লাহ যদি তোমার দোয়া কবুল করে ফেলেন আর আমার মেয়েটা যদি সত্যি আমার মতো পিকুলিয়ার হয় তাহলে কি হবে ভাবে আমি এখনই টেনশিত ফিল করছি।
-মেয়ের কান টেনে হেসে তিথি বললেন, দুষ্টু মেয়ে আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
-মায়ের হাত দুহাতের মাঝে পুরে পিহু বলল, মামনি আমাকে দোয়া করে দাও আমি যেন তোমার মতো মা হতে পারি।
-কেন এই দোয়া করবো কেন? সারাজীবন আমার প্রতি তো তোর অভিযোগের শেষ ছিল না। তোর মেয়েও কিন্তু তাহলে তাই করবে।
-হেসে, করুক। তারপরও আমি তোমার মতো মা হতে চাই। যেসব শিক্ষা তুমি আমাকে দিয়েছো তার সব শেখাতে চাই আমার মেয়েকে।
-যেমন?
-অন্যের সুখের বদলে নিজের সুখ না কেনা। অর্থাৎ, নিজে সুখী হবার জন্য অন্য কাউকে দুঃখী না করা। জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব না করা, অল্পে সন্তুষ্ট থাকা, ভালোবাসার অপর পিঠেই থাকে ঘৃণা... সেই ঘৃণা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। অপরের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে ধৈর্য্য খুব গুরুত্বপুর্ন। তাই সর্বাবস্থায় ধৈর্য্যশীল থাকার চেষ্টা করা। মানুষকে তার ভালো ও মন্দ দুটি দিক থেকে আলাদা করে দেখতে চেষ্টা করা। কেউ কষ্ট দিলে সেটা ফিরিয়ে দেবার আশা না রাখা। বরং আশা রাখা যে কষ্টদাতা একদিন তার ভুল বুঝবে, আর তাতেই সব কষ্ট দূর হবে। এইসব কিছু তো আমি তোমার কাছ থেকেই শিখেছি মামনি। আরো কি শিখেছি তোমাকে দেখে জানো মামনি?
-কি?
-শিখেছি যে জীবন প্রতি মুহুর্তে আমাদের পরীক্ষা নেয়...সেই পরীক্ষায় পাশ করার জন্য যেমন আমরা চেষ্টা করি, তেমনি সম্পর্কের মধ্যে সমস্যাগুলোকেও যদি আমরা পরীক্ষা হিসেবে দেখি এবং পাশ করার চেষ্টা করি তাহলে মনেহয় অকারণ ভাবনা অনেক কমে যায়। কারণ যার যার পরীক্ষা তার তার। অন্য কি করলো দেখার চেয়ে আমি পাশ করছি কিনা সেটা বেশি গুরুত্বপুর্ন। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হল পৃথিবীর সবাই সম্পর্কের মূল্য বোঝে না। তাই যারা বোঝে তাদের কষ্টও বেশি পেতে হবে, ছাড়ও বেশি দিতে হবে। আর তারা এমন করে বলেই তো সম্পর্কগুলো সফল ভাবে টিকে থাকে।
-মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিথি বলল, আমি দোয়া করি তোর মতো একটা মেয়ে যেন আল্লাহ তোকে দেন।
-আর আমি দোয়া করি তোমার মতো একটা করে মা যেন আল্লাহ সব মেয়েকে দেন। মা-মেয়ের সম্মিলিত হাসিতে ঘুম থেকে উঠে গেলো নতুন প্রজন্ম। গল্প কথা ছেড়ে মা-মেয়ে তখন তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)